ন্যাটো সম্মেলন ঘিরে সামরিক সাজসজ্জা, এশিয়াতে বিস্তৃতি নিয়ে চীনের আপত্তিতে জোটে বিরোধ
লিথুয়ানিয়ায় হতে যাওয়া ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলন ঘিরে রাজধানী ভিলনিয়াসে ব্যাপক সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে জোটের সদস্যরা। এক হাজারের বেশি সেনা সমবেত করার পাশাপাশি যুদ্ধবিমান, উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ড্রোনবিধ্বংসী, এবং পারমাণবিক হামলা মোকাবিলার সরঞ্জাম নিয়ে আসা হয়েছে।
এদিকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ও এশিয়ায় ন্যাটো সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা নিয়ে জোটের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। চীনের আপত্তি বিবেচনায় নিয়ে কিছু দেশ সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ন্যাটো সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা যতটা না সামরিক বা কৌশলগত, তারচেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
লিথুয়ানিয়ায় আগামী ১১-১২ জুলাই অনুষ্ঠান হবে আসন্ন ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলন। ইউরোপের ছোট্ট এই দেশটিতে পা রাখতে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ ৪০টি দেশের শীর্ষ নেতারা। তাদের নিরাপত্তায় রীতিমত দুর্গ বানিয়ে ফেলা হয়েছে ভিলনিয়াসকে।
রাশিয়া থেকে মাত্র ১৫১ কিলোমিটার এবং রুশ মিত্র বেলারুশ সীমান্ত থেকে ৩২ কিমি দূরে হতে যাওয়া সম্মেলন ঘিরে নিরাপত্তা নিশ্চিতে লিথুয়ানিয়ায় এক হাজার সেনা পাঠিয়েছে ন্যাটোভুক্ত ১৬টি দেশ। বাল্টিক দেশটিতে উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও পাঠানো হচ্ছে।
লিথুয়ানিয়ার প্রেসিডেন্ট গিতানাস নাওসেদা বলেন, বাইডেনসহ ৪০ দেশের নেতারা আসছে। এ সময় আমাদের আকাশ সুরক্ষিত না রাখা হবে দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ।
বাল্টিক দেশ লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া এবং লাটভিয়া একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ছিল। এখন দেশগুলো একই সঙ্গে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য। প্রতিটি দেশ তাদের বাৎসরিক বাজেটের ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে — যা ন্যাটোভুক্ত অনেক দেশের তুলনায় বেশি।
তবে মাত্র ৬০ লাখ মানুষে বসবাস এই অঞ্চলে। বাজেটের ২ শতাংশ অর্থ দিয়েও পর্যাপ্ত সামরিক সরঞ্জাম মজুত রাখা কিংবা নিজস্ব যুদ্ধবিমান ও উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
তাই সম্মেলন ঘিরে জার্মানি ১২টি প্যাট্রিয়ট মিসাইল লঞ্চার মোতায়েন করেছে। স্পেন দিয়েছে নাসমাস আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ফ্রান্স পাঠাচ্ছে সিজার সেল্ফ-প্রপেলড হাউটজার ক্ষেপণাস্ত্র। ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্ক লিথুয়ানিয়ায় নিয়ে গেছে যুদ্ধবিমান। যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স পাঠাচ্ছে ড্রোন-প্রতিরোধী সরঞ্জাম।
পোল্যান্ড এবং জার্মানি পাঠাচ্ছে বিশেষ অপারেশন বাহিনী। অন্যরা সম্ভাব্য রাসায়নিক, জৈবিক, রেডিওলজিক্যাল এবং পারমাণবিক হামলা মোকাবিলা করার জন্য সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে।
লিথুয়ানিয়ার প্রেসিডেন্ট নাওসেদা বলেন, সম্মেলন ঘিরে জোটের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রচেষ্টা দেখায় যে, বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে স্থায়ী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বসানো উচিত।
এদিকে ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে জোটটির শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। এই সম্মেলনে সদস্য দেশগুলোর বাইরে আরেও যোগ দেবে দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। তবে সম্মেলনের আগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে জোটের সদস্যরা। এশিয়ায় জোটের সম্প্রসারণে চীনের আপত্তির বিষয়টি কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তা নিয়ে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে।
এশিয়ায় ন্যাটোর কার্যক্রম নিয়ে বেইজিংয়ের আপত্তি আছে। তা সত্ত্বেও জাপানের প্রধান মন্ত্রীপরিষদ সচিব হিরোকাজু মাতসুনো বলেন, সম্মেলনে কিশিদা জাপান ও ন্যাটোর মধ্যকার সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেবেন। ইন্দো-প্যাসিফিক এবং ইউরোপের নিরাপত্তা যে অবিচ্ছিন্ন কিছু নয় তা কিশিদার সফরের মাধ্যমে দেখানো হবে। সফরটি এই অঞ্চলে 'ন্যাটোর শক্তিশালী সম্পৃক্ততা' নিশ্চিত করবে।
একজন জ্যেষ্ঠ ইউরোপীয় কূটনীতিক জানান, মিত্ররা চার ইন্দো-প্যাসিফিক দেশের সঙ্গে একটি সম্ভাব্য বিবৃতি নিয়ে আলোচনা করছে। যেখানে দুই পক্ষের মধ্যে গভীর সহযোগিতা স্থাপন ও ইউরোপের নিরাপত্তা এই অঞ্চলের নিরাপত্তার সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কিত — এই বক্তব্য পুনর্ব্যক্ত করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কূটনীতিক আরও বলেন, ন্যাটোর মধ্যে এসব বিষয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। এক পক্ষ চাইছে, সদস্য দেশগুলোতেই ন্যাটোর পূর্ণ মনোযোগ থাকুক। অন্য পক্ষ বলছে, জোটের নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করে এমন বিষয়গুলোতেও নজর দেওয়া উচিত।
