ওয়াগনার বিদ্রোহ: 'কী ঘটছে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না!' মুখ খুলল এক জুনিয়র কমান্ডার
গত ২৩ জুন রাশিয়ার 'বিশ্বস্ত' মার্সেনারি বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপ প্রিগোজিনের নেতৃত্বে পুতিনের নেতৃত্বাধীন রুশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। যদিও খুব অল্প সময়েই মধ্যেই পুতিন এ বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়েছিল। তবুও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে আচমকা এ বিদ্রোহ যেন মস্কোর শক্তিতে কিছুটা হলেও আঘাত হেনেছে।
বিদ্রোহের পর সেটি নিয়ে ওয়াগনার সেনারা গণমাধ্যমে তেমন কোনো কথা বলেননি। তবে সম্প্রতি বিদ্রোহে অংশ নেওয়া ওয়াগনার গ্রুপের এক সেনা সদস্য বিবিসির কাছে নিজ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। মার্সেনারি গ্রুপটিতে জুনিয়র কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা গ্লেব (ছদ্মনাম) জানান, বিদ্রোহের সময় তিনি ও তার সহযোদ্ধাদের কোনো ধারণাই ছিল না যে আসলে কী ঘটছে।
বিদ্রোহের মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ওয়াগনার বস ইয়েভগেনি প্রিগোজিন রাশিয়ার দক্ষিণের শহর রোস্তভের দিকে সৈন্য পাঠায়। তারপরে দ্রুতগতিতে মস্কোর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
বিদ্রোহে অংশ নেওয়ার আগে গ্লেব মুলত পূর্ব ইউক্রেনের বাখমুত শহরে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করছিলেন। প্রিগোজিনের নেতৃত্বে বিদ্রোহ শুরুর মুহূর্তে তিনি রাশিয়া অধিকৃত লুহানস্ক অঞ্চলের একটি ব্যারাকে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।
২৩ জুন সকালে গ্লেব একটি ইউনিটের সাথে যুক্ত হয়ে ইউক্রেন ত্যাগের নির্দেশ পান। মুলত নির্দেশটি এসেছিল একজন উচ্চপদস্ত ওয়াগনার কমান্ডারের কাছ থেকে।
নিরাপত্তাজনিত কারণে কমান্ডারের নামটি বলতে রাজি হননি গ্লেব। তবে ঐ কমান্ডার ওয়াগনার বস প্রিগোজিন ও ওয়াগনার কমান্ড কাউন্সিলের নির্দেশেই কাজ করছিলেন বলে জানান তিনি।
গ্লেব জানান, ইউনিটটিতে যথেষ্ট পরিমাণে সৈন্য ছিল। তবে ঠিক কোন জায়গায় উদ্দেশ্য তারা যাত্রা শুরু করেছে সেটা তিনি প্রথমদিকে জানতেন না। এমনকি ইউনিটটি যখন ইউক্রেন যুদ্ধের অগ্রভাগ থেকে পিছু হটছিল, তখন গ্লেব বেশ অবাক হয়েছিল।
অনেকটা বিনা প্রতিরোধেই ওয়াগনার সৈন্যরা রাশিয়ার রোস্তভ শহরে প্রবেশ করেছিল। গ্লেব বলেন, "আমি সেখানে কোনো সীমান্তরক্ষী সদস্য দেখিনি। কিন্তু শহরটির পুরো পথজুড়ে ট্র্যাফিক সদস্যরা আমাদের স্যালুট জানাচ্ছিল।"
ওয়াগনার গ্রুপের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলোর দাবি অনুযায়ী, বিদ্রোহের সময় গ্রুপটি রাশিয়ার সীমান্তে প্রবেশ করতে গেলে বুগায়েভকা চেকপয়েন্টে থাকা সীমান্তরক্ষীরা নিজেদের অস্ত্র নামিয়ে ফেলে। গ্রুপটিকে প্রতিহত করা থেকেও সীমান্তরক্ষীরা বিরত থাকে।
বিদ্রোহ করা ওয়াগনার গ্রুপটি রোস্তভে পৌঁছানোর পর সকল যোদ্ধাদের কাছে শহরটির আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও মিলিটারী বিমানবন্দর দখলের নির্দেশ দেওয়া হয়। গ্লেবের ইউনিটকে রুশ ফেডারাল সিকিউরিটি সার্ভিসের আঞ্চলিক অফিসটির নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়।
গ্লেবের ইউনিটটি সিকিউরিটি সার্ভিসের ভবনটিতে পোঁছানোর পর দেখেন, ভবনটি খালি অবস্থায় পুরোপুরি বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। ভেতরের অবস্থা জানতে ইউনিটটির পক্ষ থেকে ড্রোন ব্যবহার করা হয়।
অবশেষে আধা ঘণ্টা পর ভবনটির একটি দরজা খুলে রাস্তায় দুইজন লোক বেরিয়ে আসে। ইউনিটটির উদ্দেশ্যে তারা বলেন, "চলুন, একটা সমঝোতা করি।" উত্তরে গ্লেব বলেন, "এখানে সমঝোতা করার কী আছে? এটা আমাদের শহর।"
গ্লেব জানান, আমরা শুধু এটা সম্মত হই যে, দুই পক্ষ একে অপরের সাথে সংঘর্ষে জড়াবো না। ভবনটি থেকে ঐ লোকেরা শুধু কখনো কখনো ধূমপান করতে বের হতেন।
