যে ৫ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে কংগ্রেসের নতুন সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেকে
শশী থারুরকে হারিয়ে এবার কংগ্রেসের সভাপতিত্ব অর্জন করেছেন মল্লিকার্জুন খাড়গে। প্রায় ৭ হাজার ভোট পেয়ে তিনি এই আসনে বসছেন। গত ২৪ বছরে এই প্রথম গান্ধী পরিবারের বাইরে কেউ কংগ্রেসের সভাপতি পদে জয়ী হলো।
জয়ের পর মল্লিকার্জুন বলেন, "আমার সহযোগী শশী থারুরকে অভিনন্দন জানিয়েছি। আমি তার সঙ্গে দেখা করেছি। কীভাবে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, সে ব্যাপারে আলোচনা করেছি। সমস্ত কর্মীদের পক্ষে আমি সোনিয়া গান্ধীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তার নেতৃত্বে আমরা ফের সরকারে ফিরব।"
তবে সভাপতির পদে বসা ৮০ বছর বয়সী প্রবীণ নেতা মল্লিকার্জুনের সামনে রয়েছে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ।
কংগ্রেসকে নতুন করে সাজানোর চ্যালেঞ্জ
ভারতীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে পুরনো দল কংগ্রেস। পুরনো দল হিসেবে এর নিজস্ব পরিচালনা পদ্ধতি ও গতানুগতিক ধারা থাকলেও দলটিকে এখন তার আগের সেই 'গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি' ধাঁচে পরিবর্তন আনতে হবে। নতুন প্রজন্মের ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এবং তাদের মনের জায়গা পুনর্দখল করতে হলে কংগ্রেসকে অবশ্যই নতুন পথ খুঁজতে হবে; দিতে হবে নতুন কিছু। কেবল পুরনো দিনের জৌলুশ দেখিয়েই বিজয় অর্জনের পথ নিশ্চিত সম্ভব হবে না।
দলের রাজনৈতিক বার্তাগুলো হতে হবে অভিনব এবং তা দ্রুতই পৌঁছে দিতে হবে জনতার কাছে। কংগ্রেসের অনেক নেতাই মনে করেন, হিন্দুত্ববাদ, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সম্পর্কিত প্রশ্নগুলোর মতো অনেক আদর্শিক বিষয়েই কংগ্রেসের স্পষ্টতার অভাব রয়েছে। আর এসব ইস্যুতে দলের ভিতরেও দেখা দিচ্ছে বিভক্তি।
এদিকে কংগ্রেসের 'ভারত জোড়ো যাত্রা'র মূল ধারণাটিই হলো, দলকে সবার জন্য উন্মুক্ত করা, সবার মতামতের সমান গুরুত্ব দেওয়া। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গেল মাসে রাহুল গান্ধী ভারতের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, কর্মী, উদ্যোক্তা, দিনমজুর এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেছেন। এরপরেও তাদের কাছে কংগ্রেসের রাজনৈতিক বার্তা অস্পষ্টই রয়ে গেছে।
কংগ্রেস বরাবরই নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপের সমালোচনা করে আসছে। কিন্তু সরকারের সেসব পদক্ষেপের বিপরীতে বিকল্প অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের ধারণ তুলে ধরছে না। এটি দলের বড় একটি সীমাবদ্ধতা। এগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে কংগ্রেসকে।
নির্বাচনের ক্ষেত্রে খাড়গের প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ হবে তার নিজ রাজ্য কর্ণাটকে। গুজরাট এবং হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি; সময়ের অভাবে তিনি সেখানে খুব বেশিকিছু করতে পারবেন না। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে ১১টি রাজ্যে ভোট হবে এবং খাড়গের সামনে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হবে অন্তত বড় রাজ্যগুলোতে জয় লাভের জন্য দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
স্বাধীন নেতা নাকি গান্ধী পরিবারের প্রক্সি!