গত বছর চীনকে জোটের জন্য হুমকি হিসেবে ঘোষণার পর ন্যাটো এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার চেষ্টা করে। কিন্তু মে মাসে যখন এশিয়ায় ন্যাটোর প্রথম কার্যালয় খোলার পরিকল্পনা উত্থাপিত হয়, তখন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ জোটের পরিধি বাড়ানোর যে কোনো প্রচেষ্টা একটি 'বড় ভুল' হবে বলে সতর্ক করেন।
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমনের পর থেকে এখন পর্যন্ত ক্রেমলিনের বিরোধীতা করেনি চীন। বরং দেশটির সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। চীন ও রাশিয়ার এই অংশীদারিত্বকে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার অবমাননা হিসেবে নিন্দা করে ন্যাটো ঘোষণা দেয়, চীন জোটের জন্য একটি 'পদ্ধতিগত চ্যালেঞ্জ' তৈরি করেছে।
সম্প্রতি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া সফর করা ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেন, 'এশিয়ায় যা ঘটে তা ইউরোপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং ইউরোপে যা ঘটে তা এশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।'
ন্যাটো প্রধানের বিবৃতি এমন সময়ে এসেছে যখন ওয়াশিংটন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বহুপাক্ষিক কার্যকলাপ বিকাশের চেষ্টা করছে। চীন বলছে, তার উত্থান ঠেকাতেই যুক্তরাষ্ট্র এমনটা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সে প্রচেষ্টার কিছুটা প্রতিফলন ইতোমধ্যে দেখা গেছে। চলতি বছরের শুরুতে কিশিদা সামরিক সম্পর্ক জোরদার করতে ইউরোপ সফর করেন। এরপর ন্যাটোর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মহড়ায় অংশ নেয় জাপানি বিমান বাহিনী। আর 'যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদে' পূর্ব ইউরোপের মতো জায়গায় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রি দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।
ইউরোপও বুঝতে পেরেছে, ইন্দো-প্যাসিফিকে তাদেরকেও বৃহত্তর ভূমিকা পালন করতে হবে। জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের এখনকার চেয়ে বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। আমি বিশ্বাস করি সবাই এই বিষয়ে সচেতন।'
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান সম্প্রতি টোকিওতে বলেছেন, এ বছরের ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে চারটি ইন্দো-প্যাসিফিক দেশের সঙ্গে অংশীদারিত্ব বাড়ানোর নিয়ে একটি পৃথক সেশন থাকবে। জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম লেনদেনসহ নতুন সহযোগিতার মূল বিষয়গুলোর ঘোষণা দেবে বলেও জানা গেছে।
জাপানের সাবেক উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং নিম্নকক্ষের নিরাপত্তা কমিটির বর্তমান সদস্য আকিহিসা নাগাশিমা বলেন, আমাদের যে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে তা হলো, দেশ হিসেবে জাপানের শক্তির একটি সীমা আছে। জাপানকে যদি ন্যাটের সমস্ত অভিযানে অংশ নিতে হয় তাহলে তার নিজের আশেপাশের অঞ্চল অবহেলিত থেকে যাবে।
গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনা নজরদারি বেলুন দেখা যাওয়ার পর থেকে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বেইজিং সফরের পর পরিস্থিতি কিছুটা নমনীয় হয়েছে। তা সত্ত্বেও সংঘাতের সূত্রপাত হতে পারে এমন একটি ঘটনার সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক করে চলেছেন এশীয় নেতারা।
চীন এশিয়ায় ন্যাটোর অনুরূপ জোট গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেছে। সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে ওয়াশিংটন।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন জুন মাসে সাংবাদিকদের বলেন, 'এই অঞ্চলের অধিকাংশ দেশের মনোভাব খুবই স্পষ্ট। তারা সামরিক ব্লকের উত্থানের বিরোধিতা করে। এশিয়ায় ন্যাটোর প্রবেশকে তারা স্বাগত জানায় না।'
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন বা রাশিয়ার মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নেওয়ার মতো বিষয়কে এড়িয়ে যাচ্ছে। কিছু দেশ এমনকি ইউক্রেনের প্রতি ন্যাটোর দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী।
ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রবোয়ো সুবিয়ান্টো গত মাসে চীনের অনুরূপ একটি শান্তি প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন বলেন, ইউক্রেনের পক্ষে এখন রাশিয়ার দখলে থাকা সমস্ত অঞ্চল পুনরুদ্ধার করা 'অসম্ভব' হবে।
সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্র বিষয়ক সাবেক স্থায়ী সেক্রেটারি বিলাহারি কৌসিকানের মতে, চীন নিয়ে উদ্বেগ বাড়ায় এশিয়ায় ন্যাটোর কার্যক্রম প্রাথমিকভাবে এই অঞ্চলে মার্কিন মিত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে।
এই অঞ্চলে ন্যাটোর সম্পর্ক জোরদার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সামরিক বা কৌশলগত তুলনায় এর তাৎপর্য অনেক বেশি রাজনৈতিক।