মোদির ‘রকফেলার’ আদানি হিন্ডেনবার্গের সঙ্গে লড়াইয়ে ৭১ বিলিয়ন ডলার হারালেন
ভারতের প্রভাবশালী ধনকুবের গৌতম আদানির সুসময়ে ভাটা পড়েছে হঠাৎ করেই। অথচ গত বছরেই তিনি বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনকুবের ছিলেন। তার বিত্ত পতনের সূত্রপাত হয় গত বুধবার। এদিন আদানি শিল্পগোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর শেয়ারমূল্যের শর্ট পজিশন প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ। আর্থিকখাতের ফরেনসিক গবেষণা/ তদন্তকারী এ সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে জানায়, আদানি গ্রুপের শেয়ারমূল্য হিসাবরক্ষণের জালিয়াতি ও বিভিন্ন সূক্ষ্ম কৌশলের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্লুমবার্গ ও ফিন্যান্সিয়াল টাইমস অবলম্বনে।
পুঁজিবাজারে শর্ট পজিশন হলো- স্বল্পমেয়াদে কোনো কোম্পানির শেয়ার কতখানি কমবে তা নির্ধারণের কৌশল। সাধারণত আগামী কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহের জন্য এটা নিরূপণ করা হয়।
হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনের পর থেকেই সুবৃহৎ এ শিল্পগোষ্ঠীর বন্ড ও শেয়ারমূল্যে ধস নেমেছে।
প্রতিবেদনে ব্যাপক কর্পোরেট অসাধুতার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা খণ্ডনে ৪১৩ পাতার একটি ব্যাখ্যা প্রকাশ করেছেন গৌতম আদানি। উদ্দেশ্য একটাই, বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ দূর করা, যাতে তারা শেয়ার বিক্রির হিড়িক থামান।
কিন্তু, তার এ প্রচেষ্টাও কার্যত ব্যর্থ হচ্ছে। আস্থা ফেরাতে পারছেন না বিনিয়োগকারীদের। শেয়ারের বাজারমূল্য হারাতে থাকায় ও ডলার-ভিত্তিক বন্ডের ধসে তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য এখন খাড়া পতনের মুখে।
সোমবারেও (৩০ জানুয়ারি) পুঁজিবাজারে এই ধস অব্যাহত ছিল। সবশেষ পাওয়া সংবাদ অনুসারে, ইতোমধ্যেই আদানি গ্রুপের বাজারমূল্য থেকে ৭১ বিলিয়ন ডলার কর্পূরের মতই যেন উবে গেছে। এতে বিশ্বের সেরা ধনীদের সাথে প্রতিযোগিতার স্বপ্নে বাধাই পড়লো আদানির।
তাছাড়া, দীর্ঘদিন ধরে আদানি গ্রুপের কর্পোরেট সুশাসন নিয়ে বিনিয়োগকারীদের যে উদ্বেগ চাপা পড়ে ছিল, তার আগুনেও যেন ঘি ঢালা হয়েছে। তবে আদানি গ্রুপ দাবি করছে, হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যাচার, এবং সার্বিকভাবে ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ।
এমন সময় এ ঘটনা ঘটছে যখন চীন তার অর্থনীতির দ্বার আবার খুলে দিচ্ছে। সেখানে ব্যবসাবাণিজ্যের সুহাল আশা করে ছুটতে পারেন বিনিয়োগকারীরা। অথচ হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের আগপর্যন্ত ভারতই ছিল ওয়ালস্ট্রিট-সহ পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের শীর্ষ গন্তব্য।
মোদির রকফেলার
গৌতম আদানি তার শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনকে সার্বিকঅর্থে যেভাবে ভারতের অর্থনীতির বিরুদ্ধে আক্রমণ বলেছেন, তার মধ্যেই আছে প্রভাবের ইঙ্গিত। আদানি বলেন, 'এটা নির্দিষ্ট কোনো কোম্পানির বিরুদ্ধে অনাকাঙ্ক্ষিত হামলার ঘটনা হয়, এটা ভারতের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের মান, অর্থনৈতিক বিকাশের ধারা ও উচ্চকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত আক্রমণ'।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি- বিজেপির সাথে তার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তার উত্থানের পেছনেও বিজেপির অবদান আছে বলে জানা যায়।
ইতঃপূর্বে প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের (এফটি) এক প্রতিবেদনে তাকে বলা হয়, নরেন্দ্র মোদির রকফেলার। প্রতিবেদনটি আদানির সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতার সংযোগও তুলে ধরে।
