চাঁদের সাথে দক্ষিণ চীন সাগরের মিল কোনখানে?
চন্দ্রাভিযান পরিকল্পনার আরো বিবরণ প্রকাশ করছে চীন। এশীয় পরাশক্তিটি চলতি দশকের শেষ নাগাদ চাঁদে নভোচারী পাঠাতেও চায়। বেইজিংয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা মানেই যুক্তরাষ্ট্রে দুশ্চিন্তার ঝড়; মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, চীনের এই চন্দ্রজয়ের দৌড় আসলে চাঁদের সম্পদ ও এলাকা দখলেরই পায়তাঁরা। 'চীনের সামরিক বাহিনী ইতোমধ্যে পৃথিবীতে এমন কাজই করছে, যেমন দক্ষিণ চীন সাগরে ঘাঁটি গড়ে তুলে এর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে'। এশিয়া টাইমস অবলম্বনে
এসব কথা যেনতেন কারো নয়। বরং মার্কিন গণমাধ্যম পলিটিকোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দেশটির মহাকাশ সংস্থা– ইউএস ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা)'র প্রশাসক বিল নেলসন।
নেলসন বলেন, 'এটাই বাস্তবতা: আমরা একটি মহাকাশ প্রতিযোগিতায় রয়েছি। বৈজ্ঞানিক গবেষণার ছদ্মবেশে চীনারা যদি আমাদের আগে চাঁদের কোথাও যায়, বলা যায় না- হয়তো তারা বলবে, এই এলাকা আমাদের, এখান থেকে দূরে থাক। এনিয়ে যদি কারো সন্দেহ থাকে, তাহলে তিনি স্পার্টলি দ্বীপপুঞ্জের (দক্ষিণ চীন সাগরে) বর্তমান অবস্থার দিকে তাকাতে পারেন'।
পলিটিকো যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ নীতি-নির্ধারক মহলের অন্য কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তারও একই মনোভাব তুলে ধরে।
তবে এসব মন্তব্যকে 'দায়িত্বজ্ঞানহীন' বলে সমালোচনা করেছেন ওয়াশিংটনে চীনা দূতাবাসের মুখপাত্র লিউ পেংগিউ। তিনি বলেন, 'ভূমন্ডলের বাইরের মহাকাশ কোনো কুস্তি লড়ার আখড়া নয়। মহাকাশ অভিযান এবং এর শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহার মানবজাতির মিলিত প্রয়াস, যা সকলকে উপকৃত করে। চীন সব সময় মহাকাশের শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের পক্ষে, মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিরোধিতা করে এবং তার সামরিকায়নের বিপক্ষে। মহাকাশে সমগ্র মানবজাতির এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের লক্ষ্যে চীন সক্রিয়ভাবে কাজ করছে'।
প্রতিযোগিতার উচ্চতা
লিউ চীনের মহাকাশ কর্মসূচিকে 'স্বাভাবিক ও ন্যায্য মহাকাশ প্রচেষ্টা' বলে উল্লেখ করেছেন। এরমধ্যে রয়েছে ২০২৮ সাল নাগাদ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে একটি গবেষণা ঘাঁটি নির্মাণ এবং রিমোট-কন্ট্রোল যানের মাধ্যমে সেখানে পানির অনুসন্ধান।
চীনের সাথে তাল মেলাতে ২০২৫ সাল নাগাদ চাঁদে মহাকাশ অভিযাত্রী পাঠাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে সবশেষ ১৯৭২ সালে চাঁদে যান মার্কিন নভোচারীরা। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে জলের সন্ধান করার পরিকল্পনাও রয়েছে নাসার।
