যেভাবে লিওনেল মেসির ‘বেস্ত’ আবারো পশ্চিমা গণমাধ্যমের বর্ণবাদ প্রকাশ করেছে
গত রবিবার, সারা বিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে তাকিয়ে ছিল, যখন এক অসাধারণ টানটান উত্তেজনাকর ফাইনাল ম্যাচে ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্বজয় করে আর্জেন্টিনা।
তারপরেও সারাবিশ্ব যে চমৎকার ফুটবল উপভোগ করেছে, তাকে এড়িয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যম তাদের মূল নজর দিয়েছে কীভাবে কাতারের আমির আর্জেন্টিনার অধিনায়ক লিওনেল মেসিকে ঐতিহ্যবাহী আরব আলখেল্লা 'বেস্ত' পরিয়ে দিয়েছে।
বেশ কিছু টিভি উপস্থাপক এবং সাংবাদিকও সারা টুর্নামেন্টজুড়ে একই ধরনের বর্ণবাদ ও ইসলামোফোবিয়া প্রকাশ করেছেন। তবে তারা প্রমাণ করে পশ্চিমা 'আন্তর্জাতিক' গণমাধ্যমগুলোতে বৈচিত্র্যের কতটা অভাব, যে কারণে তারা পশ্চিমা স্টেরিওটাইপের বাইরে এসে অন্যকিছু চিন্তা করতে পারে না।
ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য টেলিগ্রাফ লিখেছে, 'এক অদ্ভুত কাজ যেটি বিশ্বকাপের সেরা মুহূর্তটি নষ্ট করে দিয়েছে।' ফক্স স্পোর্টসের ভাষায়, 'একেবারে নিষ্প্রভ', অন্যদিকে ইয়াহু স্পোর্টসের ভাষায়, 'অসম্মানজনক'।
সাংবাদিকদের মুখেও বর্ণবাদী মন্তব্য ছিল নিয়মিত। ইএসপিএন-এর এক প্রৌঢ় সাংবাদিক মার্ক ওগডেন লিখেছেন, "সবগুলো ছবি নষ্ট হয়ে গিয়েছে, যেখানে মনে হচ্ছে কেউ তাকে [মেসিকে] চুল কাটার জন্য আলখেল্লা পরিয়ে দিয়েছে।" অন্যদিকে ড্যান ওয়াকার নামে এক টেলিভিশন উপস্থাপক টুইট করে লিখেছেন, "আমি বাজি ধরতে পারি এমবাপ্পে ওই সোনালী কোনার অদ্ভুত আলখেল্লা পরা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পেরে খুশি," অর্থাৎ, তার মতে এরচেয়ে বিশ্বকাপ ফাইনাল হারা আরও ভালো।
বেস্ত হচ্ছে এমন এক ধরনের পোশাক যার মাধ্যমে সম্মান, প্রভাব, খ্যাতি, মর্যাদা, উচ্চ সামাজিক অবস্থান বোঝান হয়। কেবল বিশেষ অনুষ্ঠানেই এই বেস্ত পরা হয়, এবং পরতে পারে কেবল সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ ধর্মীয়, রাজনৈতিক অথবা গোত্রীয় নেতা, যার সাফল্যের খাতা ভরপুর।
বেস্ত পরার এই বিরল সম্মান, বিশেষ করে তা যদি কাতারের আমিরের মতো আরেকজন সম্মানিত ব্যক্তি পরিয়ে দেয়, তবে সেটি খুবই বিরল সম্মানের ব্যাপার। একে নাইটহুড বা মুকুট পরিয়ে দেওয়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। গত রবিবার, এটি পরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে লিওনেল মেসিকে সেই সম্মান, সেই মর্যাদাই দেওয়া হয়েছে, ফুটবল বিশ্বে তার অবদানের স্বীকৃতি জানাতে।
এই বিশ্বকাপ কেবল আর্জেন্টিনার বিজয় ছিল না। এটা একইসাথে অনেকের চোখেই মেসিকে স্থায়ীভাবে ফুটবলের 'গোট' (গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম) আসনে বসিয়ে দেয়। কেবল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সাথেই নয়, বরং পেলে এবং ম্যারাডোনার মতো খেলোয়াড়দের সাথেও বিতর্কের অবসান ঘটায়। এর মাধ্যমে মেসি জিতে ফেলেছেন ফুটবলের সবকিছু, যার মধ্যে রয়েছে সাতটি ব্যালন ডি'অর।
একজন ফুটবলারের সবচেয়ে বড় চাওয়া বিশ্বকাপ ট্রফি ছোঁয়া, দেশের হয়ে সবচেয়ে বড় শিরোপা জেতা। মেসিও বহুবার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার সবগুলো ব্যালন ডি'অরের বিনিময়ে হলেও তিনি একবার বিশ্বকাপ জিততে চান। তাই এটাই স্বাভাবিক ছিল যে মেসির এই চাওয়া স্টেজের কার্যকলাপের জন্য বাধাগ্রস্ত হয়েছে কিনা তা দেখা। তবে পশ্চিমা গণমাধ্যমের আসল মাথাব্যথা মেসি ছিল না, বরং বর্ণবাদ আর ওরিয়েন্টালিজমে ভরপুর পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভরপুর পশ্চিমা গণমাধ্যমের এটা স্বীকার করতে কষ্ট হচ্ছিলো যে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে উদযাপনের ভঙ্গি, পোশাক, সংস্কৃতি ভিন্ন হতে পারে।
বেস্ত পরার মুহূর্তে একবারও মেসিকে দেখা যায়নি বেস্ত পরাতে ভ্রূকুটি করেছেন কিংবা বিরক্ত হওয়ার মতো অঙ্গভঙ্গি করেছেন। তার আইকনিক ১০ নম্বর জার্সিও যে আলখেল্লার নিচে চাপা পড়েছে তা নয়।
বিজয়ী খেলোয়াড়দেরকে স্বাগতিক দেশের সংস্কৃতিগত উপহার কিংবা পোশাক দেওয়া নতুন কিছু নয়। ১৯৭০ মেক্সিকো বিশ্বকাপে ফাইনালের পর তিনবারের বিজয়ী পেলের মাথায় সমব্রেরো হ্যাট পরিয়ে দেওয়া হয়। পেলের মুহূর্ত কি হাইজ্য্যাক করা হয়েছিল, যেমনটি অস্ট্রেলিয়ার ৭ নিউজ মেসির ক্ষেত্রে দাবি করেছে?
