যুদ্ধে যাওয়া এড়াতে দেশ ছাড়ছে ইউক্রেনের তরুণেরা, যুদ্ধ নিয়ে মনোভাবও বদলাচ্ছে তাদের
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার সময় কিয়েভের উপকণ্ঠে পরিবারের সঙ্গে বাস করত ১৭ বছর বয়সী ওলেগ স্ট্রিলেটস। রাশিয়ানরা তখন ইউক্রেনের রাজধানী দখল করার চেষ্টায় ছিল।
মার্চ মাসে দেশ ছেড়ে পোল্যান্ডে চলে যায় ওলেগ। এরপর রাশিয়ান বাহিনী কিয়েভ থেকে সরে আসে, পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। তখন পুনরায় দেশে ফিরে আসে ওলেগ।
কিন্তু ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন হয় না। পরে আবারও দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় ওলেগ। শিক্ষার্থী ও মিউজিক কম্পোজার ওলেগ ফের পোল্যান্ডে চলে যায়। এখনো দেশে ফেরেনি সে।
ওলেগের বয়স ১৮ বছর পার হয়েছে, তাই সে এখন আইনগতভাবে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার উপযুক্ত। তার মতো প্রাপ্তবয়স্ক আরও অনেক তরুণই বর্তমানে বাধ্যতামূলক সশস্ত্রবাহিনীতে যোগ দেওয়া এড়ানোর উদ্দেশ্যে ইউক্রেন ত্যাগ করে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে।
ইউক্রেনের মার্শাল আইন অনুযায়ী, ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী যারা যুদ্ধ করতে সক্ষম, তারা দেশ ছেড়ে যেতে পারবেন না। অবশ্য এক্ষেত্রে কিছু ছাড় রয়েছে।
তিন বা তার অধিক সন্তান থাকা, সামরিক অক্ষমতার সার্টিফিকেট থাকা, অন্য কারও ওপর নির্ভরশীল থাকা, বিদেশে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে পড়ুয়াদের সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক নয়।
তবে ওলেগের এসব কিছুই নেই। সে যুদ্ধ করতে যেতে চায় না। অবশ্য তার বেশকিছু বন্ধু ফ্রন্টলাইনে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ওলেগ নির্দ্বিধায় স্বীকার করে, 'আমার খুব ভয় করে, জানেন তো? পোল্যান্ডে আসতে খারাপ লেগেছে কিন্তু ওখানে (ইউক্রেনে) থাকার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।'
তবে ওলেগের দেশ ছেড়ে যাওয়ার মূল সিদ্ধান্ত অবশ্য ডনবাসে থাকা তার মা-বাবাই নিয়েছেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরপই তারা ওলেগকে ঘরের বাইরে যেতে মানা করেন।
মার সঙ্গে ঝগড়াও করেছিল ওলেগ। বেশ উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছিল দুজনের। শেষতক মা একদম জোর গলায় স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন, ওলেগকে ইউক্রেন ছেড়ে পোল্যান্ডে যেতে হবে।
এখন পোল্যান্ডে ওলেগ এক নারী ও তার দুই সন্তানের সঙ্গে বাস করে। মা-বাবা ইউক্রেন থেকে কিছু পাঠায়, আর শরণার্থী হওয়ার কারণে পোলিশ সরকারও তাকে কিছু সাহায্য করে।
যুদ্ধ শেষ হলে পোল্যান্ডে থাকতে ভালো না লাগলে ওলেগ আবার দেশে ফিরে যাবে। তবে সে কখনো হাতে রাইফেল তুলে নেবে না বলেই যেন শপথ করেছে।
মার্শাল ল-এর মাধ্যমে ইউক্রেন চাইলেই জোর করে দেশের যেকোনো সক্ষম নাগরিককে সেনাদলে ভর্তি করাতে পারে। তবে সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত তার দরকার হয়নি।
যদিও বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতির সাপেক্ষে মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে আরও নতুন সেনার দরকার হতে পারে ইউক্রেনের। কিন্তু রাশিয়ার চেয়ে ইউক্রেনের জনসংখ্যা অনেক কম। তাই জনসাধারণ থেকে সেনা সংগ্রহ করা দেশটির জন্য কঠিন হতে পারে।
ইউক্রেনের সরকারি তথ্যমতে, এ বছর দুই লাখের বেশি ইউক্রেনীয় ছেলের বয়স ১৮ বছর হবে।
আগামী বছর ১৮ বছরে পা দেবে র্যাডিয়ন। তবে তার পরিকল্পনা আছে একটা। সে ইউক্রেনে থেকেই পড়ালেখা করতে চায়।
