চণ্ডিগড় বিশ্ববিদ্যালয়: এক 'বাথরুম ভিডিও' জেরে বন্ধ হয়ে গেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
হোস্টেলের বাথরুমে নারী শিক্ষার্থীর ভিডিও ধারণ করাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে চণ্ডীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের প্রবল আন্দোলনের মুখে বন্ধ রয়েছে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে অবস্থিত, বেসরকারিভাবে পরিচালিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। হোস্টেলের একাধিক নারীর অজ্ঞাতেই তাদের গোসল করার ভিডিও ধারণ করে ইন্টারনেটে পোস্ট করা হয়েছে- এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে রোববার হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এবং অনলাইনে প্রতিবাদ জানাতে করতে শুরু করে।
অভিযোগ এসেছে, ভিডিওগুলো ধারণ করেছেন ঐ হোস্টেলেরই একজন নারী। একাধিক টুইট বার্তায় দাবি করা হয়েছে, অভিযুক্ত নারী ভিডিওগুলো নিজের বয়ফ্রেন্ডকেও দিয়েছেন।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং পাঞ্জাব পুলিশ, উভয়ই এ ঘটনা অস্বীকার করেছে। গেল রোববার পুলিশ জানায়, তারা ওই নারীর মোবাইলে শুধু তার নিজের ভিডিও পেয়েছেন। কিন্তু সেই থেকে ভিডিও ধারণকারী নারী, তার বয়ফ্রেন্ড এবং আরও একজন ব্যক্তিকে কারো অনুমতি ব্যতীত ব্যক্তিগত ছবি শেয়ারের অভিযোগে আটক রাখা হয়েছে।
ভিডিও ফাঁসের ঘটনা তদন্তের কাজে নিয়োজিত বিশেষ টিমের প্রধান, পাঞ্জাব পুলিশের কর্মকর্তা রুপিন্দর ভাট্টি বলেন, "এ বিষয়ে তদন্ত চলছে এবং অভিযুক্ত নারীর ফোন ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।" এছাড়া একটি সংবাদপত্র নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা্র বরাত দিয়ে জানিয়েছিল- অভিযুক্ত নারীর ফোনে ভিন্ন আরও একজন নারীর ভিডিওও পাওয়া গেছে। কিন্তু একথা অস্বীকার করেছেন পুলিশ কর্মকর্তা রুপিন্দর ভাট্টি। রোববার প্রশাসন ও পুলিশ শিক্ষার্থীদের কিছু দাবি মেনে নেওয়ার পর আন্দোলন বন্ধ করে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু অনলাইনে এখনো এটি নিয়ে চলছে জোর আলোচনা ও প্রতিবাদ। কিন্তু তাতে করে এ ইস্যুতে প্রচুর ভুল তথ্যও ছড়িয়ে পড়েছে।
সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ পাওয়ান দুগগাল বলেন, চন্ডিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্যুটি থেকেই বোঝা যায়, অনলাইনে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়াটা প্রশাসনের সামনে কত বড় চ্যালেঞ্জ। তার ভাষ্যে, "আমাদের কার্যকরী সমাধানে আসতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া কোনো সমাধান নয়।"
তবে সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে চণ্ডিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, বর্তমান ইস্যুটি ছাড়াও তাদের ভয় পাওয়ার কারণ রয়েছে। বিতর্কিত এই ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা দেখে তারা হতাশ বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
কী হয়েছিল চণ্ডীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে?
শনিবার বেলা গড়িয়ে যাওয়ার পরেই চণ্ডিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ শুরু হয় যা পরদিন আরো তীব্র রূপ লাভ করে। চণ্ডিগড়ের এই প্রতিবাদ সমগ্র ভারতকে বিস্মিত করে তোলে; সবগুলো গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায়ই এক নম্বরে থাকে এই খবর।
সংবাদমাধ্যম বিবিসি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চার শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলেছে, এদের মধ্যে একজন হলেন শিখা (ছদ্মনাম)। শিখা বলেন, শনিবার সন্ধ্যায় তিনি তার ডরমিটরিতে ছিলেন। বাইরে একদল শিক্ষার্থীকে তিনি দৌড়াতে দেখেন এবং হঠাৎ তার বান্ধবী এসে বলেন যে তিনি শুনেছেন একজন শিক্ষার্থীর ভিডিও অনলাইনে ফাঁস হবার পর সেই শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে! শিখা জানান, এ খবর শোনার পর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার পর তিনি দেখেছেন মেয়েরা চিৎকার করছে এবং জটলা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। তার ভাষ্যে- এতটা বিশৃঙ্খলা তিনি আগে কখনো দেখেননি। এসময় শিখাকে তার আরেক বন্ধু জানান যে, একজন 'নবীন' নারী শিক্ষার্থীর গোসলের ভিডিও গোপনে ধারণ করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েই বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।
এক বিবৃতিতে চণ্ডিগড় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, "কোনো শিক্ষার্থীরই আপত্তিকর কোনো ভিডিও পাওয়া যায়নি। শুধু অভিযুক্ত নারীর নিজের ব্যক্তিগত একটি ভিডিও রয়েছে যা তিনি নিজেই তার বয়ফ্রেন্ডকে পাঠিয়েছেন।"
কিন্তু শিখা ও অন্যান্য শিক্ষার্থীরা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কারো না কারো অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে তারা এও জানিয়েছেন, অভিযুক্ত নারী আরও অনেক নারীর ভিডিও ধারণ করেছেন শুনলেও, তারা নিজেরা সেসব ভিডিও দেখেননি কিংবা এমন কাউকে সরাসরি চেনেনা যে এই অপরাধের ভুক্তভোগী।
রুপিন্দর ভাট্টি বিবিসিকে বলেন, আটককৃত নারী কারো ভিডিও ধারণের কথা অস্বীকার করেছেন এবং পুলিশও এ ধরনের কোনো ভিডিও বা প্রমাণাদি পায়নি। বিবিসি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে ইমেইল করলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
অনলাইনে কী ঘটেছে?