যেদিন থেকে কাতারকে বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে সেদিন থেকেই পশ্চিমা গণমাধ্যম তাদের নাক উঁচু 'ইউরোসেন্ট্রিক' বর্ণবাদী মনোভাব দেখিয়ে এসেছে। মেসিকে বেস্ত পরিয়ে দেওয়ার পর তাদের সমালোচনা অজ্ঞতার শেষ আরেকটি প্রদর্শন।
মরক্কো জাতীয় ফুটবল দলের অসাধারণ বিশ্বকাপ যাত্রা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা আরব ও আফ্রিকানদের গর্ব বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। কেবল আরব বা আফ্রিকানরা নয়, অন্যান্য অঞ্চলের মানুষজনরা, যারা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কম উপস্থাপিত হন, কম গুরুত্ব পান, তারাও মরক্কোর সাথে একাত্ম হতে পেরেছেন। মরক্কোর খেলোয়াড়েরা উদযাপন করেছে নিজেদের সংস্কৃতি অনুযায়ীই। কিন্তু মরক্কোর ধারাবাহিক 'অঘটন'গুলোর পর পশ্চিমা গণমাধ্যম ধারাবাহিকভাবেই তাদের অজ্ঞতা এবং আরববিরোধী মনোভাব প্রকাশ করেছে।
সেমিফাইনালে হারার পর মরক্কোর খেলোয়াড়রা মাঠে সিজদা করেন, যেটি সারা আরব বিশ্ব এবং মুসলিমদের কাছে পরিচিত খোদার কাছে সমর্পণের চিহ্ন হিসেবে। কিন্তু ইএসপিএন এই মুহূর্তের ছবি পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখে, 'মরক্কর সমর্থকদের অভূতপূর্ব সমর্থনের জন্য মরক্কোর খেলোয়াড় এবং স্টাফরা তাদেরকে মাথা নত করে সম্মান জানাচ্ছেন!'
এক জার্মান গণমাধ্যম ভেল্ট আকাশের দিকে আঙুল উঁচু করে মরক্কোর খেলোয়াড়দেরকে উদযাপন করাকে তুলনা করেছে আইসিস যোদ্ধাদের সাথে। তবে মেসি যখন একই কাজ করে তখন অবশ্য কোনো পশ্চিমা গণমাধ্যম সে কাজ করে না। মরক্কোর খেলোয়াড়দের সাথে তাদের মায়ের উদযাপন আফ্রিকান ও আরব সংস্কৃতিতে পারিবারিক বন্ধন কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ সেটি বোঝায়। কিন্তু এক ড্যানিশ টেলিভিশন চ্যানেল উদযাপনরত মরোক্কানদের সাথে বানরের পরিবারের তুলনা করেছে।
পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর এই বর্ণবাদ, অজ্ঞতা এবং অযোগ্যতার কারণ তাদের নিউজরুমের বৈচিত্র্যহীনতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে কাজ করা ৪০ শতাংশ মানুষই অশ্বেতাঙ্গ। তবে রয়টার্সের এক জরিপে দেখা যায়, নীতিনির্ধারণী সম্পাদক পর্যায়ের ৯০ শতাংশই শ্বেতাঙ্গ। উচ্চ পর্যায়ে বৈচিত্র্য বাড়ানোর মাধ্যমে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো তাদের অজ্ঞতার পরিমাণ কমাতে পারে। তবে এজন্য আগে অশ্বেতাঙ্গ সাংবাদিকদের বাধাগুলো দূর করে তাদের ব্যর্থতা স্বীকার করতে হবে।
আরব বিশ্বে বেস্ত পরিহিত আর্জেন্টাইন অধিনায়ককে আরব জনগণ অভিহিত করছে 'শেখ মেসি' হিসেবে। এবং এটি সম্মান করেই। এই সম্মান, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসাকে বর্ণবাদী আক্রমণ করে দূষিত করার প্রয়োজন নেই।
সূত্র: আল জাজিরা /আহমেদ ত্বোয়াইজ