নতুন দুশ্চিন্তায় ইউক্রেন, রাশিয়া কি উত্তর সীমান্তে আরেক ফ্রন্ট খুলতে যাচ্ছে?
বেলারুশ ও রাশিয়ার যৌথ সৈন্য সমাবেশের ঘোষণার পর ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে বাজছে শঙ্কার ঘণ্টা। গত সোমবার (১০ অক্টোবর) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো যৌথ সৈন্য মোতায়নের এ ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় যৌথ বাহিনীর সাথে যোগ দিতে গত শনিবার (১৬ অক্টোবর) বেলারুশে পৌঁছেছে রাশিয়ান সৈন্যের প্রথম দল।
তাহলে কি উত্তর সীমান্তে আক্রমণের আশঙ্কা করছে ইউক্রেন? এ নিয়ে নানা তথ্য উঠে এসেছে সিএনএন-এর এক প্রতিবেদনে।
বেলারুশ বাহিনীর সাথে যোগ দিতে গত ১৬ অক্টোবর রাশিয়ান সৈন্যের প্রথম দলটি বেলারুশ পৌঁছে বলে জানিয়েছে মিনস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। বেলারুশের ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি কো-অপারেশন বিভাগের প্রধান ভ্যালি রেভেনকো বলেছেন, 'সব মিলিয়ে রাশিয়ান সৈন্য নয় হাজার জনের কম হবে।'
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বেলারুশ ও রাশিয়ার যৌথবাহিনী শেষবার যখন অভিযান চালিয়েছিল, সেসময় বহু রাশিয়ান সৈন্যদল সীমান্ত অতিক্রম করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কিয়েভ দখলের।
কিন্তু, বেলারুশের সেনাবাহিনী শক্তিশালী নয়। তবে রাশিয়ান সৈন্যদল ইউক্রেনের দীর্ঘ উত্তর সীমান্তকে দ্বিতীয়বারের মতো যাতায়াত পথ হিসেবে ব্যবহার করলে তা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়াবে। ইউক্রেনে বর্তমানে বিক্ষিপ্ত সেনাবাহিনী একদিকে পূর্ব ও দক্ষিণে আক্রমণ চালাচ্ছে এবং অন্যদিকে দোনেৎস্ক ও জাপোরিঝিয়ায় রাশিয়ান শক্তিকে প্রতিহত করছে।
উল্লেখ্য, ইউক্রেন ও বেলারুশের এক হাজার কিলোমিটারের সীমান্ত অঞ্চল কম জনবহুল এবং বনভূমিতে ঘেরা।
গত সাত মাস ধরে চলা যুদ্ধে ইউক্রেন তার প্রতিপক্ষ রাশিয়ার মতোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে ইতোমধ্যে একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। উত্তরাঞ্চল রক্ষা করতে সৈন্য পাঠালে বাহিনীটি আরও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে।
তবে, বেলারুশ থেকে বলা হচ্ছে এই যৌথবাহিনী কেবল আত্মরক্ষার জন্য। অবশ্য তারা যে এটা বলবে তা আগে থেকেই অনুমিত ছিল। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভিক্টর খ্রেনিন বলেছেন, 'এখন যে কার্যক্রমগুলো চলছে সেগুলো কেবল সীমান্তে আক্রমণের যথার্থ জবাব দেওয়ার জন্য।'
দেশটির ভাষ্যমতে, ইউক্রেনের আক্রমণকে বাধা দিতেই এই কার্যক্রমগুলো পরিচালিত হচ্ছে। গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো বলেছিলেন, তার সরকার 'ইউক্রেন সীমান্ত থেকে বেলারুস আক্রমণ করার সতর্কবার্তা দিয়েছিল।'
তারই ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার (১৫ অক্টোবর) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্লাদামির মাকেই বলেছেন, 'পার্শ্ববর্তী দেশ (ইউক্রেন) থেকে আসন্ন উস্কানির সংবাদের মাঝে একটি সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালানোর পরকল্পনা চলছে।'
