রূপকথার মতো এক প্রেমের সমাপ্তি; জাস্টিন ট্রুডো-সোফি জুটির সম্পর্কের আদ্যোপান্ত
দীর্ঘ ১৮ বছর সংসার করার পর স্ত্রী সোফি গ্রেগোয়ার ট্রুডোর সঙ্গে বিচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। কানাডার সবচেয়ে পরিচিত মুখ, পাওয়ার কাপল হিসেবে বিবেচিত এই জুটির বিচ্ছেদ এই মুহুর্তে দেশটির সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয়।
দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিকভাবে উচ্চাভিলাষী পুত্র, আর কুইবেকের এক লাবণ্যময়ী উপস্থাপক; উদীয়মান দুই কানাডিয়ান তারকার যে বন্ধনকে একসময় গল্পের বই থেকে উঠে আসা সুন্দর কোনো গল্প বলে আখ্যা দেওয়া হতো, বুধবার (৩ জুলাই) তার সমাপ্তি ঘটেছে।
মঙ্গলবার রাত ১২টার পরপরই জাস্টিন ট্রুডো এবং গ্রেগোয়ার ট্রুডো, দুজনের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে আলাদা আলাদাভাবে ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় তাদের বিচ্ছেদের খবর ঘোষণা করা হয়।
ওই পোস্টে তারা বলেছেন, "সিদ্ধান্তটি নেওয়ার আগে আমাদের মধ্যে অনেকভাবেই আলোচনা হয়েছিল। যা ছিল অর্থবহ এবং জটিল।"
জাস্টিন ট্রুডো ও সোফি ২০০৫ সালে বিয়ে করেন এবং তাদের সংসারে জাভিয়ের (১৫), এলা-গ্রেস (১৪) এবং আদ্রিয়েন (৯) নামের তিন সন্তান রয়েছে।
"অন্য সবসময়ের মতোই, আমরা একে অপরের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাসহ এবং যা কিছু আমরা একসাথে গড়েছি ও গড়বো, সেইসবের জন্যও একটি ঘনিষ্ঠ পরিবারের মতো থাকব। আমাদের সন্তানদের কল্যাণের জন্য আমরা আমাদের এবং তাদের গোপনীয়তা বজায় রাখার অনুরোধ করছি আপনাদের", বলেন তারা।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেওয়া আলাদা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আগামী সপ্তাহে ট্রুডো পরিবার একসঙ্গে ছুটি কাটাতে যাবে। তারা জানায়, ট্রুডো ও সোফি দুজনেই বিচ্ছেদের জন্য আইনিভাবে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন।
কার্যালয় থেকে আরও জানানো হয়, "তারা ঘনিষ্ঠ পরিবারের মতোই থাকবে, আর সোফি এবং প্রধানমন্ত্রী তাদের সন্তানদের একটা নিরাপদ, স্নেহময় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে বড় করার দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। সন্তানদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাবা-মা দুজনেরই সক্রিয় উপস্থিতি থাকবে এবং কানাডিয়ানরা প্রায়ই তাদের পুরো পরিবারকে একসঙ্গে দেখতে পাবেন।"
ট্রুডোর সন্তানরা অটাওয়াতে রিদু হল গ্রাউন্ডে রিদু কটেজেই বসবাস করবেন। তবে সোফি শহরের অন্য কোথাও আলাদা বাড়িতে থাকা শুরু করবেন বলে জানা গেছে; তবে রিদু কটেজেও তার আসা-যাওয়া থাকবে।
ট্রুডোর বিয়ে নিয়ে কয়েক বছর ধরেই অটাওয়াতে নানা চর্চা চললেও, তাদের ব্যক্তিগত বিরোধ কখনো খবরের শিরোনাম হয়নি।
এদিকে, বিচ্ছেদের খবরে ট্রুডো পরিবারের শুভানুধ্যায়ীদের অনেকেই ব্যথিত হয়ে সহানুভূতি জানিয়েছেন। অনেকে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, ব্যক্তিগত জীবনের বোঝাপড়া ট্রুডোর রাজনৈতিক জীবনেও প্রভাব ফেলতে পারে। তবে প্রধানমন্ত্রীর জননিরাপত্তা মন্ত্রী ডমিনিক লেব্ল্যাঙ্ক এমপিদের আশ্বাস করে জানিয়েছেন, ট্রুডো ভালো আছেন এবং তার ব্যক্তিগত জীবনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে হৈ চৈ তৈরির কিছু নেই।
গত জুলাই থেকেই প্রধান প্রধান পাবলিক ইভেন্টগুলোতে অনুপস্থিত ছিলেন সোফি। এমনকি রিডু হলে 'মেজর কেবিনেট শাফল' অনুষ্ঠানে এবং লিথুয়ানিয়ার ভিলনিয়াসে সামরিক জোটের শীর্ষ সম্মেলনে ন্যাটোর নেতা ও তাদের স্ত্রীদের সম্মানে আয়োজিত ডিনারেও অনুপস্থিত ছিলেন তিনি।
ট্রূডো ও তার স্ত্রীর মধ্যে যে মনোমালিন্য চলছে তা গণমাধ্যমেও তেমন টের পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র ২০১৫ সালে সাংবাদিক লরা স্টোনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলেছিলেন- যখন সিবিসি'র সাক্ষাৎকারে ট্রুডোর স্মৃতিচারণ নিয়ে সোফিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল।
