রাহুল গান্ধীর পার্লামেন্টের সদস্যপদ খারিজ হওয়াটা কেন মোদি ও ভারতের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ
গুজরাটের একটি নিম্ন আদালত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে মানহানির অভিযোগে দেশটির প্রধান বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা রাহুল গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। এই প্রেক্ষাপটে পার্লামেন্টের সদস্যপদও হারিয়েছেন তিনি। এদিকে আগামী বছরে ভারতের সাধারণ নির্বাচন (লোকসভা)। তার আগে এ ঘটনা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের জন্য বড় এক আঘাত বলেই মনে করা হচ্ছে। ব্লুমবার্গ ও হিন্দুস্তান টাইমস অবলম্বনে
ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জানিয়েছে, রায় ঘোষণার দিন অর্থাৎ ২৩ মার্চ থেকেই তার সংসদ সদস্যপদ খারিজ হওয়া কার্যকর হয়েছে।
পার্লামেন্ট থেকে বহিষ্কার হওয়াটা রাহুলের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে চরম এক আঘাত। পুরো ঘটনার সার্বিক চিত্র তুলে ধরতেই এ প্রতিবেদন:
রাহুল গান্ধী কে?
৫২ বছরের রাহুল গান্ধী ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকারী। ২০২৪ সালের এপ্রিলে ভারতের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে; এ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে প্রধান 'চ্যালেঞ্জার' হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।
কিন্তু, গত দুটি নির্বাচনে বিজেপির কাছে তার দলের বড় পরাজয় হয়েছে। এতে তার রাজনৈতিক প্রতিপত্তিও সার্বিকভাবে কমে যায়। একদা ভারতীয় রাজনীতি অপরাজেয় শক্তি কংগ্রেস বর্তমানে ভোটারদের সাথে জনসংযোগ করতেই মুশকিলে পড়ছে, নির্ভর করতে হবে বিভিন্ন প্রদেশের আঞ্চলিক দলগুলোর ওপর। তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন থাকার সময় কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক দুর্নীতির কেলেঙ্কারি রয়েছে তাও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সঙ্গে নেতৃত্বে শূন্যতা পূরণের চ্যালেঞ্জ তো রয়েছেই।
দলীয় ভাবমূর্তিকে পুনরুদ্ধারে 'ভারত জোড়ো যাত্রা' নামক কর্মসূচি নেন তিনি। ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী থেকে শুরু হয়েছিল এই পদযাত্রা; যা তামিলনাড়ু, কেরালা, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ এবং হরিয়ানা হয়ে জম্মু ও কাশ্মীরে পৌঁছায়। ১৪৫ দিন ধরে মোট ১২টি রাজ্য এবং ২টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দিয়ে গিয়েছে এই যাত্রা। গত ৩০ জানুয়ারি সেই যাত্রা শেষ হয় শ্রীনগরে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে।
এই পদযাত্রার সময় বিভিন্ন জনসমাবেশে আর তার আগেও রাহুল নিজেকে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরোধী এবং ধর্মনিরপক্ষ রাষ্ট্রে বিশ্বাসী একজন শক্তিশালী নেতা হিসেবে উপস্থাপন করে বক্তব্য দিয়েছেন।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সফরকালেও নরেন্দ্র মোদির কড়া সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। এসময় রাহুল বলেন, "ভারতে গণতন্ত্রকে আক্রমণ করা হচ্ছে।" মার্কিন শর্ট সেলার হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনের পর- পুঁজিবাজারে কর্পোরেট জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে যার বিরুদ্ধে, সেই ভারতীয় বিলিয়নিয়ার গৌতম আদানির সঙ্গেও মোদির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আদানি গ্রুপ অবশ্য সব ধরনের অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
আদালতের রায় কী ছিল?
"সব মোদি কেন চোর হয়?" - মন্তব্যের জেরেই পার্লামেন্টের সদস্যপদ হারিয়েছেন রাহুল গান্ধী। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় কর্নাটকের কোলারে একটি নির্বাচনী সভায় তিনি এ কথা বলেছিলেন। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে অর্থপাচার ও জালিয়াতির জন্য কুখ্যাতি পাওয়া- নীরব মোদি, ললিত মোদিকে বোঝাতে এই মন্তব্য করেছিলেন রাহুল। তবে এতে 'মোদি' পদবির সকলের অপমান হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। মূল অভিযোগ অবশ্য বিজেপির পক্ষ থেকেই করা হয়।
এনিয়ে মানহানির মামলায় গত বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) গুজরাটের সুরাট জেলার দায়রা আদালত কংগ্রেসের এ সাংসদকে দোষী সাব্যস্ত করেন। রায়ে রাহুল গান্ধীকে দু'বছরের কারাদণ্ড এবং ১৫ হাজার টাকার জরিমানার সাজা দেন আদালত। রায়ের পরপরই ১০ হাজার রুপির একটি জামিন বন্ড দিয়ে মামলায় জামিনও পেয়েছেন তিনি। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য ৩০ দিন সময় পেয়েছেন ভারতের ওয়ানাডের এই এমপি।
পার্লামেন্ট থেকে কেন বহিষ্কৃত হলেন?
ভারতের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের আওতায়, কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্তত দুই বছর বা তার বেশি সময় কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আইনপ্রণেতার সদস্যপদ তাৎক্ষণিকভাবে খারিজ হয়ে যায়। গতকাল শুক্রবার (২৪ মার্চ) লোকসভার সচিবালয়ের তরফে এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়ে দেওয়া হয়, রাহুল গান্ধীর সাংসদপদ খারিজ করা হয়েছে।
আর কোন ধরনের রাজনৈতিক চাপে পড়লেন রাহুল গান্ধী?
উচ্চ আদালত এ রায় বহাল রাখলে নিয়ম অনুসারে, আগামী আট বছর আর ভোটে লড়তে পারবেন না তিনি। একইসঙ্গে, এ ধরনের সংবেদনশীল রাজনৈতিক মামলার রায় আসতে স্বাভাবিকভাবে লাগবে দীর্ঘসময়। ফলে আগামী বছর লোকসভা নির্বাচনের আগে রাহুল সাংসদ পদ ফিরে পাবেন এমন সম্ভাবনাও খুবই কম।
কারণ, ভারতের আইন অনুসারে, দুই বছরের সাজা শেষ হওয়ার পর আরো ছয় বছর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারেন না দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি। এই বাস্তবতায়, ভারতের অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, রাহুলকে লঘু পাপে গুরু দণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করা হলো কিনা, এমন প্রশ্নও উঠছে।
তবে উচ্চ আদালত যদি রাহুল দোষী সাব্যস্ত নন এমন রায় দেন বা তার কারাদণ্ডের নির্দেশের বিরুদ্ধেও স্থগিতাদেশ দেন তাহলেই তিনি সাংসদ পদ খারিজ হওয়া থেকে বেঁচে যাবেন। নাহলে তার পক্ষে সংসদ পদ ফিরে পাওয়াটা কষ্টকর।