চড়া দামের ডলার, বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের সময়ে বন্দরে খাদ্যের চালান আটকে রাখছে
মার্কিন ডলারের বিনিময় মান বৃদ্ধি নাভিশ্বাস ওঠাচ্ছে খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলির। এই হাল আফ্রিকা থেকে এশিয়া– দেখা যাচ্ছে সর্বত্র। মার্কিন মুদ্রার এই উত্থানে তাদের জন্য খাদ্যপণ্য আমদানির মূল্যও বাড়ছে দিনকে দিন। অথচ, এই দেশগুলি ইতোমধ্যেই রয়েছে এক ঐতিহাসিক খাদ্য সংকটের মুখে। খবর ব্লুমবার্গের
প্রধান ভুক্তভোগী বলা যায়, উন্নয়নশীল, উদীয়মান ও স্বল্পোন্নত দেশকে। ডলারের বিপরীতে যাদের স্থানীয় মুদ্রার মান কমছে। এই বাস্তবতায় ডলার কিনতে খরচও বেশি করতে হচ্ছে তাদের। আরও দামি হয়ে ওঠা আমদানি ভোক্তাদের ঘাড়ে মূল্যস্ফীতির দৈত্যাকার ভার হয়ে চাপছে।
যেমন ধরুন ঘানার কথাই্, আসন্ন ক্রিসমাস বা বড়দিনের উৎসবকালেও খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করছেন দেশটির আমদানিকারকেরা। তাই জোরেশোরে এখন থেকেই চলছে আমদানির চেষ্টা। পাকিস্তান সম্প্রতি শিকার হয়েছে নজিরবিহীন বন্যার। এতে খাদ্য উৎপাদনে বড় ঘাটতি দেখা দিবে। তাই আমদানির নেই বিকল্প। দেশটির বন্দরগুলিতে তাই জমেছে হাজার হাজার খাদ্য বোঝাই কনটেইনারের স্তূপ। তবুও কী খাদ্য সংকট সুরাহা হচ্ছে? হয়তো না– আর সেকারণেই প্রধান কয়েকটি আটা-ময়দা তৈরির মিলের সরবরাহ ফুরিয়ে যাওয়ায় রুটির দাম বাড়িয়েছেন মিশরের বেসরকারি বেকারি মালিকেরা।
বিশ্বব্যাপী খাদ্য আমদানি-নির্ভর দেশ উচ্চ সুদহার, ডলারের চড়া মান এবং নিত্যপণ্যের চড়া দামের বোঝা বইছে। বিশ্ববাণিজ্যে প্রধান প্রধান পণ্য আমদানির সিংহভাগ হয় মার্কিন ডলারে। এতে করে, তাদের নিত্যপণ্য ও কাঁচামাল আমদানির ব্যয় মেটানো হয়ে পড়ছে দুঃসাধ্য; কমছে বিশ্ববাজার থেকে ক্রয় ক্ষমতা।
অনেক দেশেরই বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ পড়তির দিকে, ফলে তাদের হাতে ডলারও কমছে। আমদানি দায় মেটাতেও দেরি করছে তাদের ব্যাংকগুলো। ফলে ছাড় করা যাচ্ছে না বন্দরের চালান।
কৃষি খাতের মহাকায় কর্পোরেশন কারগিল ইনকর্পোরেশনের ট্রেডিং হেড অ্যালেন্স সানফিলিউ বলেন, ' (ডলার সংকটে থাকা দেশ) তারা কিনতে পারছে না, এসব শস্যের দাম মেটানোর উপায় নেই তাদের। বিশ্বের অনেক প্রান্তেই এখন এই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে'।
ডলারের ঘাটতি অনেক দেশের জন্যই নতুন কোনো সংকট নয়, বরং স্বল্পোন্নত দেশে এসমস্যা চিরকালের। তবে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি তাদের চরম প্রতিকূলে। তার সাথে ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস এবং ডলারের ঘাটতি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে।
ন্যূনতম হলে ২০০৭-০৮ সালের মতো খাদ্যের জরুরি অবস্থার মতো বিপর্যয় হবে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল- আইএমএফ। অর্থাৎ, সংস্থাটি এবিষয়ে প্রায় নিশ্চিত যে সংকট হবেই, এবং তা আরও বড় পরিসরেই হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
খাদ্য সংকট নিয়ে সরগরম হচ্ছে বিশ্ব রাজনীতিও। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা রাশিয়াকে দুষছে, অন্যদিকে মস্কোর অভিযোগ– তাদের নিষেধাজ্ঞাই রাশিয়া থেকে খাদ্য ও সার রপ্তানিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন, (খাদ্য নিরাপত্তার) সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলির জন্য খাদ্য সহায়তা বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় খাদ্য সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে বর্তমান বিশ্ব।
বাণিজ্যের মাঠপর্যায়ে নজর বুলালেই আমরা দেখতে পাব, বিশ্ববাজারে দাম বাড়তে থাকায় আমদানিকারকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে, কমছে তাদের পুঁজি। সময়মতো যেন কাস্টমস থেকে চালান ছাড় করা যায়– সেজন্য যথেষ্ট পরিমাণ ডলার কিনতেও সংগ্রাম করছে তারা।