জন ডাভিসন রকফেলার ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম শতকোটিপতি, বা বিলিয়নিয়ার। ২০২০ সাল নাগাদ মূল্যস্ফীতির হিসাব করে তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০ হাজার কোটি ডলার। আজকের দিনে কোনো ধনীর অঢেল বিত্ত-প্রতিপত্তি বোঝাতে হলে তাকে রকফেলারের সাথে তুলনা করা হয়।
রকফেলার নিজের চেষ্টায় গড়ে তুলেছিলেন ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য। আদানিও উদ্যমী, কিন্তু একইসঙ্গে ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদধন্য।
অতীত ও বর্তমানে অনেক ঘটনাই তার সাক্ষ্য। ২০১৮ সালের এক ঘটনাই বলা যাক। এসময় ছয়টি বেসরকারি বিমানবন্দর পরিচালনার ভার বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় মোদি সরকার। প্রতিযোগিতা বাড়াতে নিলামে অংশ নেওয়ার বিধিও শিথিল করা হয়, যাতে অভিজ্ঞতা নেই এমন কোম্পানিগুলো দর দিতে পারে। নিয়মের এই পরিবর্তন থেকে জয়ী হন কেবল একজন: গৌতম আদানি, বিলিয়নিয়ার এ শিল্পপতি পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার পরও ছয়টি বিমানবন্দরই পরিচালনার অধিকার লাভ করেন।
সবগুলো বিমানবন্দরের লিজ আদানি গ্রুপ পাওয়ায় দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কেরালার ত্রিভান্দ্রম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও ছিল এর মধ্যে।
৫০ বছরের জন্য এই বিমানবন্দর আদানিকে লিজ দেওয়া হয়। কেরালার অর্থমন্ত্রী এপ্রসঙ্গে বলেন, রাজনৈতিক সখ্যতা থাকা ধনকুবেরদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার আবারো তা প্রমাণ করলো। তিনি এই ঘটনাকে 'নির্লজ্জ গোষ্ঠীপ্রীতির উদাহরণ' বলে উল্লেখ করেন। অবশ্য সেসময় কেন্দ্রীয় সরকারের বিমানমন্ত্রী বলেছিলেন, নিলাম প্রক্রিয়ায় 'সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা' অবলম্বন করা হয়েছে।
এভাবে রাতারাতি ভারতের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি বিমানবন্দর পরিচালনাকারী হয়ে ওঠেন আদানি। ভারতের সবচেয়ে বেশি বেসরকারি সমুদ্রবন্দর পরিচালনার অধিকারও তার হাতে। তিনি দেশটির শীর্ষ কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদক কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করেন। ভারতের ক্রমবর্ধমান গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিতরণ বাজারেও তার কোম্পানিগুলোর দখল বাড়ছে। ইতঃপূর্বে তিনি সবুজ জ্বালানি উৎপাদনে বিপুল বিনিয়োগের ঘোষণাও দেন।
স্বদেশি মুকেশ আম্বানির পাশাপাশি গৌতম আদানি বর্তমানে ভারতের অন্যতম আলোচিত ধনকুবের। ২০১৪ সালে বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই যার উত্থান হয়েছে অবিশ্বাস্য গতিতে। মোদি ও আম্বানির মতো আদানিও গুজরাটের অধিবাসী। গুজরাটে তিনি মোদি ও বিজেপির অন্যতম সমর্থক ছিলেন। আর দল কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর এই ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়েছে।
মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর, আদানির প্রাইভেট জেটে চড়েই দায়িত্বগ্রহণের জন্য নয়াদিল্লি যান মোদি। তাদের বন্ধুত্বের স্পষ্ট নিদর্শন ছিল এ ঘটনা। এফটির প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২০ সাল নাগাদ আদানির সম্পদ ২৩০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলারে। সরকারি অনেক দরপত্র জেতা এবং দেশজুরে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের সুবাদেই উত্থান ঘটছিল তার।