'পরিস্থিতি দেখব। যুদ্ধ এভাবে চলতে থাকলে হয়তো ইউরোপে চলে যাব, খুব সম্ভবত বার্লিনে,' র্যাডিয়ন বলে। বর্তমান যুদ্ধ যেভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে — তা নিয়ে বেশ উচ্চকণ্ঠ সে। 'আমি অনেক কথা শুনেছি। আর আমি এটাও জানি, আমাকে যুদ্ধ করতে পাঠালে আমি মারা পড়ব।'
ইউক্রেনের পার্লামেন্ট নতুন একটি আইন তৈরির বিষয়ে আলোচনা করছে। এ আইনটি কার্যকর হলে ১৬ থেকে ১৮ বছরের কেউ প্রাপ্তবয়স্ক কারও সঙ্গ ছাড়া ইউক্রেনের সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবে না। এ আইনটি করা হচ্ছে তরুণদের বিপথে যাওয়া রুখতে।
দেশে থাকলে র্যাডিয়ন কিয়েভের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় কিয়েভ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-মোহিলা অ্যাকাডেমিতে ইকোলজি নিয়ে পড়তে চায়।
যুদ্ধ প্রসঙ্গে র্যাডিয়নের ভাষ্য, 'প্রথমে আমি সরকারে কথা বিশ্বাস করেছিলাম। তারা বলেছিল, আমরা রাশিয়ানদের হারিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে, তারা স্রেফ একে অপরকে খুন করছে। আমি বলছি না সবটাই প্রোপাগান্ডা, কিন্তু বোধহয় ওরা যা বলে তার ৮০ শতাংশই…।'
রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে লড়ার আরেকটি পথ খুঁজে নিয়েছে র্যাডিয়ন। সে খোলামেলাভাবে স্বীকার করে, রাশিয়ান সেনাদের সঙ্গে প্রতারণা করে তাদেরকে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের লোভ দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে সে।
সম্প্রতি জেলেনস্কি ইউক্রেনের সেনা নিয়োগের আঞ্চলিক সকল প্রধানদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। কারণ, এসব নিয়োগকর্তাদের ঘুষ নিয়ে মানুষজনকে যুদ্ধের জন্য অনুপযুক্ত ঘোষণা করার ১১২টি ঘটনা সামনে এসেছে।
১৭ বছর বয়সী বোগদান সবে হাইস্কুলের পাট চুকিয়েছে। ইতোমধ্যে সে একটি পুলিশ অ্যাকাডেমিতে যোগদানের আবেদন করেছে। তার মাও পুলিশ বাহিনীতে কাজ করেন।
ভবিষ্যতে তার সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগদানের ইচ্ছা রয়েছে। কিন্তু আপাতত সে পুলিশেই কাজ করতে চায়। রাশিয়ান সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় পোস্টিং হতে পারে, তবে এ নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। পুলিশ হলে তাকে আপাতত আর সশস্ত্রবাহিনীতে যোগ দিতে হবে না।
ইউক্রেনের আরও অনেক তরুণের মতো বোগদানও মনে করে, যুদ্ধের পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। 'আমি যুদ্ধে যেতে চাই না, কারণ অসংখ্য মানুষ যুদ্ধে গিয়েছে কিন্তু আর ফেরত আসেনি,' সে বলে।
১৯ বছর বয়সী দিমিত্র তুখোড় মিউজিশিয়ান। এ বয়সেই সে পিয়ানোসহ আরও অনেক সঙ্গীতযন্ত্র বাজানো শিখে গেছে। তবে যুদ্ধে যাওয়ার বাধ্য-বাধকতা নিয়ে ভয় নেই তার।
'বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার বিষয়ে আমার ভয় নেই। কারণ আমি বিশ্বাস করি মিউজিশিয়ান বলে তারা আমাকে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করবে না,' দিমিত্র জানায়। যদিও বর্তমান আইনের ব্যতিক্রম অংশে মিউজিশিয়ান হওয়ার কথা কোথাও লেখা নেই।
'আমরা স্বাধীন মানুষ, তারা আমাদেরকে যুদ্ধে যেতে জোর করতে পারেন না,' বলে দিমিত্র। 'আর আমি গান করতে চাই, আমাকে ওটাই করতে দিন না।'
এ যুদ্ধকে আসল বলে মনে করে না সে। 'এটা স্রেফ ব্যবসা, পুরোটাই ব্যবসা,' সে বলে। অন্যদের যুদ্ধে যাওয়া নিয়ে তার আপত্তি নেই। 'কিন্তু সরকার যখন আপনাকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বলে, তখন আমার খুব রাগ লাগে।'