ডায়ানার সঙ্গে নিহত দোদির বাবা হ্যারডসের প্রাক্তন মালিক মোহাম্মদ আল-ফায়েদ মারা গেছেন
স্বপ্রতিষ্ঠিত মিশরীয় বিলিয়নিয়ার মোহাম্মদ আল-ফায়েদ মারা গেছেন। একসময় তিনি লন্ডনের অভিজাত হ্যারডস ডিপার্টমেন্ট স্টোর কিনে নিয়েছিলেন। তার ছেলে দোদি ফায়েদ প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। দোদি ও ডায়ানার মৃত্যুর পেছনে রাজপরিবারের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছিলেন আল-ফায়েদ। ডায়ানা ও দোদির ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকীর এক দিন আগে গত বুধবার (৩০ আগস্ট) তিনি মারা যান বলে জানিয়েছে তার পরিবার।
পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, "মিসেস মোহাম্মদ আল-ফায়েদ, তার সন্তান এবং নাতিনাতনিরা নিশ্চিত করছেন যে তার প্রিয় স্বামী, সন্তানদের প্রিয় বাবা এবং নাতিনাতনিদের প্রিয় দাদা বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন।"
মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মোহাম্মদ আল-ফায়েদ। তিনি তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন কোমল পানীয় বিক্রির মাধ্যমে, এরপর তিনি সেলাই মেশিনের বিক্রয়কর্মী হিসেবেও কাজ করেছেন। প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যে, তারপর ইউরোপে আবাসন, জাহাজ, নির্মাণকাজের ব্যবসার মাধ্যমে তিনি নিজের পরিবারের ভাগ্য গড়েছিলেন।
হ্যারডস, ফুলহ্যাম ও প্যারিসের রিটজ হোটেলের মতো নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো আল-ফায়েদের মালিকানায় থাকলেও, ব্রিটেনে তাকে সবসময় বহিরাগতই মনে করা হতো।
কয়েক দশক ধরে ব্রিটেনে বসবাস করার পরেও তাকে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব দিতে রাজি না হওয়ায় তিনি ব্রিটিশ সরকারের অংশ হতে পারেননি; বরং প্রায়ই তিনি ফ্রান্সে চলে যাওয়ার হুমকি দিতেন, কারণ ফ্রান্সে তাকে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা 'লিজিয়ন অব অনার' দেওয়া হয়েছিল।
আল-ফায়েদ ছিলেন আকর্ষণীয়, স্বৈরাচারী, প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং সেই সময় স্পষ্টভাষী একজন ব্যক্তি, যিনি দশটি বছর পার করেছেন এই প্রমাণ করতে যে ডায়ানা ও তার ছেলে দোদির দুর্ঘটনা ছিল আসলে একটি হত্যাকাণ্ড। ১৯৯৭ সালে প্যারিসে পাপারাজ্জিদের এড়াতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ডায়ানা ও দোদি।
কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই সেই সময় আল-ফায়েদ অভিযোগ করেছিলেন যে, ডায়ানার গর্ভে ছিল দোদির সন্তান। এছাড়াও, প্রিন্স ফিলিপ ব্রিটেনের নিরাপত্তা বাহিনীকে ডায়ানাকে হত্যার নির্দেশ বলেও অভিযোগ করেছিলেন তিনি। কারণ প্রিন্স ফিলিপ চাননি যে ডায়ানা একজন মুসলিমকে বিয়ে করেন এবং তার সন্তানের মা হন।
যদিও আল-ফায়েদ স্ব-উদ্ভাবন, অতিরঞ্জন এবং অতিরিক্ত জাহির করার অভ্যাসের জন্য পরিচিত ছিলেন; কিন্তু ব্রিটেনের সাম্প্রতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর কেন্দ্রে ছিলেন তিনি।
১৯৮৫ সালে তার হ্যারডস কিনে নেওয়া ব্রিটেনের সবচেয়ে আলোচিত ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। ১৯৯৪ সালে তিনি পার্লামেন্টে তার পক্ষে প্রশ্ন করার জন্য রাজনীতিবিদদের অর্থ দিয়েছেন বলে দাবি করেন এবং এর মাধ্যমে একটি কেলেঙ্কারির জন্ম দেন।
আরও অনেক বিলিয়নিয়ারের মতো আল-ফায়েদেরও অনেক প্রথাগত রীতিনীতি প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছেন। একবার তিনি বলেছিলেন, তিনি হ্যারডসের ছাদে কাচের পিরামিডে সোনার কফিনে মমি হতে চান। নিজের স্টোরে তিনি ড্রেসকোড প্রবর্তন করেছিলেন- এমনকি ক্রেতাদের জন্যও! এছাড়াও তিনি হ্যারডস-এ অ্যালবাট্রসের ডানার নিচে নৃত্যরত ডায়ানা ও দোদির একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি বসিয়েছিলেন।
ফুলহ্যাম এফসি'র মালিক থাকাকালীন তিনি ক্লাবের স্টেডিয়ামের বাইরে মাইকেল জ্যাকসনের একটি লার্জার-দ্যান-লাইফ মূর্তি বসিয়েছিলেন; যদিও পপ তারকা মাত্র একটি ম্যাচে এসেছিলেন এই স্টেডিয়ামে। এ বিষয়ে কেউ কেউ অভিযোগ জানালে তিনি বলেছিলেন, "যদি কিছু মূর্খ ভক্তরা এরকম একটা উপহারের মর্ম না বোঝে তাহলে তারা নরকে যাক চাইলে!"