এই উত্থান গত বছর পর্যন্তও অব্যাহত থাকায়, এক পর্যায়ে তিনি বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী হয়ে ওঠেন। তবে শেয়ারমূল্যে সাম্প্রতিক ধসের কারণে তিনি ফোর্বসের বিলিয়নিয়ার তালিকায় আর শীর্ষ পাঁচে নেই, নেমে এসেছেন সাত নম্বরে। তারপরও ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত তার মোট সম্পদমূল্য ৯২.৭ বিলিয়ন ডলার থাকার কথা জানা গেছে ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স সূত্রে।
সরকারি নীতির হাত ধরেই সম্পদের এই স্ফীতি আদানির। তার অবকাঠামো নির্মাণ ব্যবসার সাথে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের রয়েছে দারুণ মিল। মোদি দেশজুড়ে অবকাঠামো নির্মাণকে প্রাধান্য দিচ্ছেন, ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জন করার বিষয়েও উদ্যমী তিনি। যেখানে কয়লা বিদ্যুৎ পাচ্ছে প্রাধান্য।
২০২০ সালে করোনা মহামারি ভারতের অর্থনীতিতে ব্যাপক দুর্দশা সৃষ্টি করে। মহামারির এ অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে বেসরকারিকরণের উদ্যোগ আরো জোরালো করে সরকার। এসময় ফুলেফেঁপে উঠছিল আদানির ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য, এবং এই ঘটনা ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বঞ্চিত করে ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ জনাকয়েক ধনকুবেরের হাতে অধিকাংশ সম্পদ তুলে দেওয়ার ঘটনা বলে জোর সমালোচনার জন্ম দেয়।
তবে কারো কারো মতে, পারিবারিকভাবে চালিত বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাশীল করে তোলার মাধ্যমে ভারতের অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। যেমনটা এক সময় দক্ষিণ কোরিয়ায় করা হয়েছিল। কিন্তু, সমালোচকরা বলছেন, গুটিকয় ব্যক্তির হাতে এভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ তুলে দেওয়ায় বাজারে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি হচ্ছে, কমছে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের টিকে থাকার ক্ষমতা।
দিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সরকারি নীতি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক রোহিত চন্দ্র বলেন, 'ভারত কি পূর্ব এশিয়া (দ. কোরিয়া) মডেলের দিকে এগোচ্ছে, না রাশিয়ান মডেলের দিকে? এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে শেষোক্ত পথটিই অনুসরণ করা হচ্ছে। সম্পদের এই পুঞ্জিভূতকরণ দীর্ঘমেয়াদে ভারতীয় ভোক্তাদের উপকৃত করবে কিনা– সেটাও স্পষ্ট নয়'।
বিংশ শতকের গোড়ার দিকে অতি-ধনীদের উত্থান যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষে নিয়ে আসে। এসময় জন ডাভিসন রকফেলারের মতো ধনীরা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। আবার ১৯৯০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরেও রাজনৈতিক আনুকুল্যে থাকা প্রভাবশালীরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ লাভ করে ধনকুবের হয়ে ওঠেন। কিন্তু, তাতে রাশিয়ার শিল্পোন্নয়ন সেভাবে হয়নি। ধনীরা বরং বিপুল সম্পদ আত্মসাৎ করেছেন। তাই ভারতের এই শিল্পোন্নয়নের নীতি দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো সমৃদ্ধির পথে নেবে, নাকি রাশিয়ার দিকে- সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে রাজনৈতিক যোগাযোগ কাজে লাগানোর মাধ্যমে গৌতম আদানি যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিঃসন্দেহে তিনি দেশটির অর্থনীতিতে আগামী দিনে আরও কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করবেন।
অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক জ্বালানি বিশ্লেষক টিম বাকলি বলেন, 'গৌতম আদানি খুবই ক্ষমতাধর একজন ব্যক্তিত্ব, তার রাজনৈতিক সংযোগও দৃঢ়, আর এই ক্ষমতা সঠিকভাবে কাজে লাগাতেও সাবলীল তিনি। গৌতম-ই হলেন মোদির রকফেলার'।