চীন থেকে আমেরিকার বিশাল আকাশে: যে বেলুন নাড়িয়ে দিয়েছে হোয়াইট হাউজকে
স্টারগেজিং বা আকাশ পর্যবেক্ষণ মনটানায় অস্বাভাবিক কিছু নয়, যেখানে উন্মুক্ত আকাশ সর্বত্র। তবে চেজ ডোয়াক নামের এক ব্যক্তি যখন গত বুধবার কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করেন, তখন তিনি আকাশে এক রহস্যময় সাদা গোলাকার বস্তু দেখতে পান, যেটি স্পষ্টই চাঁদ বা অন্য কোনো নক্ষত্র নয়।
চেজ ভাসমান বস্তুটির ফুটেজ নেওয়া শুরু করেন। মনটানার বিলিংস শহরের বাসিন্দাদের চোখের সামনে অদ্ভুত যে জিনিসটি ঘোরাফেরা করছিলো তার পরিচয় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই জানা হয়ে যায়। সেটি আর কিছুই নয়, একটি চীনা বেলুন, যেটিকে সন্দেহ করা হচ্ছে সার্ভেইল্যান্সের কাজে ব্যবহৃত হওয়া বিশেষ বেলুন হিসেবে।
টুইটারে ভাইরাল হওয়া ভিডিওর ক্যাপশনে চেজ লেখেন, "আমি মিথ্যা বলবো না। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম এটা কোনো ইউএফও। তারপর আমার মনে হলো এটা এলন মাস্ক আর তার উইজার্ড অফ ওজের কসপ্লে। কিন্তু আসলে এটা চীনা স্পাই বেলুনের একটি!"
মহাসাগর পাড়ি দেওয়া এই বেলুনটি ইতিমধ্যেই পুরো বিশ্বের নজর কেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কূটনীতিককে তার বেইজিং সফর মুলতবি রাখতে বাধ্য করেছে এটি। ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ মাইল ওপরে থাকা এই বেলুনটির ভাগ্য অবশ্য এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। দুই পরাশক্তিও নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও চাপা উত্তেজনা কমিয়ে টেবিলে বসতে চাইছে।
সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের চীন সফর এবং প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে সাক্ষাতের ঠিক আগমুহূর্তে এই চীনা বেলুনের আগমন এবং সেটিকে ফাটিয়ে দেওয়ার কূটনীতি নিয়ে আলোচনা চলছে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে। নাম গোপন রাখার শর্তে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার কাছ থেকে বেলুন ও সফর সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানা যায়।
তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে ঢুকে পড়া এই বেলুন সম্পর্কে জানুয়ারির ২৮ তারিখ থেকেই জানতো মার্কিন কর্তৃপক্ষ। বেলুনটি এরপর যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড থেকে বেরিয়ে পুনরায় একই দিনে আইডাহোর উত্তর সীমান্ত থেকে প্রবেশ করে। তবে ব্লিঙ্কেনের বিশাল সফর সামনে থাকায় এই সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ করেনি তারা।
মনটানা থেকে বেলুনটি যখন মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়, ততক্ষণে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বেলুনটি সম্পর্কে জেনে গিয়েছেন। হোয়াইট হাউজও চিন্তা-ভাবনা করছে বেলুনটিকে আকাশেই ফাটিয়ে দেওয়া হবে কিনা সেটি নিয়ে।
তবে এই বেলুন নিয়ে এত তোলপাড় হওয়ার আরেকটি কারণ মনটানায় থাকা মালমস্ট্রম বিমান ঘাঁটি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মিনিটম্যান ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইলের বড় একটি অংশ রয়েছে।
বাইডেন প্রশাসন জানে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে তাদেরকে খুবই সতর্কভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রিপাবলিকান পার্টি ও চীনকে দুইদিক থেকেই সামলাতে হবে।
বুধবার বাইডেন তার জাতীয় নিরাপত্তা দলের সাথে বেলুনটি নিয়ে বিশেষ বৈঠকে বসেছে। প্রেসিডেন্ট বেলুনটিকে আক্রমণ করে নিচে নামিয়ে আনতে চাইলেও উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা সেটি না করার পরামর্শ দিয়েছেন।
সেক্রেটারি অফ ডিফেন্স লয়েড অস্টিন এবং জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ মার্ক এ. মিলি জানিয়েছেন যে, সে ধরনের কিছু হলে বেসামরিক ব্যক্তিরা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
প্রেসিডেন্ট এরপর বেলুনটিকে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে ঊড়তে থাকার অনুমতি দিয়েছেন। ওয়াশিংটনে থাকা চীনের দূতাবাস থেকে বেলুনটির ব্যাপারে উত্তর চাইলেও সন্তুষ্ট হওয়ার মতো কোনো জবাব পাননি তারা। মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের কাছে মনে হয়েছে চীনের দূতাবাসের লোকজনও এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে।
তখনো পর্যন্ত হোয়াইট হাউজ মার্কিন জনসাধারণকে সরকারিভাবে এ ব্যাপারে জানানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তবে ঘটনা যেদিকে মোড় নিয়েছিল, তাতে খুব দ্রুতই বাইডেনের হাত থেকে এর নিয়ন্ত্রণ সরে গিয়েছিল।