আর্থিক এই অসঙ্গতির কারণেই বন্দরগুলিতে খাদ্য বোঝাই চালান হয় আটকে আছে, নাহয় সময়মতো অর্থ না পেয়ে সেগুলি অন্য গন্তব্যে বিক্রি করে দিচ্ছি রপ্তানিকারকেরা।
আফ্রিকার পণ্যবাজার বিষয়ক পরামর্শক টেড জর্জ বলেন, 'আমদানি মূল্য মেটাতে ঐতিহাসিকভাবেই একটা চাপ ছিল (উন্নয়নশীল/ স্বল্পোন্নত দেশের)। কিন্তু, এই মুহূর্তে তা অসহনীয় হয়ে উঠছে'।
আর হবেই না বা কেন? যখন স্থানীয় মুদ্রাগুলি ডলারের মহাপরাক্রমের কাছে দিনে দিনে আরও মাথা নুইয়েই চলেছে। যেমন চলতি বছরের ঘানার মুদ্রা সেডি ৪৪ শতাংশ মান হারিয়েছে ডলারের বিপরীতে। হয়ে উঠেছে বিশ্বের দ্বিতীয় সবচেয়ে বাজে পারফরম্যান্সের মুদ্রা। ফলে আসন্ন বড়দিনের উৎসবেও দেশটির অগণিত মানুষকে অনাহারে থাকতে হবে এমন আশঙ্কা জোরালো হয়ে উঠেছে।
ঘানার আমদানি ও রপ্তানিকারক সমিতির নির্বাহী সচিব আসাকি আয়িনগোবিত বলেন, ' কিছু খাদ্যপণ্যের সংকট তৈরি হবে বলে আমরা মনে করছি। ডলার আমাদের সেডিকে আস্ত গিলে খাচ্ছে। ফলে আমরা আছি এক অসহায় অবস্থার মধ্যে'।
ডলার যখন চরম আরাধ্য তখন ইউয়ান বা ইউরোর মতো অন্যান্য মুদ্রায় আমদানি ব্যয় মিটিয়ে কিছু দেশ এই বিপদ থেকে আংশিক রক্ষা পাবে। অন্যদিকে, ডলারে জ্বালানি বিক্রি করে লাভবান হতে পারছে জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশগুলি।
গত কয়েক মাস ধরে বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের দাম কমতে থাকায় দিগন্তরেখায় কিছুটা স্বস্তির আভা দেখা যায় ভোক্তাদের জন্য। কিন্তু, চাঙ্গা ডলার কেড়ে নিয়েছে এই সুফল। এমন মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ইউএন-ফাও) অর্থনীতিবিদ মনিকা টোথোভা। ফাও জানিয়েছে, চলতি বছর খাদ্য আমদানির ব্যয় পৌঁছাবে রেকর্ড উচ্চতায়।
খাদ্য সরবরাহের বৈশ্বিক পরিস্থিতি এখনও বেশ ঘোলাটে। ইউক্রেন যুদ্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠেছে, ফলে কৃষ্ণসাগর দিয়ে গমের চালান আর কতদিন নির্বিঘ্নে আসতে পারবে- তা নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। জলবায়ু- পরিবর্তনের ফলে বিরূপ আবহাওয়ার কবলেও পড়েছে প্রধান প্রধান উৎপাদক অঞ্চলে খাদ্যশস্যের ফলন। দেশে দেশে পড়তির দিকে খাদ্যের মজুত। তার সাথে সার ও জ্বালানি তেলের চড়া দামও খাদ্য উৎপাদনের খরচ বাড়িয়েই চলেছে।
বাংলাদেশও বিশ্ব পরিস্থিতির শিকার। বাংলাদেশের নিত্যপণ্য আমদানিকারক শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপ চলতি বছর যে পরিমাণ গম আমদানির পরিকল্পনা করেছিল, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তার চেয়ে অন্তত ২০ শতাংশ কম আমদানির পরিকল্পনা করছে শক্তিশালী ডলারের কারণে। এমনটাই জানান কোম্পানির ক্রয় কর্মকর্তা ও জ্যেষ্ঠ নির্বাহী তসলিম শাহরিয়ার।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, 'মুদ্রা বিনিময় হারের ওঠানামায় আমাদের কোম্পানির বিপুল লোকসান হচ্ছে, যা আগে কখনো দেখিনি'।
অন্যদিকে, তলানিতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার মজুত রক্ষায় বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে পাঠানোয় বাধা দিচ্ছে পাকিস্তানের সরকার। ফলে বিপুল পরিমাণ আমদানি করা ডাল, ছোলা, গম ইত্যাদির স্তূপ জমেছে দেশটির বন্দরে। এমনটাই জানান পাকিস্তানের দানাদার শস্য আমদানিকারক সমিতির চেয়ারম্যান রাউফ চপ্পল।
তবে নতুন অর্থমন্ত্রী নিয়োগের পর এই অচলাবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তিনি দায়িত্বগ্রহণ করেই ব্যবসায়ীদের বকেয়া লেনদেন মেটানোর মতো ডলার সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
চপ্পল জানান, 'পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক। আমরা দেশে দানাদার শস্যের অভাবনীয় সংকটের আশঙ্কা করছি'।