নেপালে একা পর্বতারোহণে নিষেধাজ্ঞা
বিশ্বের আটটি উচ্চতম পর্বতের দেশ নেপাল। পর্বতারোহীদের জন্য নেপালকে এক স্বর্গভূমি বললেও অত্যুক্তি করা হয় না। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী ট্রেকারদের যারাই ভাবছেন যে একা একাই নেপালে পর্বতারোহণে যাবেন, আপাতত তাদের জন্য দুঃসংবাদ রয়েছে। কারণ আগামী মাস থেকে নেপালের পাহাড়ি এলাকায় একা ভ্রমণ বা একা পর্বতারোহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাচ্ছে নেপাল সরকার। বিগত বছরগুলোতে নেপালের ধাঁধাঁময়-দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় একা ভ্রমণ করতে গিয়ে বিদেশি নাগরিকদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির সরকার। খবর দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের।
নতুন নিয়মের আওতায় একা বা দলগতভাবে ভ্রমণকারী বিদেশি নাগরিকদের সবাইকেই লাইসেন্সধারী একজন গাইডকে নিজের সঙ্গে রাখতে হবে এবং ট্যুর অপারেটরের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। এই নিয়ম নেপালি নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
নেপাল ট্যুরিজম বোর্ডের পরিচালক মণি আর. লামিছানে সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, "যখন কেউ একা ভ্রমণ করে তখন বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করার কেউ থাকে না। শহরে একা ভ্রমণের ক্ষেত্রে সেটা ঠিক আছে, কিন্তু প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় একা ভ্রমণ বিপজ্জনক। সেসব এলাকায় উদ্ধার অভিযান চালানোর মতো সুযোগ সুবিধাও কম।"
তিনি আরও যোগ করেন, "যখন পর্যটকদের কেউ নিখোঁজ হয় কিংবা মৃত পাওয়া যায়, তখন অনেক সময় সরকার থেকে অভিযান চালিয়েও তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয় না, কারণ দেখা যায় তারা অনেক দুর্গম পথে চলে যান।"
ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআই'কে তিনি বলেন, "বর্তমান সিদ্ধান্তটা পর্যটকদের ভালোর জন্যই নেওয়া হয়েছে।"
চলতি মাসের শুরুতে নেপাল ট্যুরিজম বোর্ড এ সিদ্ধান্ত নেয় এবং আগামী ১ এপ্রিল থেকে এটি কার্যকর হবে বলে জানানো হয়।
বছর পাঁচেক আগে মাউন্ট এভারেস্টে একা ট্রেকিং এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল নেপাল সরকার। পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা ছাড়াই ট্রেকিংয়ে চলে যাওয়ার ফলে পর্যটকদের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার মুখে পড়া এবং নিখোঁজ হওয়ার ঝুঁকি রোধে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দেশটির সরকার।
স্থানীয় গাইডরা জানিয়েছেন, নেপালের দুর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলোতে প্রতিবছরই প্রায় ডজনখানেক ট্রেকার নিখোঁজ হন। এমনকি তাদের খুঁজে পাওয়া গেলেও, দুর্গম ভূখন্ডের কারণে এদেরকে উদ্ধার করা আনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং কখনো কখনো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
বর্তমানে ভ্রমণের ব্যয় আরও সাশ্রয়ী হওয়ায় এবং পর্বতারোহণের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়া নেপালের মতো দেশগুলোতে পর্যটকদের আনাগোনা অনেক বেড়ে গিয়েছে। এর ফলে আগে কোনোদিন যা হয়নি; যেমন- এভারেস্টের পথে ট্রাফিক জ্যামের মতো ঘটনা ঘটেছে যা ক্লান্ত পর্বতারোহীদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এই জ্যামের কারণে আরোহীদের অধিক উচ্চতায় আরও বেশি সময় কাটাতে বাধ্য করে এবং অক্সিজেন স্বল্পতায় ভোগেন।
