যুক্তরাষ্ট্র-চীন এআই প্রযুক্তি প্রতিযোগিতার আগুনে ঘি ঢেলেছে চ্যাটজিপিটি
গত মাসে বৈশ্বিক গণমাধ্যমে তুঙ্গে ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চালিত চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি নিয়ে আলোচনা। তবে এসময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের গবেষণা সংস্থা 'ডারপা' এ খাতে নিজেদেরও একটি অগ্রগতির কথা জানায়। সংস্থার বিবৃতিতে বলা হয়, দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার আকাশে সফলভাবে উড্ডয়ন ও ডগফাইটে অংশ নিয়েছে এআই বট-চালিত একটি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। খবর এনবিসির।
চ্যাটজিপিটি যখন আলোচনার মধ্যমণি, তার মধ্যে সামরিক খাতের যুগান্তকারী এ উদ্ভাবনা তেমন মনোযোগ কাড়েনি অধিকাংশের। এক্ষেত্রে একটি বাস্তবতাকেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তা হলো: পরবর্তী প্রজন্মের এআই উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতা শুধু গুগল বা মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। সরকারগুলো নিজস্বভাবে এআই প্রযুক্তির উন্নয়ন ও অগ্রসরে ব্যাপক গুরুত্ব দিচ্ছে। আর এই প্রতিযোগিতা তারা আগ্রাসীভাবেই করছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কে বর্তমান সময়ে রয়েছে টান টান উত্তেজনা। আর তারমধ্যেই এআই প্রযুক্তি ঘিরে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত উভয় পরাশক্তি। এর তীব্রতা নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া, যোদ্ধা এআই মানবজাতির জন্য হুমকিও হতে পারে; কল্পবিজ্ঞানের পাতা ছেড়ে বাস্তব দুনিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে তারই প্রতিফলন ঘটবে বলেও আশঙ্কা দীর্ঘদিনের।
অন্যদিকে, পশ্চিমা পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞরা শঙ্কায় রয়েছেন গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে। চীন এগিয়ে গেলে পশ্চিমা আধিপত্য ধূলিসাৎ হবে বলেও অনেকে মনে করেন।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ডিজিটাল পলিসি ইনকিউবেটর- এর নির্বাহী পরিচালক এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত এইলিন ডনাহো বলেন, 'গণতান্ত্রিক পক্ষ যদি এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে, আর যদি স্বৈরাচারীরা এগিয়ে যায়– তাহলে তা সমগ্র বিশ্বের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে হুমকির মধ্যে ফেলবে'।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও বেসরকারি বিশ্লেষকরা বলছেন, গণমাধ্যমে চ্যাটবট, ডিজিটাল আর্টের মতো বিষয়গুলো প্রাধান্য পেলেও – যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-কৌশলগত লক্ষ্যের সাথে দিন দিন আরো সম্পৃক্ততা বাড়ছে এআই প্রযুক্তির। এ নিয়ে তেমন আলোচনা নেই, কারণ প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত তথ্যের গোপনীয়তা। তবে এরই ওপর নির্ভর করছে দেশটির বৈশ্বিক আধিপত্য। অন্য প্রতিযোগী শক্তিগুলোও এই লক্ষ্যে নিরলস কাজ করছে।
শুধু স্বচালিত ফাইটার জেটের মতো সামরিক অস্ত্রের ক্ষেত্রেই নয়, চ্যাটজিপিটির মতো বেসামরিক এআই-চ্যাটবটে বৈপ্লবিক যেসব ফিচার রয়েছে তা ভূরাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণায় কাজে লাগাতে পারে বিশ্বশক্তিগুলো। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্যও আবশ্যক হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ, আবার প্রতিপক্ষের অর্থনীতির ক্ষতি করতেও- এআই টুলগুলো হবে সাইবার আক্রমণের হাতিয়ার।
মার্কিন সরকারকে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতিতে গবেষণা সহায়তা দেওয়া চিন্তক সংস্থা র্যান্ড কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী (সিইও) জ্যাসন ম্যাথেনি বলেন, 'প্রযুক্তি-বিশারদ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের মধ্যে অনেকদিন ধরেই একটা প্রতিযোগিতা চলছে। তার সঙ্গে এখনকার পার্থক্যটা হলো– বর্তমানে এই আলোচনা সাধারণ মানুষও করছে। বিশেষত চ্যাটজিপিটির মতো লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল এরমধ্যেই ব্যবহার করেছেন লাখো মানুষ।'
অর্থাৎ, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে শত্রু রাষ্ট্রের নিয়োজিত চরদের প্রচারণা চালানোর আশঙ্কা রয়েছে। যা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো দক্ষ ও সক্ষম হতে হবে। মোদ্দা কথায়, অভ্যন্তরীণ জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও প্রযুক্তির অগ্রগতি এক বিশাল চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হয়েছে।
স্বচালিত অস্ত্রের তুলনায় চ্যাটবটগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ বলেই মনে হতে পারে। বাহ্যিক মিলও তেমন চোখে পড়ে না। কিন্তু, একই ধরনের আইডিয়ার ফসল তারা। বিশেষায়িত মাইক্রোচিপ উদ্ভাবন এখন জোরেশোরে চলছে। গুগলের প্রকৌশলীরা নতুন ধরনের কম্পিউটিং আর্কিটেকচার তৈরি করেছেন, যাকে বলা হচ্ছে 'ট্রান্সফর্মার'। এসব উন্নতির হাত ধরে এআই আরো বিকশিত হচ্ছে। যেমন চ্যাঠিপিটির শেষ 'টি' অক্ষর দিয়ে ট্রান্সফর্মারকেই বোঝানো হয়েছে।
এআই প্রযুক্তি জাতীয় নিরাপত্তা অর্জন ও লঙ্ঘন দুইয়েরই হাতিয়ার হয়ে ওঠায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি বিনিময় ও সহযোগিতা। চীনের অনেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আবার চীনও সম্প্রতি তাদের কোম্পানিগুলোকে চ্যাটজিপিটির সাথে সম্পর্কিত কোনো সেবা অফার না করার নির্দেশ দিয়েছে। গত মাসে নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনে এআই সংক্রান্ত প্রযুক্তি রপ্তানির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ জারি করেছে বাইডেন প্রশাসন।
এই প্রতিযোগিতার ফলে দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে এবং তা উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানান পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানীয় একাডেমিক। পরে এই প্রতিবেদন অনলাইন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় বলে জানায় হংকং-ভিত্তিক গণমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগের কারণেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্য নিয়েছেন। অবশ্য এআই প্রযুক্তিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অর্থ এই নয় যে, বিজয়ীই সব সুফল পাবে। চীনের কঠোর সেন্সরশিপ দেশটির জন্য লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল উদ্ভাবনে বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে।
ম্যাথেনি বলেন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আছে। এই নেতৃত্ব ধরে রাখতেই কম্পিউটিং সক্ষমতা বৃদ্ধির উন্নত মাইক্রোচিপ, বিপুল তথ্যভাণ্ডার, অগ্রসর অ্যালগরিদম ও মেধাবী প্রকৌশলীদের মতো অপরিহার্য দিকগুলোয় নজর দিচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই রেসকে আরো জটিল করে তুলেছে তাইওয়ান। অত্যাধুনিক মাইক্রোচিপ প্রস্তুকারক এই ভূখণ্ডকে নিজেদের বলে দাবি করে চীন।
ম্যাথেনি বলেন, 'যেসব অঞ্চল এআই সরবরাহ চক্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – ভৌগলিকভাবে তাদের ঘিরেই সবচেয়ে বেশি জটিলতা রয়েছে। তাইওয়ানের ক্ষেত্রে যা একেবারেই প্রযোজ্য, দ্বীপটি চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে মাত্র ১০০ মাইল দূরে অবস্থিত'।
এজন্যই তাইওয়ানের নিরাপত্তার বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ ওয়াশিংটন। তাইপে যেকোনো প্রকার আগ্রাসনের শিকার হলে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর সামরিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও বিভিন্ন সময় জানিয়েছেন মার্কিন নীতিনির্ধারকরা।
এই বাস্তবতায়, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই মরিয়া এআই প্রযুক্তির উন্নয়ন নিয়ে। উভয় পরাশক্তিই এজন্য বিপুল সম্পদকে নিয়োজিত করছে। আগামী পাঁচ বছরে এআই প্রযুক্তির উন্নয়নে ১৫০ কোটি ডলার ব্যয় করবে পেন্টাগন। গত বছর মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস) পেন্টাগনকে আরো ২০ কোটি ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। পেন্টাগনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান – ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি (ডারপা) আলাদাভাবে আরো শত শত কোটি ডলার ব্যয় করছে।
চীনের প্রকৃত ব্যয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি, তবে সেটাও হাজারো কোটি ডলার হবে বলে ধারণা পশ্চিমাদের। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নে বেসরকারি বিনিয়োগের দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্র আর চীন যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি সংস্থাগুলোর বিনিয়োগ তাদের চীনা প্রতিপক্ষের চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি বলে ২০২২ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়।
সিলিকন ভ্যালিতে অবস্থিত পেন্টাগনের প্রযুক্তি বিষয়ক দপ্তরের প্রধান ক্রিস্টোফার কিরচফ বলেন, 'এটা শুধু এআই সৃষ্টিরই বিষয় নয় বরং কে আগে তা ব্যবহার করবে– তারও প্রতিযোগিতা'।
হোয়াইট হাউসের কাছে এআই প্রযুক্তির গুরুত্ব কতটা সেদিকে আলোকপাত করে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান বলেছেন, শুধু অন্যান্য দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এগিয়ে থাকাই এখন যথেষ্ট নয়, বরং 'যতোটা সম্ভব বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে থাকতে হবে।'
বিশ্লেষকরা বলছেন, অস্ত্র প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে যেসব আলামত দেখা যায়, তা এআই নিয়ে প্রতিযোগিতায় দেখা যাচ্ছে। এর পরিণতি হতে পারে ভয়ংকর। যেহেতু, এ নিয়ে আন্তর্জাতিক বিরোধিতা ও বিপুল ব্যয়ের ইঁদুরদৌড় চলছে। তাই এআই নিয়ে অগ্রসর দেশগুলির মধ্যে একটি সর্বজনীন চুক্তির দাবিও জোরালো হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মূল্যবোধ সম্পর্কিত কার্নেগি কাউন্সিলের সহ-পরিচালক অয়েন্ডেল ওয়ালেশ বলেন, '(এই প্রতিযোগিতা) চলছে স্নায়ুযুদ্ধ কালের যুক্তিতে। চীনের সাথে বিরোধকে আমরা কী এমন পর্যায়ে নিচ্ছি না– যেখানে আমরাই সেই ফাঁদে আটকা পড়ব?"