চীনের সরকারের মহাকাশ সংস্থা- দ্য চায়না ন্যাশনাল স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (সিএনএসএ) জানিয়েছে, চলতি বছর তারা চাঁদে তাদের চতুর্থ অনুসন্ধান কর্মসূচি পরিচালনা করবে। এর মাধ্যমে ২০২৫ সালে চন্দ্রশিলা ও অন্যান্য নমুনা নিয়ে আসা হবে। এর ফলে, দ্বিতীয়বার চাঁদের নমুনা আনবে সংস্থাটি।
সিএনএসএ আরো জানিয়েছে, ২০২৫ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে পরিচালিত তিনটি মিশন– ভবিষ্যতে চাঁদে চীনা নভোচারী অবতরণের শক্ত ভিত্তি তৈরি করবে।
এর আগে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রোবোটিক মহাকাশযান চাংহে-৪ উৎক্ষেপণ করে চীন। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে মহাকাশযানটি চাঁদে অবতরণ করে।
২০২০ সালের শেষদিকে আরো শক্তিশালী লং মার্চ- ৫ রকেটে করে চাংহে-৫ নভোযান উৎক্ষেপণ করে চীন। এটি চাঁদ থেকে সফলভাবে ১.৭৩ কেজি নমুনা নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে।
এই প্রেক্ষাপটে গত সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) পৃথিবীর উপগ্রহটিতে আরো রোবোটিক মিশন পাঠানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করয়েছে সিএনএসএ।
চীনের চন্দ্রাভিযান কর্মসূচির প্রধান ডিজাইনার উ উইরেন জানান, ২০২৫ সালের দিকে চাংহে-৬ চাঁদে পাঠানো হবে। এটি মোট ২ কেজি নমুনা নিয়ে পৃথিবীতে ফিরবে।
এছাড়া, ২০২৬ সালে পানির সন্ধানে চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠ বা দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করবে আরো উন্নততর চাংহে-৭। এরপর ২০২৮ সালে একইস্থানে অবতরণ করবে চাংহে-৮ এবং চাংহে-৭ এর সাথে মিলে একটি গবেষণা ঘাঁটি স্থাপনের কাজ শুরু করবে।
চীনের চন্দ্রঘাঁটিতে থাকবে একটি লুনার রিকনসেন্স অরবিটার, বা নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরে চাঁদকে পর্যবেক্ষণকারী যান। একটি অবতরণ যান (ল্যান্ডিং ভিহাইকেল), একটি মহাকাশযান এবং বিশেষ কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি।
সাম্প্রতিক এ ঘোষণার আগে গত বছরের নভেম্বরে উ বলেছিলেন, আগামী এক দশকের মধ্যেই চাঁদে নভোচারী পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে তার দেশের। মঙ্গল গ্রহে অভিযানের পথে চাঁদ চীনা নভোযাত্রীদের ট্রানজিট পয়েন্ট হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
মনুষ্যবাহী মহাকাশযানকে পৃথিবী থেকে চাঁদের কক্ষপথে নিতে চীনের রকেট ইঞ্জিনের থ্রাস্ট চারগুণ বৃদ্ধি করতে হবে বলেও জানান তিনি।
জ্বালানি পুড়িয়ে রকেট ইঞ্জিন থেকে গ্যাস যখন একটি নির্দিষ্ট হারে নির্গত হতে থাকে, তখন গ্যাসের গতির বিপরীত দিকে রকেটটি একটি স্থির বল লাভ করে। এ বলকে থ্রাস্ট (thrust) বলে।
চীনের গণমাধ্যম জানিয়েছে, তাদের লং মার্চ-৫ রকেটে দুটি ওয়াইএফ-১০০ এবং দুটি ওয়াইএফ-৭৭ ইঞ্জিন রয়েছে। এর মোট থ্রাস্ট শক্তি ১ হাজার ৬০ টন, এর মধ্যমে ২৫ টন ওজন পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে পৌঁছানো যায় এবং ৮ টন ওজন চাঁদ ও পৃথিবীর মধ্যেকার কক্ষপথে নেওয়া সম্ভব।
সোভিয়েত যুগে ইউক্রেনে উৎপাদিত হতো আরএফ-১২০ রকেট ইঞ্জিন, ওয়াইএফ-১০০ এর নকশা এর দ্বারা অনুপ্রাণিত।