কোভিড মহামারির আগে নেপাল সরকারের দেওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০১৯ সালে প্রায় ৩০০,০০০ ট্রেকার নেপাল ভ্রমণে এসেছিলেন। এদের মধ্যে প্রায় ৪৬,০০০ ট্রেকার একা ট্রেকিংয়ে গিয়েছেন বলে নিউইয়র্ক টাইমসকে জানান লামিছানে। এদের অনেকেই টাকা বাঁচাতে কিংবা একা ভ্রমণের স্বাধীনতা উপভোগ করতে একা ট্রেকিং করেন। কিন্তু অধিক উচ্চতা এবং ক্রম-পরিবর্তনশীল তাপমাত্রার কারণে বাস্তবে পরিস্থিতি বেশ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। ফলে এসব পাহাড়ি অঞ্চলে নিখোঁজ হওয়া বা কোথাও আটকে পড়া কঠিন নয়।
তবে প্রতি বছর ঠিক কতজন বিদেশি ট্রেকার নেপালে নিখোঁজ হন এবং কী কারণে হন তা স্পষ্ট নয়। স্থানীয় গাইড এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হিসাবে- সংখ্যাটা ৫ থেকে ১৫ জন হতে পারে।
নেপাল ট্যুরিস্ট পুলিশের একজন ইন্সপেক্টর চন্দ্র কিশোর শাহ বলেন, প্রতি বছর ৫ থেকে ৬ জন বিদেশি ট্রেকার নিখোঁজ হন- এদের অনেকেই দুর্গম পথে একা ভ্রমণ করতে গিয়ে নিখোঁজ হন। তার ভাষ্যে, "অপ্রস্তুত ট্রেকারা, যাদের সঙ্গে পর্যাপ্ত সহায়তাকারী গাইড থাকে না, তারা অধিক উচ্চতাজনিত অসুখে ভুগে মারা যান।"
চন্দ্র শেখর জানান, কয়েক বছর পর এসব নিখোঁজ ব্যক্তিদের ফাইল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি এও জানান, এই মুহূর্তে দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, ইসরায়েল, জর্ডান ও মালয়েশিয়ার পাঁচজন নিখোজ পর্বতারোহীকে খুঁজছে নেপালের পুলিশ। মালয়েশিয়ার এই ট্রেকার ২০১৫ সাল থেকে নিখোঁজ আছেন; কিন্তু তার 'পরিবারের অনুরোধে' এখনও তাকে খোঁজার কাজ চলছে। অন্যদিকে, বাকি চারজন গত বছর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন; মূলত এভারেস্ট ও অন্নপূর্ণা পর্বত এলাকায় তারা নিখোঁজ হয়েছেন।
ট্রেকিং এজেন্সিস এসোসিয়েশন অব নেপাল-এর সভাপতি নিলহারি বাস্তোলা দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট'কে বলেন, নেপালে প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ জন হাইকার নিখোঁজ হন এবং এদের বেশিরভাগই 'ফ্রি ইন্ডিপেনডেন্ট ট্রেকার' (এফআইটি)- যারা কোনো ট্যুর গ্রুপ বা গাইড ছাড়াই অনিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে ভ্রমণের অনুমতি নেন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে, তাদেরকে এই উপাধি দেওয়া হয়।
কিন্তু এপ্রিল থেকে কার্যকর হতে যাওয়া নতুন নিয়মের আওতায়, এফআইটি'দের নেপালের অভ্যন্তরে ১২টি ন্যাশনাল পার্ক এবং অন্নপূর্ণা সার্কিটসহ দেশটির জনপ্রিয় পর্বতগুলোতে ভ্রমণের জন্য অবশ্যই একজন লাইসেন্সধারী গাইড ভাড়া করতে হবে।
নেপাল সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন একাধিক ট্যুর অপারেটররা। তারা মনে করে, পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং নেপালের অর্থনীতির জন্যও এই সিদ্ধান্তটি উপকারী। কিন্তু কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, গাইড ভাড়া করার বাড়তি খরচের কারণে অনেক পর্যটকই হয়তো নেপাল ভ্রমণে আসতে অনুৎসাহীত হবেন; বিশেষ করে যখন মহামারি পরবর্তীকালে নেপালের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, দেশটির মোট জিডিপির প্রায় ৭ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে।