‘ভয়ে’: ইহুদি বংশোদ্ভূত ইউক্রেনীয় ও রাশিয়ানরা ইসরাইলে পাড়ি দিচ্ছে
জেরুজালেমের একটি কর্মজীবী অধ্যুষিত মহল্লায় অবস্থিত বক্সিং ক্লাবটি। স্থাপনাটি এককালে 'বম্ব শেল্টার' হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেখানেই ১৯৭০' এর দশকের জনপ্রিয় ডিস্কো সুরের তালে আজো চলে মুষ্টিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ।
এখানে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন গেরশন লুক্সেমবার্গ। শিক্ষানবিশ ও পরিচিতদের কাছ তিনি শুধুই 'গ্রিশা'। খবর দ্য গার্ডিয়ানের
বয়স ৭৮ বছর হলেও, এখনও বেশ শক্তপোক্ত সাবেক এ রুশ নাগরিকের জন্ম তৎকালীন সোভিয়েত ইউনয়নের উজবেকিস্তানে। ছিলেন মুষ্টিযুদ্ধে সাবেক রাশিয়ান চ্যাম্পিয়ন।
তরুণ বয়সে ইসরায়েলে পাড়ি জমান তিনি। ক্লাবটিতে পা রেখেই রুশভাষী অনেক প্রশিক্ষণরতের দেখা পান ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদক। রাশিয়া থেকে ইসরায়েলে অভিবাসনকারী এই নতুন শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন গ্রিশা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে ইসরায়েল অভিমুখে অভিবাসনের নতুন ঢল নামে। এরমধ্যেই ইহুদি ধর্মালম্বী প্রায় ১৩ হাজার ইউক্রেনীয় ইসরায়েলে অভিবাসন করেছে।
ধর্মীয় ও আইনিভাবে ইসরাইলের প্রতিশ্রুত ভূমিতে ইহুদিদের ফিরে আসার এই প্রক্রিয়ার নাম 'আলিয়াহ'। ইউক্রেন থেকে যতজন এসেছে; অপ্রত্যাশিত হলেও রাশিয়া থেকে ইসরায়েলে 'আলিয়াহ' করেছে তার চেয়েও দ্বিগুণ সংখ্যক রুশ নাগরিক। অর্থাৎ, রাশিয়ায় মোট ইহুদি জনসংখ্যার প্রতি আটজনের একজনই সম্প্রতি পাড়ি জমিয়েছে ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটিতে।
গত সেপ্টেম্বর রিজার্ভ সেনা তলবের ঘোষণা দেন পুতিন। তারপর থেকেই এই সংখ্যা দিনে দিনে আরও বাড়ছে।
পুতিনের ইউক্রেন যুদ্ধের কট্টর সমালোচক বলে পরিচিত আলা পুগাচেভা। এককালের সোভিয়েত 'পপ কুইন' খ্যাত এ গায়িকা গত সপ্তাহেই তার ইহুদি বংশদ্ভূত স্বামীর সাথে ইসরায়েলে পাড়ি জমান।
অভিবাসনের এই ঢল সম্পর্কে নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে গার্ডিয়ানের কাছে ব্যাখ্যা দেন গ্রিশা। তিনি বলেন, 'ছোট্টবেলায় স্কুলে থাকার সময়েই মারপিটের শিকার হই, আর তখনই আত্মরক্ষার খাতিরে শিখতে শুরু করি বক্সিং। এরপর আমি লেবানন ও ইয়ম কিপুর যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। ইহুদিরা আত্মরক্ষার জন্য লড়তে ভয় পায় না। কিন্তু, তাদের কেউই ইউক্রেনে পুতিনের যুদ্ধে অহেতুক প্রাণ বিসর্জন দিতে চায় না '।
গত দুই বছর ধরে গ্রিশার জিমনেশিয়ামে আসছেন মিখাইল। ৩৩ বছরের এ যুবকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা মস্কোতে। এখন তিনি ইসরায়েলের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে চাকরি করেন। তার মা ও বোন এখনও থাকেন রাশিয়ার রাজধানীতেই। কিন্তু, শঙ্কার কারণেই সেখানে তাদের দেখতে যেতেও পারছেন না।
মিখাইলের বলেন, 'জন্মভূমিতে আর ফিরতে চাই না। আমি আলিয়াহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এখানে বেশ সুখেই দিন কাটছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতেও খণ্ডকালীন দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু, রাশিয়ায় গিয়ে সেকাজ করতে বাধ্য হওয়ার মানে হয় না। বিষয়টা এক নয়। আমি এ যুদ্ধে অংশ নিতে চাই না'।
ইসরায়েলের আছে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের ইহুদিদের সেখানে গিয়ে বসবাস ও নাগরিকত্ব পাওয়ার আইন। এর আওতায়– জন্মসূত্রে ইহুদি, ধর্মান্তরিত বা ইহুদি ব্যক্তির স্বামী/স্ত্রী অথবা যাদের পিতা বা মাতামহ ইহুদি ছিলেন– তারাও ইসরায়েলি নাগরিকত্ব পেতে পারে।
১৯৫০ এর দশক থেকেই সুদান, ইথিওপিয়া, ইয়েমেন এবং ইউরোপের দেশগুলি থেকে কয়েক দফায় লাখ লাখ মানুষ ইসরায়েলে আলিয়াহ অভিবাসন করেছে। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর ১০ লাখের বেশি সাবেক সোভিয়েত নাগরিক ইসরায়েলে চলে আসে।
সোভিয়েত রাষ্ট্রে ইহুদিদের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেট সদস্য ইউলি এডেলস্টেইন তাদেরই একজন। ইউক্রেনীয় বংশদ্ভূত ইউলিকে সাইবেরিয়ায় কারাগারে কাটাতে হয়েছে তিন বছর। বর্তমান সময়েও তিনি সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখছেন।
তিনি বলেন, 'বহু প্রজন্ম ধরে রাশিয়ায় ইহুদিদের অভিজ্ঞতা হয়েছে বিপদকে সঙ্গে করে বাঁচার। এসব স্মৃতি কেউ ভুলতে পারে না'।
'খুব তরুণ বয়সে রাশিয়া ত্যাগ করি। তখন নিজের ইহুদি বংশধারা বা ইসরায়েল সম্পর্কেও তেমন কিছু জানতাম না। কিন্তু, আমার একটি যাওয়ার মতো গন্তব্য ছিল। যা এখন মানুষ পাচ্ছে না। বেশিরভাগই ভয়ের কারণে তড়িঘড়ি করে পালিয়ে আসছে'।
ইউক্রেনীয়দের জন্য আলিয়া প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছে ইসরায়েল। অল্প সময়ের মধ্যে তাদের প্রথমে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। তারপর চলছে নথিপত্র চূড়ান্ত করে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া।
তবে একইসঙ্গে, রাশিয়া থেকেও বিপুল সংখ্যক অভিবাসন চাহিদা দেখা দিয়েছে, যা সামলাতে টালমাটাল দশা– জিউইশ এজেন্সি'র। আধা-সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি অভিবাসন সুবিধা প্রদান করে।
সংস্থাটির তথ্যমতে, চলতি বছরে এপর্যন্ত ২৬ হাজার রুশ নাগরিক ইসরায়েলে এসেছে, কিন্তু এখনও দরকারি নথিপত্র প্রস্তুতের হওয়ার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে আরও ৩৫ হাজার জন।
অভিবাসন প্রক্রিয়া আরও দ্রুত করতে ইসরায়েলের আলিয়াহ ও অন্তর্ভুক্তকরণ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র আর অর্থ মন্ত্রণালয় চলতি বছর একটি জরুরি বৈঠক করেছে। ভ্লাদিমির পুতিনের রিজার্ভ সেনা সমাবেশের ঘোষণা দেওয়ার পর এ বৈঠক করা হয়।
সভায় মূল আলোচ্য ছিল– অভিবাসন প্রক্রিয়ার জন্য জরুরি বাজেট বরাদ্দ, অভিবাসীদের আনার পর তাদের বাসস্থান প্রদান এবং নতুন অভিবাসীদের জন্য দরকারি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা।
তবে রাশিয়ার বিচার বিভাগ জিউইশ এজেন্সি রুশ প্রাইভেসি আইনভঙ্গ করছে বলে সংস্থাটিকে বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এনিয়ে তেল আবিবের সাথে এক কূটনৈতিক টানাপোড়েনও তৈরি হয় মস্কোর।
পশ্চিমা মিত্ররা ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে শক্ত অবস্থান নেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছে। তবে সিরিয়াতে সামরিক অভিযান চালাতে মস্কোর সাথে সম্পর্কের দরকার থাকায়, এপর্যন্ত ইউক্রেন ইস্যুতে নিরপেক্ষ অবস্থানই বজায় রেখেছে তেল আবিব। কিন্তু, রাশিয়া জিউইশ এজেন্সি বন্ধের হুমকি দেওয়ার পর প্রতিবাদ জানায় তেল আবিব। ইসরায়েলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইয়ার ল্যাপিড সতর্ক করে বলেন, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুতর অবনতি হবে।
জিউইশ এজেন্সি নিয়ে মামলার কার্যক্রম বর্তমানে ধীর গতিতে চলছে মস্কোর একটি আদালতে। সংস্থাটির ভবিষ্যৎ কী হবে–তা এখনও অনিশ্চিত।