ইউরোপীয় অনুবাদকদের হত্যা করলো কে?
বেলজিয়ামের সবচেয়ে জনবহুল শহর ব্রাসেলস। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দপ্তর হওয়ায় কর্মমুখর এক পরিবেশ এখানকার। ইউরোপ বহু ভাষা ও জাতির এক মহাদেশ। এরমধ্যে ২৭টি রাষ্ট্র ইইউ সদস্য। ইইউ সদর দপ্তরে তাই অনুবাদকদের উপস্থিতি না থাকলেই নয়। ব্রাসেলসেও এতকাল তাই চলেছে। রমরমা এক সময় পার করেছেন সদাব্যস্ত অনুবাদকের দল। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তাতে থাবা বসিয়েছে প্রযুক্তির অগ্রগতি। এসময়ের বহুল আলোচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই- হলো সেই প্রযুক্তি। খবর পলিটিকোর।
বলতে গেলে, অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালেই এ পরিবর্তন এসেছে। উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নানান ইউরোপীয় পরিভাষা অনুবাদে দেখাচ্ছে বিস্ময়। ভাষান্তর করেও ফেলছে চটপট। তাদের এই সক্ষমতার গুণে অনুবাদক নিয়োগের প্রয়োজন কমেছে। এক কথায়, যন্ত্রই কাজের জায়গা দখল করেছে শত শত মানব অনুবাদকের।
বহুভাষার প্রচলন-সমৃদ্ধ ব্রাসেলসে ইইউ এর প্রতিষ্ঠানগুলো। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় ও পুরোনো বিভাগ তাদের অনুবাদ শাখা। তারপরও প্রযুক্তির উৎকর্ষ তাদের মেনে নিতেই হচ্ছে। কমানো হচ্ছে, বিভাগের কর্মী (অনুবাদক) সংখ্যা।
তবে এটা কেবল শুরু, এআই টুলস আগামী দিনে আরো অনেক জনের কর্মসংস্থান দখলের আভাসই দিচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দাপ্তরিক ভাষা ২৪টি। তাই প্রতিটি দাপ্তরিক নথিকে কার্যকর করার আগে এসব ভাষায় অনুবাদ করতে হয়। মাত্র বছর কয়েক আগেও এই দক্ষযজ্ঞে অনুবাদকদের দম ফেলারই ফুরসৎ ছিল না। কিন্তু, সেদিন আর নেই।
ইইউ এর নির্বাহী শাখা ইউরোপীয় কমিশনের তথ্যমতে, যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় গত এক দশকে তাদের অনুবাদ ইউনিটের পরিধি ১৭ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে।
সংকোচনের মাত্রা
অনুবাদ শাখা যখন এই ১৭ শতাংশ সংকুচিত হয়, সে সময়ে ২৬ থেকে ৩৭ শতাংশ অনুবাদের কাজ বাইরে থেকে করিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন। বাড়তি কাজের চাপ মোকাবিলায় এসময় কর্মী নিয়োগও হয়েছে বেশ কম।
হারানো দিনের স্মৃতিচারণ করেন ইইউ অনুবাদকদের অনেকে। সেই সময়ের কথা আজো ভাস্বর তাদের স্মৃতিতে, যখন কাঠখোট্টা নথির অনুবাদে মোটা মোটা অভিধান ঘেটে কাটতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
প্রযুক্তি সেই সময় বাঁচিয়েছে। এমনটাই বলেন দীর্ঘকালের অভিজ্ঞ অনুবাদক মার্কাস ফতি। বর্তমানে তিনি কমিশনের মেশিন ট্রান্সলেশন বা যান্ত্রিক অনুবাদক শাখার প্রধান।
পলিটিকোকে তিনি বলেন, 'যথাযথ বাক্য খোঁজার জন্য ১৯৯৯ সালে যে সময়টা আমি লাইব্রেরিতে কাটাতাম- এখন সে সময়ের পুরোটাই অনুবাদের কাজে লাগাতে পারছি'।
অনুবাদকরা বলছেন, তারা 'বিলুপ্ত' একথা অনেকটাই বাড়িয়ে বলার শামিল। তাদের কর্মক্ষেত্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দ্রুত গ্রহণ করলেও, এখনও অনুবাদে মানব কর্মীর দরকার ফুরায়নি, বরং বহুক্ষেত্রে তা অপরিহার্য।
২০১৩ সালে অনুবাদ যন্ত্রের প্রচলন চালু করে ইউরোপীয় কমিশন। এর সাবেক কর্মকর্তা স্পিরিডন পিলসের একাজের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। তার মতে, 'পৃথিবী বদলাচ্ছে, অনুবাদকেও আর পেছনে ফেলে রাখা যায় না। মেশিন ট্রান্সলেশন অনুবাদকদের সাহায্য করে, তাদের জায়গা দখল করে না। এই কাজে সব সময়েই একজন মানব বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন থাকে'।