আরো উন্নত ওয়াইএফ-১৩৫ ইঞ্জিনযুক্ত লং মার্চ-৯ রকেট ২০২৮ বা ২০২৯ সালে পরীক্ষা করতে চায় চীন। এর থ্রাস্ট সক্ষমতা হবে ওয়াইএফ-১০০ এর চেয়ে চারগুণ বেশি। অর্থাৎ, লং মার্চ-৯ এর থ্রাস্ট শক্তি হবে পাঁচ হাজার টন, যা দিয়ে ১৪০ টন ওজন পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে এবং ৫০ টন ওজন পৃথিবী থেকে চাঁদের কক্ষপথে নিয়ে যাওয়া যাবে। ৫০ টনের এই মহাকাশযানে স্বাভাবিকভাবেই কয়েকজন নভোচারীসহ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিও বহন করা যাবে।
সোমবার চন্দ্রাভিযানগুলোর প্রচারে একাধিক নিবন্ধ প্রকাশ করেছে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো।
যুক্তরাষ্ট্র যা করছে
চীনের এই প্রচারণা এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব পরিকল্পনা ঘোষণার পরই। গত ৯ জানুয়ারি নাসা জানায়, চাঁদের দক্ষিণ মেরুর বরফ থেকে তারা আগামী বছর অক্সিজেন আহরণের চেষ্টা করবে। আহরিত অক্সিজেন পরিবহনে একটি পাইপলাইনও স্থাপন করবে, যা ২০২৬ সালের শুরুতে আর্তিমিস মিশনের নভোচারীদের সরবরাহ করা হবে।
নাসার আশা, স্থাপনাটি চাঁদ থেকে অফুরান পানি, অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন সংগ্রহের উপায় তৈরি করবে।
গত বছরের ১৫ নভেম্বর মনুষ্যহীন মহাকাশযান আর্তিমিস-১ উৎক্ষেপণ করে নাসা, যদিও এটি চাঁদে অবতরণ করেনি। ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর পৃথিবীতে ফিরে আসে এটি। কিন্তু, ২০২৪ সালের আর্তিমিস-২ মিশনে থাকবেন চারজন মহাকাশ অভিযাত্রী। চাঁদে মানব অবতরণে উন্নত 'হিউম্যান ল্যান্ডিং সিস্টেম' (এইচএলএস) তৈরি করেছে বেসরকারি মহাকাশ সংস্থা স্পেস এক্স। এর সহায়তায় ২০২৫ সালেই নাসার আর্তিমিস-৩ অভিযানের নভোচারীরা চাঁদে অবতরণ করতে পারবেন। পরবর্তী অভিযানগুলোতে এইচএলএস বাড়তি সুবিধা দেবে যুক্তরাষ্ট্রকে।
সোমবার জাপানের জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম এনএইচকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নাসা প্রশাসক নেলসন (সাবেক নভোচারী ও ফ্লোরিডার সিনেটরও ছিলেন) আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, চাঁদের দক্ষিণ মেরুর ওপর নিজের দাবি করে বসতে পারে চীন। এখানে পাওয়া পানি ও অক্সিজেনকে চীনের সম্পত্তি বলে ঘোষণাও করা হতে পারে।
তিনি বলেন, 'তাঁরা (চাঁদের) দক্ষিণ মেরুতে যাবে, আমাদের ধারণা এখানেই সম্পদ রয়েছে। তারা গিয়ে বলতে পারে, এখন থেকে এসব আমাদের'। চাঁদ নিয়ে ভবিষ্যৎ বিরোধ অবসানে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানান।
আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, চাঁদসহ মহাজাগতিক বস্তুর ওপর আঞ্চলিক দাবি প্রতিষ্ঠা বৈধ নয়।
তবে গত সোমবার চীনের হুবেই-ভিত্তিক একজন কলামিস্ট এসব মনোভাবের সমালোচনা করে বলেছেন, নেলসেন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অহেতুক উত্তেজনা সৃষ্টি করে নাসায় মার্কিন সরকারের তহবিল বরাদ্দ বাড়াতে চাইছেন।