ইউক্রেনের মন্থরগতির পাল্টা আক্রমণ নিয়ে ক্রমশ হতাশ হচ্ছেন দেশটির সাধারণ মানুষ
ইউক্রেনে পাল্টা আক্রমণের হতাশাজনক গতি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম দখল করে আছে। তবে আনাস্তাসিয়া জামুলা'র জন্য বিষয়টি যেন আরও একটু কঠিন।
জামুলা সিভিট নামক একটি সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতা। সম্পূর্ণ নারীদের দ্বারা পরিচালিত স্বেচ্ছাসেবী এ সংস্থাটি যুদ্ধক্ষেত্রে ফ্রন্টলাইনে থাকা ইউক্রেনীয় সেনাদের নানাভাবে সমর্থন প্রদান করে।
সিভিট সাধারণ মানুষের কাছে তাদের কাজের জন্য সহায়তার আবেদন করে। কিন্তু ইউক্রেন পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে দ্রুত কিছু অর্জন করবে, এমন প্রত্যাশা দেশটির জনগণের মাঝে ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। ফলে মানুষের কাছ থেকে আজকাল সাড়া পেতে কষ্ট হচ্ছে জামুলার।
ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের মধ্যে এখন বিষণ্ণতার আভাস। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রতি সমালোচনা ক্রমেই বাড়ছে। আর মানুষের অসন্তুষ্টির কারণও স্পষ্ট। একসময় কিয়েভের নেতারা সগর্বে বলেছিলেন, তারা রাশিয়ার দখলীকৃত ক্রিমিয়া পুনরায় ফিরিয়ে আনবেন। এখন তারা আরও বাস্তবিক লক্ষ্য অর্জনে মনোযোগ দিচ্ছেন।
দেশটির প্রেসিডেন্ট দপ্তরের একজন মুখপাত্র সেরি লেশেঙ্কো বলেছেন, 'এখানে কিয়েভে বসে সামরিক বাহিনীর সমালোচনা করার আমাদের কোনো অধিকার নেই। প্রতি মিটার সামনে এগোনোর দাম চোকাতে হচ্ছে রক্ত দিয়ে।'
ইউক্রেনের নেতারা আরেকটি ব্যাপার নিয়েও হতাশ — পশ্চিমারা যে পরিমাণ অস্ত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার সবটা এখনো কিয়েভের হাতে আসেনি। লেশেঙ্কোর ভাষায়, এটি 'হতাশাজনক ও উৎসাহ মিইয়ে দেওয়ার মতো'।
নতুন অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে পশ্চিমা মিত্ররা স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র আগামী বছর ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পুনরায় তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে পারেন — এমন ধারণাও তৈরি হচ্ছে। এসব বিষয় ইউক্রেনের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ইউক্রেনের জেনারেল স্টাফের একটি অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, পশ্চিমারা কয়েকশ লেপার্ড ট্যাংক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও ইউক্রেন কেবল ৬০টি ট্যাংক পেয়েছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষাব্যূহের মাইনফাঁদ এড়ানোর জন্য ইউক্রেনের মাইনবিধ্বংসী সাঁজোয়া যান দরকার। কিন্তু সেগুলোও পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই কিয়েভের কাছে।
ওই সূত্রের ভাষ্যে, 'পশ্চিমারা আমাদেরকে যে ধরনের সম্মুখ আক্রমণ পরিচালনার করতে বলছে, তার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম-রসদ স্রেফ নেই।'