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলমান অবস্থায় অনলাইনে নানা রকম গুজব ছড়িয়ে পড়ে। একাধিক টুইটে দাবি করা হয় যে, নিজেদের গোপনীয়তা ভঙ্গ হয়েছে জানার পর শিক্ষার্থীরা নিজের জীবন নেওয়ার চেষ্টা করেছে; এমনকি কেউ কেউ এমন ভিডিওও প্রকাশ করে যেখানে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখানো হয়েছে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ বিষয়টি অস্বীকার করেছে, যদিও পুলিশ জানিয়েছে যে একজন শিক্ষার্থী 'অ্যাংজাইটি অ্যাটাক' এর কারণে অচেতন হয়ে পড়ে গিয়েছিল।
অন্যদিকে, টুইটারে অনেকে অনুরোধ করেছেন সবার উদ্দেশ্যে যে- ওই নারীর গোসল করার ভিডিও কারো হাতে পৌঁছালেও, তারা যেন সেটি শেয়ার না করেন। কিন্তু কেউই এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেননি যে তারা ওই ভিডিও দেখেছে্ন। কেউ কেউ আবার অভিযুক্ত নারীর ভিডিও ফাঁস করেছেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে ওয়ার্ডেন তাকে ধমকাচ্ছেন বা হোস্টেলের অন্যরা তার সাথে রাগারাগি করছেন।
অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া গুজব থামানো কতটা কঠিন তা উল্লেখ করে পাওয়ান দুজ্ঞাল বলেন, "বর্তমানে ভারত এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যে মানুষ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কিছু পেলেই তা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে। মানুষ গোপনীয়তা ভঙ্গ হওয়ার ঝুঁকি এবং এর পরিণতি সম্পর্কে না জেনেই ব্যক্তিগত ডেটা অনলাইনে শেয়ার করছে।"
শিক্ষার্থীরা কেন হতাশ?
চণ্ডীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী তোইবাহ কিরমানি বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক যে এই ইস্যুতে যাচাই-বাছাই ছাড়াই নানা রকম তথ্য অনলাইনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় এই পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে দেখে তিনি দুঃখিত। তিনি বলেন, "আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার বদলে প্রশাসন সবকিছু অস্বীকার করে নিজেদের ভাবমূর্তি বাঁচাতে ব্যস্ত। কোনো শিক্ষার্থী হয়তো আত্মহত্যা করেনি, কিন্তু তারা যে যন্ত্রণার মধ্যে আছে তা স্পষ্ট।"
শিখা এও জানান যে তিনি দেখেছেন, কোনো কোনো নারী শিক্ষার্থী রাগে-ক্ষোভে দরজায় কপাল ঠুকছেন, কারণ তাদের ধারণা গোপনে তাদেরও ভিডিও ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে অভিযুক্ত নারীর বিরুদ্ধে ভারতের আইসিটি আইন অনুযায়ী, 'ব্যক্তির অনুমতি ব্যতীত তার একান্ত ব্যক্তিগত কাজের ছবি তোলা, ছবি প্রচার করা বা ছড়িয়ে দেওয়ার' অভিযোগ আনা হয়েছে।
কিরমানির প্রশ্ন, "অভিযুক্ত ঐ নারী যদি কারো ভিডিও ধারণ না করেই থাকে তাহলে পুলিশ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে কেন?" কিন্তু দুগগাল বলেন, উল্লিখিত অভিযোগগুলো কার্যকর হবে না যদি ওই নারী শুধুমাত্র স্বেচ্ছায় তার নিজের ভিডিও ধারণ করে; যদিও ভিন্ন একটি আইনের আওতায় তার উপর অশ্লীলতার অভিযোগ আনা যেতে পারে।
পুলিশ কর্মকর্তা রুপিন্দর ভাট্টি জানান, পুলিশের প্রাথমিক অভিযোগের ভিত্তিতে ওই নারীর উপর এসব চার্জ আনা হয়েছে। তদন্তে যদি কোনোকিছু পাওয়া যায়, তাহলে এসব চার্জ আবার সংশোধন করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী বলেন, অভিযুক্ত নারী আসলেই কারো গোপন ভিডিও ফাস করেছেন কিনা, সে বিষয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। কিন্তু এই ইস্যুতে এত বেশি গুজব ছড়িয়েছে যে কোনোকিছুই আর নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। এই বিশৃঙ্খলা চলাবস্থায়ই চণ্ডীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে আর নিরাপদ বোধ করছেন না... 'সেটা শারীরিক ও মানসিক, দুই ভাবেই' বলেন শিক্ষার্থীদের একজন।
সূত্র: বিবিসি