অনুবাদ যেভাবে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করলো
২০০০ এর দশকের শুরুতে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো যোগ দিতে থাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে। ফলে কালেক্রমে দাপ্তরিক ভাষার সংখ্যা ২৪টিতে পৌঁছায়। অনুবাদকৃত নথির চাহিদা বাড়তে থাকায় নতুন প্রযুক্তিগত সক্ষমতা তৈরির দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়।
ইউরোপীয় কমিশন উপলদ্ধি করে, পূর্ব ইউরোপের নতুন সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ভাষা নিয়ে কাজ করার সামর্থ্য নেই তাদের পুরোনো ব্যবস্থায়, ফলে সেটিকে বাতিল করারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কেন তা করতে হলো, তার ব্যাখ্যায় কমিশনের অনুবাদ শাখার ইনফরম্যাটিক্স প্রধান ডিয়েটার রুমেল বলেন, 'আমাদের ভাষান্তর প্রক্রিয়াটা একটা নীতিসিদ্ধ ব্যবস্থা। ফলে নতুন শব্দকোষ, ব্যাকরণ রীতি, অনুবাদের নিয়ম সব তৈরি করতে হতো। এটা ছিল খুবই শ্রমসাধ্য ও জটিল এক ব্যবস্থা'।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাহী শাখার একজন মুখপাত্র বলেন, ২০১৩ সালে কমিশনকে প্রায় ২০ লাখ পাতা অনুবাদ করতে হয়েছে। ২০২২ সালে তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখে। আর এই কাজের ভারটা অনুবাদকেরই তো নিতে হয়। এআই-চালিত যান্ত্রিক ব্যবস্থা তাদের সাহায্য করেছে বলেই ইঙ্গিত দেয় কমিশনের সূত্রগুলো।
যেমন ২০১৩ সালে তথ্য-চালিত একটি অনুবাদ যন্ত্র চালু করা হয়। চার বছর পর এর বদলে আরো উন্নত একটি ট্রান্সলেশন ইঞ্জিনকে গ্রহণ করে ইইউ। এটি কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক বা কম্পিউটার নড ব্যবহার করে মানব মস্তিকের নিউরনের মতো করে একটি কাঠামো তৈরির মাধ্যমে নানান ভাষার সঠিক বাক্যকে অনুমান করতে পারে।
যান্ত্রিক এসব উপকরণে বিনিয়োগ ইইউ'কে লাভবানই করেছে। কারণ, এরফলে অল্প সংখ্যক কর্মী নিয়োগ দিয়েই বেশিরভাগ আইন ও নির্দেশনার অনুবাদ করা সম্ভব হচ্ছে।
যদিও এতে অনুবাদকদের চাকরির সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য প্রভাবই পড়ে।
ইউরোপীয় কমিশনের নিবেদিত অনুবাদ ইউনিট – ব্রাসেলসে যেটি ডিজিটি নামেই সুপরিচিত – ২০১৩ সালে তাদের কর্মী সংখ্যা ২,৪৫০ জন থাকলেও, ২০২৩ সালে সেটা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২,০০০ জনে।
ইইউ কর্মচারীদের শ্রম ইউনিয়ন 'ঘেন্যুভ্যু এ দেমোক্র্যাসি-র সভাপতি ক্রিস্টিয়ানো সেবাস্তিয়ানি জানান, আলোচিত সময়ে অনুবাদ কর্মীদের মধ্যে নানান রকম মানসিক সমস্যা দেখা দেয় কাজের চাপে। অনেকের মধ্যেই 'বার্নআউটের' লক্ষণ স্পষ্ট হতে থাকে।
কাজের চাপ বেড়ে যাওয়া এবং তার মধ্যেই আরো ভালো পারদর্শীতার জন্য চাপ প্রয়োগ করা – এর প্রধান কারণ বলে জানান তিনি।
এই বাস্তবতায়, গত এক দশকে আউটসোর্সিং বাড়িয়েছে ব্রাসেলস। ২০১৩ সালে ডিজিটি'র মোট কাজের ২৬ শতাংশ আউটসোর্স করা হতো, যা ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশে। দিনে দিনে কমিশনের আউটসোর্সিংয়ের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
ফলে অনুবাদের পেছনে খরচও বেড়েছে। ২০১২ সালে তা ২৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন ইউরো ব্যয় করলেও, ২০২৩ সালে বরাদ্দ রেখেছে ৩৫ দশমিক ৮ মিলিয়ন ইউরো।
সুনির্দিষ্টভাবে, ২০১২ সালে আউটসোর্সিংয়ের পেছনে ১২ দশমিক ৬ মিলিয়ন ইউরো ব্যয় করে কমিশন, যা ২০২২ সালে ছিল ২০.৪ মিলিয়ন ইউরো।
এই টাকা কোথায় যাচ্ছে?
