ভারতের চাল রপ্তানিতে শুল্ক আরোপের ফলে খাদ্য মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা
ভারতের আরোপিত কয়েক ধরনের চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা ও শুল্ক আরোপে বাংলাদেশি চাল আমদানিকারক ও মিলাররা উদ্বিগ্ন। ভারতের এই পদক্ষেপে বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। খাদ্য মূল্য সূচকের পতন ও ইউক্রেনীয় বন্দর থেকে সরবরাহ পুনরায় চালু হওয়ায় খাদ্যের দাম কমার যে আশা দেখা দিয়েছিল, তা আবারও বিপন্ন।
মৌসুমি বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় প্রধান ধান উৎপাদনকারী রাজ্যে রোপণ কমে যাওয়ার পর ভারত বৃহস্পতিবার বিভিন্ন গ্রেডের চালের রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে।
চালের দাম বাড়া ছাড়াও, বিশ্বের বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক দেশের এই সিদ্ধান্ত গম ও ভুট্টার বাজারেও মূল্যস্ফীতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
চালের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মায়ানমারে চালের দাম বাড়তে চলেছে বলছেন ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা। প্রতিকূল আবহাওয়া ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য আমদানিকারকদের ভোগান্তি এবার আরও বাড়তে চলেছে।
ভারত সরকার চাল রপ্তানিতে শুল্ক কমানোর পর আমদানি শুরু করতে না করতেই উদ্বেগে বাংলাদেশের আমদানিকারকরা যারা ভারতের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে।
চাল আমদানিকারক ও বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট শাহিদুর রহমান পাটোয়ারী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সর্বশেষ রপ্তানি শুল্ক রোদে শুকানো চালের জন্য। এটি সেদ্ধ চালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না যা বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে। কিন্তু তারপরও বিষয়টি ইঙ্গিত দেয় যে ভারত চাল রপ্তানি সীমিত করতে আগ্রহী।'
'সেদ্ধ চালের শুল্কও বাড়ানো হতে পারে। সেক্ষেত্রে বেসরকারি আমদানিকারকদের জন্য অনুমোদিত ১০ লাখ টন চাল ক্রয় ব্যাহত হবে,' বলেন তিনি।
একই সময়ে ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়াসহ অন্যান্য রপ্তানিকারক দেশও দাম বাড়াতে চাইবে যা সামগ্রিক চাল আমদানিকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
'আমদানির মাধ্যমে চাল সরবরাহ নিশ্চিত করার যে পরিকল্পনা আমরা করেছিলাম তা ভেস্তে যেতে পারে,' নিজের উদ্বেগ জানিয়ে বলেন এই ব্যবসায়ী।
খরার কারণে আবাদ এলাকা কমে যাওয়ায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধানের ফসল আমনের ফলন কম হওয়ার আশঙ্কার মধ্যে সরকার বেসরকারিভাবে ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। এর বেশির ভাগই ভারত থেকে আনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এছাড়া সরকার ভারত থেকে ১ লাখ টন, ভিয়েতনাম থেকে ২ দশমিক ৩ লাখ টন এবং মিয়ানমার থেকে ১ লাখ টন চাল কেনার পরিকল্পনা করেছে।
ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্যও এই সিদ্ধান্ত বিস্ময়কর। ভারতীয় বন্দরে চাল লোডিং বন্ধ হয়ে গেছে এবং প্রায় এক মিলিয়ন টন শস্য সেখানে আটকে রয়েছে কেননা ক্রেতারা ইতোমধ্যে হওয়া চুক্তিমূল্যের ওপর সরকারের নতুন ২০ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক দিতে অস্বীকার করছে বলে শুক্রবার রয়টার্সকে জানান পাঁচ রপ্তানিকারক।
ভারতের রপ্তানি সীমিতকরণের প্রভাব অন্যান্য রপ্তানিকারক দেশের চালের দামেও প্রভাব ফেলতে পারে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্বব্যাপী চালের চালানের ৪০ শতাংশেরও বেশি ভারত সরবরাহ করে থাকে। দেশটি থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের সাথে বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতা করে।
'থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের সরবরাহকারীরা দামবৃদ্ধির কথা জানালে মিয়ানমারে চালের দাম টন প্রতি ৫০ ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে,' বলেন সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক একজন ব্যবসায়ী।
রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ভারতের সিদ্ধান্তের আগে মিয়ানমার ফ্রি অন বোর্ড পাঁচ শতাংশ ভাঙা চালের দাম প্রতি টন ৩৯০ ডলার থেকে ৩৯৫ ডলার পর্যন্ত হাঁকে। ভারতে ৫ শতাংশ ভাঙা সাদা চালের দাম প্রায় টন প্রতি ৩৮৪ ডলার উল্লেখ করা হয়।
থাই রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি চুকিয়াত ওফাসওংসে রয়টার্সকে বলেন, এই সিদ্ধান্তটি বাণিজ্য প্রবাহকে প্রভাবিত করবে কারণ ভারতের সাদা চালের দাম থাইল্যান্ডের তুলনায় প্রতি টন প্রতি ৬০ থেকে ৭০ ডলার কম।
'থাই ও ভিয়েতনামী চালের জন্য আরও ক্রয়াদেশ আসবে," বলেন তিনি। 'ভারতে এই নীতি কতদিন চলে তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। যদি এটি দীর্ঘমেয়াদী হয় তবে থাই চাল রপ্তানির চাহিদা বাড়াবে।'
ন্যাশনাল অস্ট্রেলিয়া ব্যাংকের কৃষি অর্থনীতিবিদ ফিন জিবেল বলেছেন, 'অনেক দেশেই খাদ্য নিরাপত্তার ওপর চাপ তৈরি হতে চলেছে।'
চীন ও ফিলিপাইনের মতো শীর্ষ আমদানিকারকরা ভুগবে
চালের দাম বাড়লে বিশ্বের শীর্ষ চাল আমদানিকারক চীন ও ফিলিপাইন তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
পশু খাদ্যে ব্যবহারের জন্য ভারতীয় ভাঙা চালের অন্যতম বড় আমদানিকারক চীন চালের পরিবর্তে ভুট্টার দিকে নজর দিবে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করছেন।
সাংহাই জেসি ইন্টেলিজেন্স কো লিমিটেডের বিশ্লেষক রোজা ওয়াং বলেছেন, 'আমাদের ধারণা এই নিষেধাজ্ঞার ফলে আমদানির পরিমাণ কমে যাবে। তবে নতুন চীনা ভুট্টা শীঘ্রই বাজারে আসছে এবং অন্যান্য আমদানিকৃত শস্যও প্রচুর পরিমাণ রয়েছে।'
'এমনকি থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম জোট বেঁধে রপ্তানিমূল্য বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে এমন খবরও ইতোমধ্যে শোনা গেছে। আমরা এই সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলো কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে তা বিশ্লেষণ করছি,' রয়টার্সকে বলেন ফিলিপাইনের কৃষি বিভাগের পলিসি, প্ল্যানিং ও রেগুলেশনের আন্ডারসেক্রেটারি মার্সেডিটা সোমবিলা।
এদিকে। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে সম্মত হয়েছে। বিশ্ব বাজারে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করার পাশাপাশি কৃষকদের আয় বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানায় তারা।