সভাপতির পদে জয়ী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেই চ্যালেঞ্জটি খাড়গের সামনে এসেছে তা হলো, সমর্থকদের তাৎক্ষণিক এই বার্তা দেওয়া যে, তিনি নেহেরু-গান্ধী পরিবারের প্রক্সি নন। যদিও খাড়গে নিজে এবং গান্ধী পরিবারও এই সত্য সম্পর্কে সচেতন। তারপরেও জনমনে যেনো এমন ধারণা না আসে যে, খাড়গেকে সামনে বসিয়ে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন অন্যকেউ। সিদ্ধান্তে এবং কাজে একজন স্বাধীন নেতা হিসেবে নিজেকে জনগণের সামনে উপস্থিত করা এখন নতুন সভাপতির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিরোধী জোট
অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের মতো খাড়গেও মনে করেন, কংগ্রেসের নেতৃত্বে কোনো বিরোধী দল থাকতে পারে না। কিন্তু সময় ও পরিস্থিতি বদলেছে। অনেক আঞ্চলিক দলই এখন ভারতের জাতীয় নির্বাচনে ভালো অবস্থানে থাকার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে এগোচ্ছে। খাড়গের সামনে চ্যালেঞ্জটি হবে প্রতীকীভাবে হলেও দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য মিটমাট করে ঐক্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করা।
এক্ষেত্রে তাকে একটি বড় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। আর তা হলো, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নীতীশ কুমারের মতো আঞ্চলিক নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এবং তাদেরকে নেতৃত্বের ভূমিকা দিয়ে কংগ্রেসের কি ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ) পুনর্গঠনের চেষ্টা করা উচিত? যেহেতু সোনিয়া গান্ধী এখন কার্যত বিলুপ্ত ইউপিএ'র চেয়ারপার্সন এবং গান্ধী পরিবারের সদস্যরা কংগ্রেসের সভাপতিত্ব ছেড়ে দিয়েছে।
খাড়গে একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। শরৎ পাওয়ার, মমতা ব্যানার্জি, এম কে স্টালিন, এবং নীতীশ কুমারের মতো আঞ্চলিক নেতাদের মোকাবেলায় তিনি নিঃসন্দেহেই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন।
সাংগঠনিক সংস্কার
খাড়গের সামনে আরেকটি বড় পরীক্ষা হবে সাংগঠনিক সংস্কার। এখানে মূল বিষয়টি হলো, তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির (সিডব্লিউসি) নির্বাচনের জন্য চাপ দেবেন কিনা। কংগ্রেসের সংবিধান অনুযায়ী, সিডব্লিউসি গঠিত হবে পার্টির সভাপতি, সংসদে কংগ্রেস পার্টির নেতা এবং ২৩ জন অন্যান্য সদস্য নিয়ে, যাদের মধ্যে ১২ জন সদস্যকে এআইসিসি নির্বাচিত করবে।
সিডব্লিউসি-তে নির্বাচনের মাধ্যমে এর সংসদীয় বোর্ড প্রক্রিয়ার পুনরুজ্জীবন এবং লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের জন্য একটি প্রকৃত কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটি গঠনই হলো জি-২৩ গ্রুপের প্রধান দাবি। এই দলের নেতারা থারুরকে বাদ দিয়ে সমর্থন দিয়েছেন খাড়গেকে।
এদিকে, খাড়গে জি-২৩-এর দাবি খারিজ করে দিয়েছিলেন আগেই। তাদের দাবিতে কোনো যৌক্তিকতা দেখেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাত্কারে বলেন, "এই ইস্যু শেষ … তারা সবাই আমাকে সমর্থন করছে। নিজেদের কাজ করছে। যখন ইস্যুটি শেষ হয়ে গেছে, তখন তা আবারও তোলা হচ্ছে কেন?"
এখন দেখার পালা, এসবের পরেও খাড়গে দলের মধ্যে কতটা ঐক্য ও শান্তি বজায় রাখতে পারেন।
প্রজন্মগত বিভাজনকে ঠেকানো
মল্লিকার্জুন খাড়গের সামনে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, দলের তরুণ ও প্রবীণদের মধ্যে ব্যবধান কমানো। ভারতের অনেক রাজ্যেই এখন তরুণ নেতা এবং তুলনামূলক প্রবীণ রাজনীতিবিদদের মধ্যে মতানৈক্য বা ফাটল দৃশ্যমান; বিশেষ করে রাজস্থানে যেখানে, এখন অশোক গেহলট এবং শচীন পাইলটের দ্বন্দ্ব চলছে।
শুধু রাজস্থানেই নয়- কেরালা, তেলেঙ্গানা, গোয়া, দিল্লি এবং পাঞ্জাবের মতো অনেক রাজ্যেই এমন দ্বন্দ্ব এখন দৃশ্যমান।
সভাপতিত্বের লড়াইয়ে শশী থারুর প্রার্থিতা অনেক তরুণ নেতাকেই উত্সাহিত করেছিল। দলের অনেকেই যে এখন পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন- এটি হয়তো তারই প্রমাণ। সুতরাং তরুণ নেতা এবং প্রবীণদের আকাঙ্ক্ষা মধ্যে মেলবন্ধন নিশ্চিত করা হবে খাড়গের সামনে আরেকটি নতুন চ্যালেঞ্জ।
- সূত্র: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস