সুদান সংঘাত: ফোনের আলোয় সিজারিয়ান; যুদ্ধাঞ্চলে শিশুর জন্ম
চলমান সংঘাতের কারণে সুদানের রাজধানী খার্তুমের বহু হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অল্প যে কয়েকটি হাসপাতাল চালু রয়েছে, সেগুলোতেও প্রায়ই বিদ্যুৎ থাকে না। ফলে শিশু জন্মদানের সময় মা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা মুখোমুখি হতে হয়। খবর বিবিসির।
যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রতিকূল পরিবেশে যখন মায়েদের সার্জারির দরকার হয়, তখন পরিস্থিতি যেন আরও কঠিন হয়ে পড়ে। দেশটির প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ হোয়াইদা আহমেদ আল-হাসসান বলেন, "সিজারিয়ান অপারেশনে শিশু জন্ম দিতে আমরা মোবাইল ফোনের আলোর ওপর নির্ভর করছি।"
বিবিসিতে চিকিৎসক হোয়াইদার প্রেরণকৃত এক ভিডিওতে দেখা যায়, গ্লাভস হাতে তিনি এক প্রসূতি মায়ের সিজার করার সময় তার পাশে উপস্থিত থাকা নার্সেরা মোবাইলের টর্চ দিয়ে অপারেশন থিয়েটার আলোকিত করার চেষ্টা করছেন।
রাজধানী খার্তুমের উত্তরে অবস্থিত আলবান জাদিদ হাসপাতালের অল্প কয়েকজন প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞের মধ্যে হোয়াইদা একজন। অঞ্চলটিতে নানা ভাগে বিভক্ত সামরিক দলগুলো একে ওপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত।
চিকিৎসক হোয়াইদার বিবিসিকে প্রেরণকৃত আরেক ভিডিওতে দেখা যায়, হাসপাতালটির ওয়ার্ডগুলোতে নার্সরা প্রসূতি মায়েদের খুবই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সেবা দিচ্ছেন।
এ সম্পর্কে চিকিৎসক হোয়াইদা বলেন, "অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা দিনের পর দিন হাসপাতালে অবস্থান করছি। সময় সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। কখন দিন, কখন রাত, আমরা সেটাও জানি না।"
হাসপাতালটিতে কর্মীর সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মায়েদের সিজারিয়ান অপারেশনের সময় বিদ্যুৎ থাকে না। এমনকি হাসপাতালটিতে জেনারেটর চালানোর মতোও জ্বালানিও নেই।
চিকিৎসক হোয়াইদা বলেন, "আমরা প্রচুর ঝুঁকি নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে অস্ত্রোপচার করছি। আমাদের পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতিও নেই। অ্যানেস্থেসিয়া কনসালট্যান্ট এবং বিশেষজ্ঞদের ছাড়াই আমরা এ কাজটি করছি। এমনকি সিজারে বাচ্চা জন্মের মাত্র ১০ ঘণ্টা পর আমরা তাদের হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি।"
গত এপ্রিলে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ধারণা করে যে, সুদানের ২ লাখ ১৯ হাজার গর্ভবতী নারী তীব্র ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কেননা যুদ্ধবিরতি ব্যর্থ হওয়ার পর রাজধানী খার্তুমের আশেপাশে তখন তীব্র লড়াই চলছিল।
সংঘর্ষের শুরুর দিকে ইউএনএফপিএ জানায়, আগামী কয়েক সপ্তাহে অঞ্চলটিতে প্রায় ২৪০০ শিশু জন্ম নিতে পারে।
খার্তুমে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ার কয়েকদিন পরেই বাশায়ের আল-ফাদিল সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেন।
বিবিসির সাথে এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে আল-ফাদিল বলেন, "আমি খুবই ভাগ্যবান। বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির মাঝেও একটি হাসপাতাল আমি খোলা পেয়েছিলাম এবং সেখানে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। রাস্তায় বিস্ফোরণের শব্দও শোনা যাচ্ছিল।"
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী খার্তুমের গড়ে ছয়টি হাসপাতালের একটি মাত্র হাসপাতাল পুরোপুরিভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে আল-ফাদিল তার পরিচিত চিকিৎসক ও বন্ধুর মাধ্যমে ঐ হাসপাতালটির খোঁজ পেয়েছিলেন।
সন্তান জন্মদানের দিন আল-ফাদিল ও তার স্বামীকে আশেপাশে গোলাগুলি চলা অবস্থাতেই হাসপাতালে পৌঁছাতে হয়েছিল। এমনকি চলমান সংঘাতের কারণে জন্মের পর শিশুটি আজও প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন কিংবা জন্মনিবন্ধন সুবিধা পায়নি।
আল-ফাদিল সন্তান জন্মদান সম্পর্কে বলেন, "আমি খুব কঠিন পরিস্থিতিতে সন্তান জন্ম দিয়েছি। এমনকি সেখানে অতি প্রয়োজনীয় পানিও ছিল না।"
শুধু আল-ফাদিল একাই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন বিষয়টি এমন নয়। বরং তার পরিচিত বহু গর্ভবতী নারী হাসপাতালে ভর্তি হতে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন। এমনকি অনেকের গর্ভপাতও হয়েছে।
সুদানের বৃহৎ অমদুরমান ম্যাটারনিটি হাসপাতাল সহিংসতা শুরুর কয়েকদিনের মাঝেই কার্যক্রম বন্ধ করেছে। হাসপাতালটির পরামর্শদাতা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ কামেল কামাল জানান, সুদানের বেশিরভাগ প্রসূতি হাসপাতালগুলো এখন বন্ধ রয়েছে। যার ফলে, হাজার হাজার গর্ভবতী নারী জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছেন।
চিকিৎসক কামাল বলেন, "যদিও প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে আমরা ধারণা করছি যে, বহু সংখ্যক গর্ভবতী নারী বাড়িতে প্রসব বেদনায় ভুগছেন।"
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, সংঘাত শুরুর আগে থেকেই সুদানে মাতৃমৃত্যুর হার বিশ্বে সর্বাধিক ছিল। এমতাবস্থায় চিকিৎসক কামাল সতর্ক করেন যে, চলমান সংঘাত সুদানের গর্ভবতী নারীদের জন্য অত্যধিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে দেশে চলমান কঠিন পরিস্থিতিতে ধাত্রীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। অনেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গর্ভবতী নারীদের সেবা দিচ্ছেন।
দেশটির মাওয়াহেব নামের এক ধাত্রী বিবিসিকে জানান, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি সাতজন প্রসূতিকে স্বাভাবিক ডেলিভারিতে সন্তান জন্মদানে সাহায্য করেছেন।
ধাত্রী মাওয়াহেব বলেন, "আমি যখন প্রসব বেদনায় থাকা কোনো নারীর খবর ফোনের মাধ্যমে জানতে পারি, তখন আমি তৎক্ষণাৎ কোনো দ্বিধা ছাড়াই ঐ নারীর বাড়িতে চলে যাই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরাপদে শিশু জন্মগ্রহণ করে। তবে কোনো জটিলতা দেখা দিলে আমি তাদের নিকটবর্তী হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই।"
চিকিৎসক হোয়াইদা জানান, হাসপাতালে শত প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও কর্মীরা নিজেদের কর্মোদ্দীপনা জাগিয়ে রাখেন। এমনকি নিরাপদে শিশু জন্ম নিলে তারা উদযাপনও করেন।
চিকিৎসক হোয়াইদা বলেন, "আমরা শিশু জন্ম দেই আর তারা আমাদের হত্যা করে। আমরা দুটি জীবন বাঁচাই- একজন মা ও আরেকজন শিশু।"