শুধু সিকিউরিটি সার্ভিসের আঞ্চলিক ভবনটিই নয়, বরং রোস্তভে থাকা সাংবাদিকদের তথ্যমতে শহরটির অন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার চিত্রও এমনটাই ছিল। গুরুত্বপূর্ণ ঐ ভবনগুলো থেকে কাউকে বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি। তবে ডেলিভারি করে খাবার আনার সুযোগ ছিল।
যখন শহরটিতে এতসব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তখন ওয়াগনার বস প্রিগোজিন দক্ষিণ রাশিয়ার সামরিক দপ্তরে রাশিয়ার ডেপুটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইউনুস-বেক ইয়েভকুরভ ও ডেপুটি চিফ অফ জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভ্লাদিমির আলেক্সিয়েভের সাথে বৈঠকে বসেন।
বৈঠকে প্রিগোজিন চিফ অফ জেনারেল স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই শোইগুর সাথে সাক্ষাত করানোর দাবি জানান। এদিকে ওয়াগনার বসের এ বৈঠকের সময় গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা দিমিত্তি উটকিনের নেতৃত্বে একটি সেনাদল মস্কোর অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছিল।
তখন ঠিক যা যা ঘটছিল সে সম্পর্কে গ্লেব জানতেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে গ্লেব স্পষ্টভাবে বলেন, "আমি কিছুই জানতাম না। আপনাদের মতোই আমরাও টেলিগ্রাম থেকে যতটুক জানার সেটা জানতে পেরেছি।"
এদিকে দিন যত গড়িয়েছে, রোস্তভে যা ঘটছিল সেটার কিছু কিছু ছবি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছিল। ছবিতে দেখা যায়, স্থানীয় বাসিন্দারা, এমনকি স্থানীয় সাংবাদিকরাও শহরটি দখল করে থাকা ওয়াগনার যোদ্ধাদের সাথে হাসছেন, কথা বলছেন।
গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ওয়াগনার গ্রুপে বহু বন্দী বা দণ্ডিতরা যোগ দিয়েছেন। তারা গ্রুপটির নিয়মনীতি সম্পর্কে একটু উদাসীন বলে জানান গ্লেব।
কিন্তু গ্লেবের মতো যারা আরও আগে থেকেই ওয়াগনার গ্রুপের সদস্য, তারা গ্রুপটির নিয়মনীতি বেশ কঠোরভাবে মেনে চলেন।
গ্লেব জানান, গত বসন্তেই সিনিয়র কমান্ড কর্তৃক কোনো গণমাধ্যমের সাথে কথা না বলতে ওয়াগনার সেনাদের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল। এমনকি কেউ এই নির্দেশ ভঙ্গ করলে মৃত্যুর হুমকিও দেওয়া হয়।
বিদ্রোহের একদিন পর ২৪ জুন বিকেলে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গ্লেবের সাথে যোগাযোগ করেন। ঐ কর্মকর্তা গ্লেবকে কোনোরুপ ব্যাখ্যা ছাড়াই ইউনিটসহ লুহানস্কের ছাউনিতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন।
ছাউনিতে ফেরার পথে গ্লেব টেলিগ্রামের মাধ্যমে জানতে পারেন যে, প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে ঐ অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওয়াগনার বসকে বেলারুশে চলে যেতে হবে।
এছাড়াও পথিমধ্যে গ্লেবের ইউনিটটি জানতে পারেন, প্রেসিডেন্ট পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্তি পেসকভ জানিয়েছেন, বিদ্রোহের অংশ নেওয়া ওয়াগনার যোদ্ধাদের শাস্তি দেওয়া হবে না।
তবে বিদ্রোহ করা গ্লেব ও তার ইউনিটটি বর্তমানে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পরিস্কার কোনো নির্দেশনা পাচ্ছেন না। তারা লুহানস্কের ব্যারাকে অবস্থান করছেন এবং পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছেন।
বর্তমানে গ্লেবের ইউনিটটি 'লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিক' নামের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী মিলিটারি গ্রুপের অধীনে রয়েছে। এই গ্রুপটি ওয়াগনার গ্রুপের সৈন্যদের ও তাদের কাছে থাকা অস্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কৌতূহলী।
পরিশেষে গ্লেবকে জিজ্ঞাসা করা হয়, "এখনো কেন তিনি ওয়াগনার গ্রুপ ছেড়ে যাননি"। জবাবে গ্লেব বলেন, "আমার চুক্তির মেয়াদ এখনো শেষ হয়নি।"