কেন ১০১ জন প্রার্থী ও একটি কুকুর টরন্টোর মেয়র হতে চায়?
আজ (সোমবার) টরন্টোতে মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ নির্বাচনে মেয়র হওয়ার দৌড়ে মলি নামের একটি কুকুরসহ মোট ১০২ জন প্রার্থী প্রতিযোগিতা করছে। খবর বিবিসির।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি নারী সহকর্মীর সাথে অপ্রত্যাশিত সম্পর্কের দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করেছেন টরন্টোর নির্বাচিত মেয়র জন টোরি। তারই ফলশ্রুতিতে এ উপনির্বাচনের আয়োজন করা হচ্ছে।
নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে ভিন্নধর্মী প্রতিশ্রুতি দিয়ে নজর কেড়েছেন টবি হিপস নামের এক প্রার্থী। তার সাথে রয়েছে ছয় বছর বয়সী একটি কুকুর, নাম মলি।
টবি যুক্তি দিয়েছেন যে, শীতকালে টরন্টোর রাস্তায় লবণের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে মলির মতো কোমল পায়ের কুকুরের পাঞ্জা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। তাই তিনি মেয়র নির্বাচিত হলে রাস্তায় লবণের ব্যবহার বন্ধ করবেন।
মেয়র প্রার্থী টবি আবাসনের খাতে অত্যাধিক খরচ কমানো, বিলিয়ন ডলারের ব্যবসার উপর কর বৃদ্ধির পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন। তিনি নির্বাচিত হলে নতুন বাড়ি এবং বাণিজ্যিক ভবনগুলোর হিটিং সিস্টেমে জীবাশ্ম-জ্বালানির ব্যবহারের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
যদি মেয়র প্রার্থী টবি জয়লাভ করেন, তবে তিনি মলিকে প্রথম কুকুর হিসেবে টরন্টোর 'অনারারি মেয়র' হিসেবে নিযুক্ত করবেন।
এ সম্পর্কে টবি বলেন, "আমি মনে করি যে, সিটি হলে যদি প্রতিনিধিদের পাশাপাশি একটি প্রাণী থাকে, তবে ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে।"
২৫ বছর আগে ছয়টি মিউনিসিপ্যালিটি একসাথে যুক্ত হয়ে মেগাসিটি গঠনের পর এটিই টরোন্টোর ইতিহাসে প্রথম মেয়র উপ-নির্বাচন। ২০১৪ সাল থেকে জন টোরি শহরটির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
তবে মেয়র হিসেবে সুনির্দিষ্ট ভিশনের অভাব ও শহরে জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে না পারার অভিযোগ রয়েছে টোরির বিরুদ্ধে। একইসাথে কোভিড পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি সামাল দিতেও অনেকটা ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।
এতসব সমালোচনার পরেও একাধিকবার টরন্টোর মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন টোরি। গত বছরের অক্টোবরেও বড় ধরণের চ্যালেঞ্জে ছাড়াই তিনি তৃতীয়বারের মতো শহরটির মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তবে নারী সহকর্মীর সাথে সম্পর্ক থাকার বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সেই ধাক্কা সামাল দিতে পারেনি ৬৮ বছর বয়সী বিবাহিত রাজনীতিবিদ টোরি। শহরে বন্দুক সহিংসতা, গৃহহীনতা ও বাসস্থানের অধিক ব্যায় নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা নিয়ে পদত্যাগ করেন তিনি।
রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে টোরির প্রস্থান টরন্টোর মেয়র নির্বাচনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ করে দিয়েছে। ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোর পলিটিকাল সাইন্সের এমেরিটাস অধ্যাপক নেলসন ওয়াইজম্যান এমনটাই মনে করেন।
প্রফেসর নেলসন বলেন, "গতবারের মেয়র নির্বাচন আর এবারের নির্বাচনের মধ্যে তফাৎ রয়েছে। এবারের নির্বাচনে কে বিজয়ী হবে সেটা আন্দাজ করা যাচ্ছে না।"
টরন্টোতে মেয়র প্রার্থী হওয়া বেশ সহজের। একজন ব্যক্তিকে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য ১৮৯ মার্কিন ডলার এবং ২৫ জন নাগরিকের স্বাক্ষর দিতে হয়।