তবে দাবিগুলো জোর দিয়ে নাকচ করে দিয়েছে ইউক্রেন। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয় 'বেলারুশের সর্বশেষ কটাক্ষগুলোকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। এটি যে রাশিয়ান ফেডারেশনের উস্কানির অংশ হতে পারে- এই কূটনৈতিক আশঙ্কা আমরা উড়িয়ে দিতে পারিনা।'
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত জি-সেভেন- এর এক মিটিংয়ে সীমান্তে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন। সেসময় জেলেনস্কি বলেন, রাশিয়া বেলারুশকে সরাসরি যুদ্ধে টেনে আনার চেষ্টা করছে।'
বেলারুশের রেলপথে সেনাবাহিনীর মুভমেন্ট বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। দেশজুড়ে একাধিক ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য সেনাবহর চলাচলের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বহরগুলোতে মস্কো সামরিক অঞ্চলের চিহ্ন ছিল।
বিশ্লেষকরা অধিকাংশ বহর রাশিয়ার হতে পারে বলে মনে করছেন। তারা ধারণা করছেন ইউক্রেনে রাশিয়ান সৈন্যরা যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে (বিশেষ করে গত মাসে), সেটি পূরণ করতে বেলারুশ থেকে বহরগুলো পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে।
তবে এসব তৎপরতা স্বত্ত্বেও বেলারুশের যুদ্ধে জড়ানোর সম্ভাবনা কম। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কিরবি গত সপ্তাহে বলেছেন, বেলারুশের সেনাবাহিনী 'যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে অথবা যুদ্ধে জড়াবে এমন কোনো ইঙ্গিত যুক্তরাষ্ট্র পায়নি। এটা ঠিক যে রাশিয়ার নির্দেশে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন উদ্বিগ্ন হবার বিষয়, কিন্তু পরিস্থিতি এখনো ততদূর যায়নি।'
এত অভিযোগ স্বত্ত্বেও লুকাশেঙ্কো রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অপারেশনে নিজের বাহিনীকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেননি এবং যদি করেও থাকেন অনেক বিশ্লেষকের মতে সেটি তেমন কোনো পার্থক্য আনবেনা।
পোল্যান্ডের একজন স্বাধীন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক কনর্যাড মুজাইকা বেলারুশ সামরিক বাহিনীকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। বেলারুশ সেনাবাহিনীকে তুলনামূলকভাবে দুর্বল বলে মনে করেন তিনি।
টুইটারের এক বার্তায় কনর্যাড বলেন, 'বেলারুশের সশস্ত্র বাহিনী মূলত মোবিলাইজেশনাল ফোর্স। তাদের জনবল শান্তিকালীন (যুদ্ধ না চলা অবস্থায়) প্রয়োজনীয় শক্তির ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ।'
'পূর্ণ শক্তিতে পেতে হলে তাদের আরও ২০,০০০ জনবলের প্রয়োজন হবে', সংযোজন করেন তিনি।
আবার, যৌথ বাহিনী গঠন একটি সতর্কবার্তাও হতে পারে। তবে গত সপ্তাহে লুকাশেঙ্কো বারবার বলেছিলেন বেলারুশ কোনো সামরিক শক্তি প্রয়োগের পরিকল্পনা করছেনা।
রাশিয়ার মতো বেলারুসের সেনাবাহিনী ব্যাটালিয়ন লেভেলের বেশি অনুশীলন করেনা। কিন্তু এইবছর তারা বেশ উচ্চস্তরের অনুশীলন করেছে। এরূপ আরেক দফা অনুশীলনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে গত সপ্তাহে।
ইউক্রেনের যৌথ বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার সেরহি নাইয়েভের মতে, 'এটি তাদের প্রস্তুতি ও কৃত্রিমভাবে উত্তেজনা বৃদ্ধির আরেকটি প্রদর্শনী।'
