অপারেশন লন্ডন ব্রিজ: রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু-পরবর্তী রাজকীয় পরিকল্পনার আদ্যোপান্ত
সাত দশক ব্রিটেনের সিংহাসনে থাকার পর গত ৮ সেপ্টেম্বর ৯৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। রানির মৃত্যুর পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াসহ নানাবিধ রাজকীয় আচার-রীতি পালনের জন্য এক বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ব্রিটেনের রাজপরিবার। 'অপারেশন লন্ডন ব্রিজ' নামক এই পরিকল্পনা অনুসরণ করেই শেষ বিদায় জানানো হবে ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর যুক্তরাজ্যজুড়ে কী কী আচার-অনুষ্ঠান পালিত হবে, তার সবকিছুই 'অপারেশন লন্ডন ব্রিজ' নামক এ পরিকল্পনার আওতায় নির্ধারণ করা হয়েছে। রানির মৃত্যুর খবর এখন সর্বজনবিদিত এবং তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রস্তুতি চলছে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী, রানির মৃত্যুতে ১০ দিনব্যাপী রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হবে যুক্তরাজ্যে।
সংবাদমাধ্যম পলিটিকো সূত্রে জানা গেছে, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অনুষ্ঠিত হবে রানির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং এরপর উইন্ডসর ক্যাসলের রাজা ষষ্ঠ জর্জ মেমোরিয়াল চ্যাপেলে তাকে সমাধিস্থ করা হবে।
চলুন জেনে নেওয়া যাক 'অপারেশন লন্ডন ব্রিজ' ও রানির শেষ বিদায়ের আদ্যোপান্ত।
অপারেশন লন্ডন ব্রিজ কবে শুরু হয়েছিল?
১৯৫২ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাবা, রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর পর থেকে রাজপরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে 'কোড ফ্রেজ' বা 'সংকেতসূচক শব্দগুচ্ছ' প্রচলন করা হয়। রাজা ষষ্ঠ জর্জের কোডটি ছিল 'হাইড পার্ক কর্নার', যেটির মাধ্যমে প্রধান রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হয়েছিল।
এরপর থেকে রাজপরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের মৃত্যুতে আলাদা আলাদা 'কোড ফ্রেজ' প্রচলনের নিয়ম করা হয়। এই যেমন- রানি মায়ের জন্য 'অপারেশন টে ব্রিজ' এবং প্রিন্স ফিলিপের জন্য 'অপারেশন ফোর্থ ব্রিজ' শব্দগুচ্ছ বেছে নেওয়া হয়েছিল।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্য 'অপারেশন লন্ডন ব্রিজ'কে বেছে নেওয়ার পাশাপাশি তার ছেলে প্রিন্স চার্লসের জন্য কোড ফ্রেজ হিসেবে 'অপারেশন মেনাই ব্রিজ' নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
অপারেশন লন্ডন ব্রিজ কিভাবে কার্যকর করা হচ্ছে?
দ্য গার্ডিয়ান সূত্রে জানা গেছে, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পরপরই শুরু হয়েছে গেছে অপারেশন লন্ডন ব্রিজ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, রানির ব্যক্তিগত সচিব স্যার এডওয়ার্ড ইয়ং প্রথম কর্মকর্তা হিসেবে এ খবর জানিয়েছেন সবাইকে। তিনিই প্রধানমন্ত্রী এলিজাবেথ ট্রাসের সাথে যোগাযোগ করেছেন এবং রানির মৃত্যু সংবাদ জানাতে সংকেতসূচক শব্দগুচ্ছ 'লন্ডন ব্রিজ ইজ ডাউন' বলেছেন।
অপারেশন লন্ডন ব্রিজ-এর মাধ্যমে আর কাকে রানির মৃত্যুসংবাদ দেওয়া হয়েছে?
পররাষ্ট্র দপ্তরের গ্লোবাল রেসপন্স সেন্টার থেকে যুক্তরাজ্যের বাইরের ১৫টি রাষ্ট্র (যেগুলোর রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেও ছিলেন রানি) এবং কমনওয়েলথের আরও ৩৬টি দেশের কাছে (যেখানে রানিকে প্রতীকীভাবে রাষ্ট্রপ্রধান বিবেচনা করা হতো) পাঠানো হয়েছে রানির মৃত্যুর খবর। বিশ্ব নেতা, রাষ্ট্রদূত, গভর্নর জেনারেল এবং আরও রাষ্ট্রপ্রধানদেরও অবহিত করা হয়েছে রানির মৃত্যু সম্পর্কে।
সাধারণ মানুষ কিভাবে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু সংবাদ জেনেছে?
'অপারেশন লন্ড ব্রিজ'- এর মাধ্যমে প্রথমে নির্বাচিত কয়েকজন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাকে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে। এরপর প্রেস এসোসিয়েশন এবং বিশ্বব্যাপী মিডিয়া আউটলেটগুলোতে সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে জনসাধারণকে রানির মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে।
এর পাশাপাশি, একজন ফুটম্যানের মাধ্যমে বাকিংহাম প্যালেসের বাইরে রানির মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। প্যালেসের ওয়েবসাইটেও নোটিশ দেওয়ার মাধ্যমে এ খবর জানানো হয়েছে।
গত ৮ সেপ্টেম্বর রাজপরিবারের পক্ষ থেকে টুইটারে রানির মৃত্যুর সংবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। পোস্টে বলা হয়, "আজ বিকালে বালমোরালে রানি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। কিং ও কুইন কনসোর্ট আজ বালমোরালে থাকবেন এবং আগামীকাল লন্ডনে ফিরবেন।"
রানির মৃত্যুতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীরই প্রথম আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়ার নিয়ম। এরপর নতুন রাজা প্রিন্স চার্লসের সাথে দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর। তারপরে সন্ধ্যা ৬টায় প্রিন্স চার্লস জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিয়েছেন।
রানির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কখন ও কোথায় অনুষ্ঠিত হবে?
প্রিন্স চার্লসের বক্তব্যের পর যুক্তরাজ্যে ১০ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। রানি কোথায় মারা গেছেন তার উপর ভিত্তি করে নেওয়া হচ্ছে আলাদা আলাদা পদক্ষেপ। রানি যদি স্কটল্যান্ডে মারা যেতেন তাহলে 'অপারেশন ইউনিকর্ন' কার্যকরী হতো। সেখান থেকে তখন রানিকে হলিরুডহাউজে নিয়ে আসা হতো, তারপর সেন্ট জিলেস ক্যাথেড্রেলে এবং অবশেষে তার কফিন ওয়েভারলি স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হতো এবং রাজকীয় ট্রেনে করে লন্ডনে নিয়ে আসা হতো।
সংবাদমাধ্যম পলিটিকো জানিয়েছে, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হবে এবং এরপরে উইন্ডসর ক্যাসলের সেন্ট জর্জ চ্যাপেলে একটি 'কমিটাল সার্ভিস' বা রানিকে শেষবারের মতো বিদার জানানোর প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হবে। এরপর রানীকে উইন্ডসর ক্যাসলের রাজা ষষ্ঠ জর্জ মেমোরিয়াল চ্যাপেলে সমাহিত করা হবে।
সূত্র: পিপলস