চীনা বেলুন: আটলান্টিকের ওপর ভূপাতিত করল আমেরিকা
যুক্তরাষ্ট্রের আকাশজুড়ে যে দৈত্যাকার চীনা বেলুনটি ঘোরাফেরা করছিলো এবং মার্কিনদের দাবি অনুযায়ী আমেরিকার ভূখণ্ডের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনার ওপর যেটি গুপ্তচরবৃত্তি চালাচ্ছিলো, সেই বেলুনটিকে মিসাইল ছুঁড়ে নামিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী।
প্রতিরক্ষা বিভাগ নিশ্চিত করেছে যে তারা ফাইটার জেট ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের জলসীমায় বেলুনটি নামিয়েছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরে "বেসামরিক চালকবিহীন বিমানে হামলার জন্য মার্কিনদের শক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ ও প্রতিবাদ" প্রকাশ করেছে।
মার্কিন টিভি নেটওয়ার্কের ফুটেজে দেখা গিয়েছে একটি ছোট বিস্ফোরণের পর বেলুনটি সমুদ্র লক্ষ্য করে পড়ে যাচ্ছে।
একজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, একটি এফ-২২ জেট ফাইটার থেকে একটি এআইএম-নাইনএক্স সাইডউইন্ডার মিসাইল হাই-অলটিচিউড বেলুনটিকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়। ১৯:৩৯ জিএমটি সময়ে মার্কিন উপকূল থেকে ছয় নটিক্যাল মাইল দূরে বেলুনটি ক্র্যাশ ল্যান্ড করে।
প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা মার্কিন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে বেলুনের অবশিষ্টাংশটি সাউথ ক্যারোলিনার মার্টল বিচের কাছে সমুদ্রের ১৪ মিটার গভীর পানিতে অবতরণ করেছে, যা তাদের প্রত্যাশার চেয়েও অগভীর।
সামরিক বাহিনী এখন ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারের চেষ্টা করছে, সমুদ্রের ১১ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। বেলুনটি উদ্ধারের জন্য একটি ভারি ক্রেন সহ দুটি নৌবাহিনীর জাহাজ এলাকাটিতে রয়েছে।
পেন্টাগনের এক বিবৃতিতে একজন ঊর্ধ্বতন মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন যে, "যদিও আমরা চীনের এই নজরদারি বেলুন যাতে সংবেদনশীল তথ্য সংগ্রহ করতে না পারে তা থেকে সুরক্ষার জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছিলাম, তারপরও মার্কিন ভূখণ্ডে এই নজরদারি বেলুনের ইন্টেলিজেন্স ভ্যালু আমাদের কাছে রয়েছে।"
"আমরা বেলুন এবং এর যন্ত্রপাতিগুলো যাচাই ও গবেষণা করতে সক্ষম হয়েছি, যা বেশ মূল্যবান ছিল," বলে যোগ করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা বেলুনটির তথ্য প্রথম ঘোষণা করার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বেলুনটিকে নামানোর জন্য চাপের মধ্যে ছিলেন।
বেলুনটি গুলি করার পরে বাইডেন বলেছেন: "তারা সফলভাবে কাজটি সম্পন্ন করেছে, এবং আমি এজন্য আমাদের বিমানচালকদের অভিনন্দন জানাতে চাই ।"
এর কয়েক ঘন্টা পরে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিবৃতিতে জানানো হয়, "চীনারা যাচাই করার পর বারবার মার্কিনদেরকে জানিয়েছে যে বিমানটি বেসামরিক ব্যবহারের জন্য ব্যবহার করা হয়, মার্কিন ভূখণ্ডে প্রবেশের কোনো ইচ্ছা তাদের ছিল না। এটা সম্পূর্ণ একটি দুর্ঘটনা ছিল।"
বেলুনটিকে মার্কিন ভূখণ্ডে আবিষ্কার করার পর দুই দেশের মধ্যে একটি কূটনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে। চীনের এই 'দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের' জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন অবিলম্বে এই সপ্তাহের শেষে তার চীন সফর বাতিল করেছেন।
চীনা কর্তৃপক্ষ বেলুনটিকে স্পাইং বেলুন হিসেবে অস্বীকার করেছে এবং তাদের দাবি অনুযায়ী বেলুনটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হতো।