বিশ্লেষক কনর্যাডের মতে এর তিনটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে; এই অনুশীলন ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য হতে পারে, সীমান্তে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে ঘায়েল করার জন্য হতে পারে অথবা হতে পারে তারা ইউক্রেনে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই তিনটির প্রথমটি ঘটবেনা; শেষ বিকল্পটি বেলারুশে তেমন জনপ্রিয়তা পাবেনা কারণ দেশটিতে ইউক্রেনের প্রতি অতটা বিদ্বেষ তৈরি হয়নি।
তবে কিয়েভের সাথে স্থানিক নৈকট্যের জন্য নয়, বরং মস্কো চাইছে ইউক্রেন তার উত্তর সীমান্ত নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ুক। এইজন্যই যৌথবাহিনীর ব্যবস্থা করেছে রাশিয়া।
সেরহি নাইয়েভ বলেন, রাশিয়ান মিসাইল স্ট্যাকগুলোর জন্য বেলারুশ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেনের অনুমান বেলারুশে রাশিয়ার চারটি ক্ষেপনাস্ত্র মিসাইল সিস্টেম, ১২ এস-৪০০ সার্ফেস-টু-এয়ার সিস্টেম এবং গত মাসে উত্তর থেকে আসা ইরানে তৈরি কিছু ড্রোন রয়েছে। বেলারুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশটিতে আরও রাশিয়ান কমব্যাট বিমান আসা শুরু করেছে।
ইউক্রেনের কর্তকর্তাদের হিসাব মতে, বেলারুশে বর্তমানে মাত্র এক হাজার রাশিয়ান সৈন্য রয়েছে। কিন্তু 'আরও সৈন্যের আগমন উত্তরাঞ্চলের অপারেশনাল জোনে, স্পষ্টভাবে বলতে গেলে কিয়েভে বারবার আক্রমণের হুমকি তৈরি করবে', বলেন নাইয়েভ।
রাশিয়ায় আংশিক সামরিক মুভমেন্ট স্বত্ত্বেও, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্সটিটিউট ফর দ্য স্টাডি অভ ওয়ার (আইএসডব্লিও) বিশ্বাস করে, বর্তমানে রাশিয়ান সামরিক বাহিনী উত্তর দিক থেকে ইউক্রেনকে আক্রমণ করতে অক্ষম।
গত শুক্রবার আইএসডব্লিও থেকে বলা হয়, 'রাশিয়ান সৈন্যরা ডনবাসের ছোট ছোট গ্রাম দখলের চেষ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে নিজেদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা হ্রাস করছে। তাদের উত্তর ইউক্রেনে বেলারুশের বহিরাক্রমণ সমর্থনের জন্য যুদ্ধোপোযোগী মেকানাইজড সৈন্যদল নেই।'
লুকাশেঙ্কো এই সংঘাতে খুব সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। নিজের সৈন্যদের না জড়িয়েই পুতিনের 'বিশেষ সামরিক অভিযান'কে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
গত সপ্তাহে তিনি বলেন, 'আমরা অংশ্রহণ করছি (অভিযানে)। এটি আমরা লুকাবো না। তবে আমরা কাউকে হত্যা করছিনা। নিজেদের সামরিক বাহিনীকে আমরা কোথাও পাঠাচ্ছিনা। আমাদের বাধ্যবাধকতাও আমরা লঙ্ঘন করছিনা।'
কিন্তু লুকাশেঙ্কোর রণকৌশল দুর্বল হয়ে পড়ছে। ২০২০ সালে তার বিতর্কিত পুনঃনির্বাচনের পরে যে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছিল তা তাকে রাশিয়ার প্রতি আরও বেশি নির্ভরশীল করেছে। এদিকে ক্রিমিয়া সেতুর বিস্ফোরণের পর রাশিয়ার জন্য
ইউক্রেনে জয়লাভ করা যেমন জরুরি হয়ে পড়েছে, পশ্চিমা মিত্ররাও বেলারুশকে হাত মেলানোর জন্য চাপে ফেলতে পারে।
তবে একইসাথে, লুকাশেঙ্কো তার সৈন্যদের ইউক্রেনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে চাইবেন, কারণ তার নিরাপত্তা বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়লে তিনি অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভের মুখে পড়তে পারেন।