২০১২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ডিজিটি'র বাজেট বাড়লেও, এতে আউটসোর্সিং সেবাদাতারাই বেশি লাভবান হয়েছে। নিচের চার্টে তাদের গোলাপি রঙে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর ধূসর রঙে ডিজিটির বাজেটের বাকি অংশের ব্যয় দেখানো হয়েছে।
সেবাস্তিয়ানি বলেন, 'বহুভাষার পক্ষ নেওয়া সহজ নয়, কারণ এটা খুবই ব্যয়বহুল'।
তিনি মনে করেন, অনুবাদকদের চাকরি কমার ঘটনা ইইউ- এর বহুভাষার সহাবস্থানের নীতিকে হুমকির মুখে ফেলছে, এটি শুধু ইংরেজি ভাষা চালুর পক্ষে সমর্থন বাড়াবে।
তবে ডাবলিন সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুবাদবিদ্যার মাস্টার্স ডিগ্রি প্রোগ্রামের চেয়ারম্যান শেইলা ক্যাস্টিলহো উল্লেখ করেন যে, যেসব ভাষার প্রচলন কম, তুলনামূলক ভাবে সেসব ভাষায় দক্ষ অনুবাদকরা সহজে ইইউ কমিশনে চাকরির সুযোগ পান। এক্ষেত্রে চাকরির প্রতিযোগিতাও কম থাকে।
আয়ারল্যান্ডের উদাহরণ দিয়েই তিনি বলেন, 'আইরিশ ছাত্ররা ডিজিটি থেকে প্রায় সময়েই চাকরির প্রস্তাব পাচ্ছে'। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশ করা ছাত্রদের প্রতি কমিশনের উদার মনোভাব থাকার কথাও জানান ক্যাস্টিলহো।
এআই প্রচলের পর কর্মজীবন কেমন হয়েছে
তরুণ অনুবাদকদের অনেকেই অসন্তুষ্ট। তাদের অভিযোগ, অটোমেশনের বোঝাটা তাদের কাঁধেই চেপেছে, কারণ ইউরোপীয় কমিশনের কাজের চাপ বৃদ্ধি সত্ত্বেও তাদের এন্ট্রি-লেভেলের নিয়োগ সংখ্যা কমেছে।
তারা আরো বলছেন, অনুবাদ কর্মীরা যে হারে অবসরে যাচ্ছেন, সেই হারে তাদের জায়গায় নতুন লোক নেওয়া হচ্ছে না। ফলে আগের প্রজন্মের চেয়ে তাদের কাজের সুযোগও অনেক কমেছে।
ইইউ নির্বাহীর অফিস জানায়, ২০১৩ সালে ১১২ জন অনুবাদককে নিয়োগ দেওয়া হলেও, ২০২২ সালে সেই সংখ্যা নেমে আসে ৫৯ জনে।
ফলে ইইউ-তে অনুবাদকের চাকরি-প্রত্যাশীরা সামাজিক মাধ্যমে এর প্রতিবাদ করছেন। ব্রাসেলসের প্রতিষ্ঠানগুলোয় চাকরি পেতে কত সংগ্রাম করতে হচ্ছে তা নিয়েই তাদের যত অভিযোগ।
এমন একজন তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, 'ভাবসাব দেখে মনে হয়, কোনোকালেই তাদের অনুবাদ, ভাষাতত্ত্ব ও প্রুফ রিডারের পদ ছিল না'।
অভিযোগ যেমনই হোক, তাই বলে ইইউ এর অনুবাদকদের ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকার- তা বলা যাবে না। কারণ, স্পর্শকাতর অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক তথ্য, নীতি-নির্দেশনা আজো মানব কর্মীর ওপরই নির্ভরশীল; এবং তা আগামীতেও থাকবে এমন সম্ভাবনাই বেশি।
স্পিরিডন পিলস জোর দিয়েই বলেন, 'বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ নথির বেলায় মানব অনুবাদকের দায়িত্বই চূড়ান্ত, আর যথার্থ ফলাফলের জন্য তারই ওপর নির্ভর করা হয়'।
তিনি আরো বলেন, 'জরুরি বক্তব্য ভাষান্তরের ক্ষেত্রে একেবারে গোঁড়া থেকেই মানব কর্মীর সম্পৃক্ততা চায় ইইউ। কারণ এসব স্পর্শকাতর বিষয় প্রকাশযোগ্য নয়'। একথার মাধ্যমে আউটসোর্সিং ও যন্ত্রের সাহায্যে অনুবাদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নথি ফাঁস হওয়া বা চুরির যে সম্ভাবনা থাকে, সেদিকেই ইঙ্গিত করেন তিনি।
ইইউ এর অনুবাদকরা জানান, এখন তাদের দৈনন্দিন রুটিনের অংশ হলো যন্ত্রের অনুবাদের ভুলগুলো চিহ্নিত ও সংশোধন করা।
অনুবাদকদের পরিভাষায় যা 'পোস্ট এডিটিং' নামেই পরিচিত; সুচারুভাবে এই কাজ সম্পাদনাই এখন তাদের চাকরির প্রধান অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার অনুমতি না থাকায়- নাম গোপন রাখার শর্তে ইউরোপীয় কমিশনের একজন অনুবাদক বলেন, 'বেশ উপলদ্ধি করতে পারি, সারা জীবন আমার পক্ষে অনুবাদের কাজ করা আর সম্ভব নয় (যেহেতু এআই ও আউটসোর্সিং সে জায়গা দখল করবে)'। পোস্ট এডিটিং করাটাই ভবিষ্যতে তার প্রধান দায়িত্ব হবে বলে ধারণা করছেন তিনি।