নিউ ইয়র্ক, লস এঞ্জেলস কিংবা শিকাগোর মতো নর্থ আমেরিকার অন্যান্য বড় শহরে রাজনৈতিক দলের পক্ষ হয়ে মেয়র প্রার্থীরা নির্বাচন করেন। কিন্তু টরন্টোতে মেয়র নির্বাচনের সাথে সরাসরি রাজনৈতিক দলের সংযোগ নেই। তাই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পথটিও বেশ সহজ।
ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোর 'স্কুল অফ সিটিস' এর ডিরেক্টর ক্যারেন চ্যাপেল মনে করেন, নির্বাচনী মাঠ অনেক বেশি বিস্তৃত হয়ে যাওয়ায় অনেকে শুধু 'নির্বাচিত হয়েও যেতে পারি' এই মনোভাব থেকে প্রার্থী হয়েছেন। বিষয়টা অনেকটা লাস ভেগাসে জুয়া খেলার মতো।
তবে এতসব প্রার্থী মধ্যে অলিভিয়া চোও এর নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। তিনি ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরি করেছেন এবং বর্তমানে টোরির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
অলিভিয়ার আরেকটি বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি কানাডার বামপন্থী দল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রয়াত নেতা জ্যাক ল্যাটনের স্ত্রী। অন্যদিকে বাকি প্রার্থীর অনেকেই শহরটির বর্তমান কিংবা প্রাক্তন কাউন্সিলর।
নির্বাচনে মলি নামের কুকুর থেকে শুরু করে ১৮ বছর বয়সী ব্যক্তির প্রার্থীর হওয়ার বিষয়টি যেন এক বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বিস্তৃত প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করেছে। তবে এ বিষয়টিকে শহরের নাগরিকদের একতাবদ্ধ না হয়ে খণ্ডিত অবস্থার সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছেন ক্যারেন চ্যাপেল।
নর্থ আমেরিকার চতুর্থ বড় শহর টরন্টোতে প্রায় ৩০ লাখ লোকের বসবাস। এদের মধ্যে অনেকেই আবার অভিবাসী। যার ফলে শহরটিকে পৃথিবীর অন্যতম বৈচিত্র্যপূর্ণ শহর হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
টরন্টো শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে অল্প কিছু সংখ্যক পরিবার হয়তো অত্যাধিক বাড়ি ভাড়ায় সাথে মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু বাকিরা সামর্থ্য না থাকায় অন্যদের সাথে ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকেন। এছাড়াও বাসিন্দাদের প্রতিনিয়ত যানজটে ভোগান্তি ও পাতাল রেলে জায়গা পেতে হিমশিম খেতে হয়।
শহরের এসব সমস্যাগুলোই প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ফুটে উঠেছে। সাবেক পুলিশ প্রধান ও মেয়র প্রার্থী মার্ক সন্ডারস অপরাধ দমনে টরন্টো পুলিশের জন্য বাজেট বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে প্রার্থী অলিভিয়া শহরটির আবাসন সংকট মোকাবেলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবে বিশেষজ্ঞ ও প্রার্থীরা মনে করেন যে, মেয়র নির্বাচনে ১০০ জনেরও বেশি প্রার্থী থাকার বিষয়টির ইতিবাচক ও নেতিকবাচক দুটি দিকই রয়েছে।
ইতিবাচক দিক হচ্ছে, অনেক প্রার্থী থাকার ফলে ভিন্নধর্মী প্রায় সব বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে। তবে এত বেশিসংখ্যক প্রার্থীর ফলে ভোট ভাগ হয়ে যাবে। এতে করে অল্প সংখ্যক ভোট পেয়েও একজন প্রার্থী মেয়র নির্বাচিত হয়ে যেতে পারে।
এদিকে এত প্রার্থীর মাঝে কুকুর মলির মালিক টবি নিজেও স্বীকার করেছেন যে, নির্বাচনে তার জয়লাভের সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। তবে তিনি তার সাত বছরের ছেলের সাথে কথা বলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে টবি তার ছেলেকে বলেছিল যে, "তুমি জানো যে, আমাদের না জেতার সম্ভবনাই বেশি। নির্বাচনে হেরে গেলে তুমি কেমন বোধ করবে?"
উত্তরে টবির ছেলে বলে, "আমি অনেকটা পাগলের মতো বোধ করবো। আমি খুব মন খারাপ করবো। কিন্তু আমি এটা ভেবে খুশি হবো যে, তুমি অন্তত চেষ্টা করেছ। আমার জন্য এটাই যথেষ্ট।"