আকাশ থেকে যুদ্ধবিমানের সমর্থনের অভাবও ইউক্রেনের জন্য একটি বড় সমস্যা। ইউক্রেন পাল্টা আক্রমণ যতটা সম্ভব দেরি করে শুরু করেছে। জুলাইয়ে শুরু হওয়া ওই অভিযান প্রথম থেকেই ভালো যায়নি। ওই সময় পশ্চিমে প্রশিক্ষিত দুটো ব্রিগেড রাশিয়ার স্থাপন করা মাইনফিল্ডে বিপুলসংখ্যক সেনা ও যুদ্ধাস্ত্র হারায়। তখন প্রাথমিক পরিকল্পনা আবার নতুন করে সাজায় ইউক্রেন। এরপর থেকে সেনাক্ষয় কমানোকে প্রাধান্য দিয়েছে কিয়েভ।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইউক্রেন দক্ষিণাঞ্চলের ফ্রন্টলাইনে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ভেদ করে বেশ কিছুটা এগিয়েছে। তারপরও পাল্টা আক্রমণ শুরুর আড়াই মাস পার হলেও কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন থেকে এখনো অনেক দূরে দেশটি।
ইউক্রেনের রাজনীতিতেও এসবের আঁচ পড়তে শুরু করেছে। গত গ্রীষ্মে গুজব ছিল, জেলেনস্কির সরকার হয়তো আগেভাগেই পার্লামেন্টারি ও প্রেসিডেনসিয়াল নির্বাচনের ডাক দেবেন। এর পেছনে যুক্তি ছিল, জাতীয় নায়কের ভূমিকায় থাকা অবস্থাতেই নতুন করে নির্বাচনে যাওয়াই জেলেনস্কির জন্য শ্রেয় হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভলোদিমির ফেসেঙ্কো মনে করেন, কোনো ধরনের নির্বাচন হলে তা হবে জেলেনস্কিকে নিয়ে গণভোট। '(যুদ্ধ পরিচালনাকারী কমান্ডার-ইন চিফ) ভ্যালেরি জালুজনি ছাড়া জেলেনস্কির বর্তমানে আর কোনো স্পষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বী নেই,' বলেন তিনি।
ইউক্রেনের প্রায় ৬০ লাখ নাগরিক এখন দেশের বাইরে বাস করছেন। কয়েক লাখ মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো নির্বাচন পরিচালনা করা একটি জটিল কাজ হবে দেশটির জন্য। সেই সঙ্গে আরেক বাধা হিসেবে রয়েছে মার্শাল ল।
তবে সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, যেকোনো পরিস্থিতিতেই আগাম ভোটের জন্য জনগণকে রাজি করাতে কাঠখড় পোড়াতে হতে পারে জেলেনস্কির দলকে।
উল্লেখযোগ্য কোনো সামরিক অর্জন ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসার চেষ্টাও কঠিন হবে। আগস্টের শুরুতে বাখমুতের কাছে যুদ্ধ করা ইউক্রেনের একজন স্নাইপার রাখঢাক না রেখেই বলেছিলেন, ইউক্রেন কখনোই এর হারানো ভূমি পুরোপুরি দখলমুক্ত করতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, অনেক সৈনিকই এখন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবকে স্বাগতম জানাবেন — কয়েক মাস আগেও যা ইউক্রেনীয়দের কাছে চিন্তার বাইরে ছিল। এ সময়ে এসে অনেক ইউক্রেনীয় সেনা, সাধারণ মানুষই যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবেন। ইতোমধ্যে অনেক রক্তক্ষয় হয়েছে। তবে অনেকেই আবার শান্তি আলোচনাকে যুদ্ধটিকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে দেওয়ার সমতুল্য হিসেবে দেখছেন।
এ যুদ্ধের প্রভাব অনেক বেশি অনুভব করছে ইউক্রেনের তরুণ সমাজ। তাদেরকে যেকোনো সময় বাধ্যতামূলক যুদ্ধে যাওয়ার আশঙ্কার মধ্যে দিয়ে দিনযাপন করতে হচ্ছে। যারা এ যুদ্ধে অংশ নিতে আগ্রহী, তারা অনেক আগেই স্বেচ্ছায় রণাঙ্গনে চলে গিয়েছে।
ইউক্রেন এখন মূলত অনিচ্ছুক মানুষদেরকেই সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগ দিচ্ছে। সবাই জানে, হারানো ভূমির পুনর্দখলের মূল্য হচ্ছে আরও অনেক সৈন্যের প্রাণহানি। জামুলা বলেন, 'এমনকি পাল্টা আক্রমণের সাফল্য প্রত্যাশা করাটাও এখন আত্মঘাতী কাজের মতো মনে হচ্ছে।'