বৃহস্পতিবার বিকেলে মনটানার স্থানীয় পত্রিকা দ্য বিলিংস গ্যাজেট বেলুনের একটি ছবি প্রকাশ করে। যার অর্থ খুব দ্রুতই জাতীয় পত্রিকাগুলো এ ব্যাপারে প্রশ্ন করবে এবং বাইডেন প্রশাসনকে এ ব্যাপারে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। হোয়াইট হাউজও বেলুন নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আলোচনা চালিয়েছিল।
অবশেষে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫:১৫তে কর্তৃপক্ষ জনসাধারণকে এ ব্যাপারে অফিশিয়াল বিবৃতি দেয়। বাইডেন প্রশাসন আগামী সপ্তাহে 'গ্যাং অফ এইট'-এর সাথে একটি বৈঠকে বসবে। এর মধ্যে রয়েছে আইনপ্রণেতাদের চেয়ারপারসনসহ হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস এবং সিনেটের ইন্টেলিজেন্স কমিটির উচ্চপদস্থ সদস্যরা।
পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম নয়, বরং গত কয়েক বছরে এ ধরনের ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটেছে, যার মধ্যে ট্রাম্পের শাসনামলও রয়েছে।
পেন্টাগনের এই ঘোষণা রিপাবলিকানদের মধ্যে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল ওয়েবসাইটে লিখেছেন 'শ্যুট ডাউন দ্য বেলুন'। সাবেক সেক্রেটারি অফ স্টেট মাইক পম্পেও থেকে শুরু করে রিপ্রেজেন্টেটিভ টেইলর গ্রিন পর্যন্ত অন্যান্য রিপাবলিকান নেতারা মতামত দিয়েছেন এখনো বেলুনটিকে নিচে নামানো বাইডেন প্রশাসনের দুর্বলতার চিহ্ন।
তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে চীন কীভাবে এই দ্রুতগতিতে চলতে থাকা ঘটনাগুলোর উত্তর দিয়েছে?
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রকে এ বিষয়ে 'উচ্চবাচ্য' করতে নিষেধ করার পর চীন অবশেষে শুক্রবার সকালে সরাসরি বিবৃতি দিয়ে বলেছে এ বিষয়ে তাদের কোনো হাত নেই এবং এটি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। চীনের বিবৃতি অনুযায়ী, বেলুনটি দুর্ঘটনাক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় ঢুকে পড়েছে এবং বেলুনটির উদ্দেশ্য হলো জলবায়ু গবেষণা।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাবেক মার্কিন ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষকরাও বেইজিংয়ের এই ব্যাখ্যা নিয়ে সন্তুষ্ট নন। চীনের এই সরকারি বিবৃতিকে তারা তুলনা করেছেন এরিয়াল এস্পায়োনেজের জন্য পুরনো হয়ে যাওয়া অজুহাতের সাথে।
পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য সিআইএ-র সাবেক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ডেনিস ওয়াইল্ডার মন্তব্য করেন, "আমি জানি না কেউ আবহাওয়া গবেষণার জন্য তিনটি স্কুলের বাসের সমান বেলুন বানাতে পারে।"
এদিকে মার্কিন কর্মকর্তারা বিতর্ক করছেন ব্লিঙ্কেনের কি দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করা চীন সফর বাতিল করা হবে কি না সেটি নিয়ে। কারণ গত পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো উচ্চ-পর্যায়ের মার্কিন কর্মকর্তার প্রথম চীন সফর এটি। তবে এই মুহূর্তে তারা কিছুদিনের জন্য সফর মুলতবি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মাধ্যমে মার্কিনরা সংকেত দিলো যে এই মুহূর্তে বাড়তি কোনো উত্তেজনার দিকে পা বাড়াতে চাইছে না তারা।
অনেকেই মনে করছেন এই সফরের ফলে ঘরের রাজনৈতিক মাঠে যে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে, সে তুলনায় ব্লিঙ্কেনের সফর খুব বেশি ফলপ্রসূ হবে না।
বাইডেন প্রশাসনের অনেকেই মনে করছেন এই সফর 'বাইডেন প্রশাসনের চীনের প্রতি দুর্বলতা রয়েছে বিশ্বাস করা' রিপাবলিকানদের জন্য আরও ভালো কিছু বয়ে আনবে, যদি ব্লিঙ্কেনের সফরের সময়েই বেলুনটি ক্র্যাশ করে করে কোনো ব্যক্তিকে আহত করে।
জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের এক সাবেক ডিরেক্টর রায়ান হাস মন্তব্য করেন, "যুক্তরাষ্ট্রের ওপরে ভাসতে থাকা বেলুন নিয়ে বিতর্ক চলাকালীন এই সময়ে ব্লিঙ্কেনের বেইজিংয়ে অবস্থান যুক্তিযুক্ত নয়।"
এদিকে বেলুনটি পূর্বদিকে সরে ওয়াশিংটনের দিকে আসছে। সাবেক সিআইএ অফিসার ওয়াইল্ডার জানান, "বেলুনটি অন্য কোথাও যাচ্ছে না।" তার মতে, মূল সমস্যাটি হচ্ছে চীনের কাছে তাদের এই বেলুনটি নিয়ে সরে যাওয়ার উপায় নেই, তাই এটি যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের ওপরেই অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত উড়তেই থাকবে।
ততদিন পর্যন্ত, আমেরিকান নাগরিকেরা বেলুনটির ছবি তুলতে থাকবে। আর বাইডেনকে এই বেলুনটিকে ভাসতে দেওয়ার জন্য যুক্তি খাড়া করতে থাকতে হবে।
সূত্র: ব্লুমবার্গ