এই ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তাইওয়ানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে: "চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সরকারের কার্যকলাপ একটি সভ্য আন্তর্জাতিক কমিউনিটির সাথে মানানসই নয়, যারা আন্তর্জাতিক আইন এবং অন্যান্য দেশের আকাশসীমা ও সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে।"
প্রেসিডেন্ট বাইডেন বুধবার বেলুনটিকে নামানোর পরিকল্পনা প্রথমে অনুমোদন করলেও পেন্টাগনের পরামর্শ অনুযায়ী সেটিকে সমুদ্রের ওপর না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে মানুষকে অযাচিত ঝুঁকিতে না ফেলা হয়।
বেলুনটিকে নামানোর উদ্যোগ নেওয়ার জন্য প্রথমে ইউএস ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন শনিবার বিকালে দক্ষিণ ক্যারোলিনা উপকূলের আশেপাশে থাকা তিনটি বিমানবন্দরের সমস্ত বেসামরিক ফ্লাইট সংক্ষিপ্তভাবে থামিয়ে দেয়। কোস্ট গার্ডও সামরিক অভিযানের কারণে নাবিকদের এলাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
হেইলি ওয়ালশ নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসি নিউজকে জানান, তিনি মিসাইলটি নিক্ষেপের আগে তিনটি ফাইটার জেটকে বেলুনটিকে লক্ষ্য করে চক্কর দিতে দেখেছেন: তারপর "আমরা একটি প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পেলাম, আমাদের বাড়িটি কেঁপে উঠেছিল"।
একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেছেন যে, বেলুনটির ধ্বংসাবশেষ পুনরুদ্ধার করা 'কিছুটা সহজ' হওয়া উচিত এবং 'তুলনামূলক কম সময়' নিতে পারে। তিনি আরও যোগ করে জানান, অপারেশনে সহায়তা করার জন্য 'নৌবাহিনীর ডুবুরি' মোতায়েন করা যেতে পারে।
প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা শনিবার বেলুনটির গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করেন। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বেলুনটি প্রথম জানুয়ারির ২৮ তারিখ অ্যালেউটিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় প্রবেশ করে। তিন দিন পরে কানাডিয়ান আকাশসীমায় প্রবেশ করে ৩১ জানুয়ারি পুনরায় মার্কিন আকাশসীমায় ঢুকে পড়ে। এরপর বেলুনটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানা রাজ্যে দেখা যায়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি সংবেদনশীল পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষিত আছে।
পেন্টাগন একে মার্কিন সার্বভৌমত্বের 'অগ্রহণযোগ্য লঙ্ঘন' বলে অভিহিত করে। এই ঘটনায় চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে।
৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার শীর্ষ কূটনীতিক ব্লিঙ্কেন তার সফর মুলতবি ঘোষণার আগে বেইজিংকে 'দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ' করার দায়ে অভিযুক্ত করেন। কয়েক বছরের মধ্যে এই প্রথম বেইজিংয়ে দুই দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হবে।
এদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালযয়ের দাবি অনুযায়ী, বেইজিং 'কোনো ভিত্তিহীন অনুমান গ্রহণ করবে না' এবং 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনীতিবিদ এবং গণমাধ্যম' এই ঘটনাটিকে 'চীনকে আক্রমণ ও বদনাম করার অজুহাত হিসাবে' ব্যবহার করার জন্য অভিযুক্ত করেছে।
গত শুক্রবার, ল্যাটিন আমেরিকার কোস্টারিকা এবং ভেনিজুয়েলার ওপর আরেকটি চীনা বেলুন দেখা গিয়েছে বলে জানিয়েছে পেন্টাগন।
কলম্বিয়ার বিমান বাহিনী জানায় ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখ দেশটির আকাশসীমায়, ভূমি থেকে ৫৫ হাজার ফুট ওপরে একটি বস্তু শনাক্ত করা হয়েছে, যেটিকে দেখে বেলুন বলেই মনে হয়েছে। আকাশসীমা ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত বেলুনটিকে তারা অনুসরণ করে এবং জানায় যে এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকির নয়। দ্বিতীয় বেলুনটি নিয়ে চীন এখনো প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেনি।
সূত্র: বিবিসি