ট্রুডোকে পরকীয়া বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল এবং ট্রুডো তা অস্বীকার করেছিলেন। এই প্রসঙ্গ সোফির কাছে তুলতেই তিনি হেসেছিলেন যে তাদের ব্যক্তিগত জীবন এখন সবার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।
ঐ সময় তিনি বলেছিলেন, "আমি আপনাকে এটুকু বলতে পারি যে বিয়ে খুব সহজ জিনিস নয়। আমরাও যে কষ্টের মধ্য দিয়ে গিয়েছি সেটা নিয়ে আমি একরকম গর্বিতই বলা যায়; হ্যাঁ, কারণ আমরা অকৃত্রিমতা চাই। আমরা দুজনেই স্বপ্নচারী এবং আমরা যতদিন সম্ভব একসঙ্গে থাকতে চাই।"
তবে কানাডিয়ানরাও নিয়মিতই ট্রুডো-সোফির প্রেমের সব খবর রেখেছেন। ট্রুডো ২০০৪ সালের ১৮ অক্টোবর সোফিকে প্রস্তাব দেন এবং সেদিন ছিল তার বাবার ৮৫তম জন্মদিন।
ওই দিনের কথা স্মরণ করে এক সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে ট্রুডো বলেছিলেন, "শ্যাম্পেন আর ওয়েস্টার ছিল খাবারের তালিকায়। আর আমি হাঁটু গেঁড়ে বসে তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম।"
ট্রুডো-সোফির বিয়ের খবর দেশটির গণমাধ্যমের প্রথম পাতাজুড়ে ছিল। ২০০৫ সালের মে মাসে তারা বিয়ে করেন, যাকে 'রূপকথার গল্পের মতো এক বিয়ে' বলে আখ্যা দিয়েছিল শাতেলেন ম্যাগাজিন।
ওই সময় ট্রুডো তার রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে অনুমানধর্মী মন্তব্য করেছিলেন, আর সোফি বলেছিলেন- এমনটা ঘটলেও তিনি মানিয়ে নিতে পারবেন বলে তার বিশ্বাস।
২০১৫ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে লিবারেল পার্টি জয়লাভ করে, পরের বছর ১৬এপ্রিলে ভোগ ম্যাগাজিনে উঠে আসে জাস্টিন ট্রুডোর প্রোফাইল। ওই নিবন্ধটি হয়তো খুব কম মানুষই মনে রেখেছেন, কিন্তু নিবন্ধের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ট্রুডো সোফিকে জড়িয়ে ধরা দুর্দান্ত ছবিটি নিশ্চয়ই এখনও অনেকের মনে আছে।
আলোকচিত্রী নরম্যান জিন রয় এর তোলা ছবিটির ক্যাপশনে ছিল: "ট্রুডোর স্ত্রী সোফি গ্রেগোয়ার ট্রুডো তাদের প্রথম ডেটের কথা স্মরণ করে বলেন, 'ডিনার শেষে সে (ট্রুডো) আমাকে বলেছিল, আমার বয়স এখন ৩১ বছর এবং আমি এই ৩১ বছর শুধু তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি।"
ট্রুডো ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী এবং পরবর্তী ফেডারেল নির্বাচনে লিবারেলদের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যদিও পার্টির অন্দরের লোকেরা বলছেন ২০২৫ সালের আগে ভোট হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত জীবনের এমন একটি সিদ্ধান্ত তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ও দলের নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছার উপর কতটা প্রভাব ফেলবে তা এখনও স্পষ্ট নয়।
জাস্টিন ট্রুডোর বাবা, সাবেক কানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রী পিয়ের ট্রুডো এবং মা মার্গারেটের ডিভোর্স হয়েছিল ১৯৮৪ সালে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পিয়েরের শেষ সময়টাতে। যদিও ১৯৭৭ সাল থেকেই তারা আলাদা থাকতে শুরু করেছিলেন।
জাস্টিন ট্রুডো প্রায় ৮ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন এবং তিনটি নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন।
১৯৭৯ সালে 'বিয়ন্ড রিজন' নামক স্মৃতিকথায় মার্গারেট নাটকীয় ভঙ্গিতে একজন প্রধানমন্ত্রীকে বিয়ে করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন। এদিকে সোফি গ্রেগোয়ারও নিজে বই লিখছেন। 'ক্লোজ টুগেদার' নামের বইটিতে তার 'আত্ম-জ্ঞান, গ্রহণযোগ্যতা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি'গুলো থাকবে।
জানা গেছে, এ বইয়ে গ্রেগোয়ার নানা প্রশ্ন করবেন যা মানুষের মানসিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। যেমন, তিনি প্রশ্ন করবেন- "সম্পর্ক থেকে আমরা আসলে কি চাই, আর আমরা সেখানে কি অবদান রাখতে পারি?" আরও একটি প্রশ্ন হলো, "যা আমাদের জীবনে উপকারী নয়, তাকে বিদায় জানানোর উপায় কি?"