হ্যারডস অধিগ্রহণ
মোহাম্মদ আল-ফায়েদের অতীত সম্পর্কে অনেক তথ্যই ঘোলাটে রয়ে গেছে, এমনকি তার জন্মতারিখও। তিনি বলেছিলেন তিনি ব্রিটিশ-শাসিত মিশরে ১৯৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু হ্যারডস অধিগ্রহণের সময় ব্রিটিশ সরকারের করা একটি অনুসন্ধানে বলা হয় যে তিনি ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন।
আল-ফায়েদ ১৯৭৪ সালে ব্রিটেনের রেসিডেন্ট হন এবং নিজের নামের সঙ্গে 'আল' যুক্ত করেন। এটিকে আত্ম-সম্প্রসারণ হিসেবে অভিহিত করে স্যাটায়ারিক্যাল ম্যাগাজিন প্রাইভেট আই তার নাম দিয়েছিল 'নকল ফারাও'।
১৯৮৫ সালে তিনি এবং তার ভাইয়েরা ব্যবসায়ী রোলান্ড 'টাইনি' রোল্যান্ডকে টপকে হ্যারডসের মালিকানা দখল করেন। হ্যারডস বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত দোকানগুলোর মধ্যে একটি।
আল-ফায়েদ ভেবেছিলেন হ্যারডস কিনে নেওয়ার মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশ সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পাবেন; কিন্তু তার বদলে এই ঘটনা আরও কিছু দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়।
রোল্যান্ড আল-ফায়েদ ও তার ভাইদের বাণিজ্য বিষয়ক তদন্ত বিভাগ পর্যন্ত নিয়ে যান এবং দাবি করেন যে তারা তাদের সম্পদের ভুল বর্ণনা দিয়েছে।
এ তদন্তে তাদের একটি ধনী ব্যবসায়িক পরিবারের অংশ হওয়া, অতীতের ব্যবসায়িক সংযোগ এবং তাদের আয়ের স্বাধীন উৎস সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়।
২০১০ সালে আল-ফায়েদ হ্যারডসকে কাতারের সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের কাছে বিক্রি করে দেন।
এদিকে ১৯৯৫ সালে ব্রিটিশ নাগরিকত্বের জন্য আল-ফায়েদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে ব্রিটিশ সরকার। এ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন যে বর্ণবাদের কারণে তিনি ব্রিটেনে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছেন না।
এর এক বছর আগে আল-ফায়েদ সরকারি এক কর্মকর্তাকে অপমানিত করেছিলেন; তিনি রাজনীতিবিদদের তার হয়ে পার্লামেন্টে প্রশ্ন করার জন্য উপহার ও টাকাপয়সা দিয়েছিলেন বলে তথ্য ফাঁস করেছিলেন। তার সেই তথাকথিত 'ক্যাশ-ফর-কোয়েশ্চেনস' কেলেঙ্কারির ফলে চার রাজনীতিবিদের ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যায়, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন মন্ত্রী।
এই দুর্নীতিমূলক আচরণের ফলে সেসময় কনজারভেটিভ পার্টি রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং ১৯৯৭ সালে লেবার পার্টির টনি ব্লেয়ারের কাছে বিপুল ভোটে হেরে গিয়েছিল।
ডায়ানা এবং দোদি
সেবারের গ্রীষ্মে প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গে মোহাম্মদ আল-ফায়েদের ছেলে দোদির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ডায়ানা প্রিন্স চার্লসকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছিলেন। দক্ষিণ ফ্রান্সে একটি বিলাসবহুল ইয়টে দোদি এবং ডায়ানার একসঙ্গে সময় কাটানোর ছবি ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডগুলোতে উঠে আসে।
প্যারিসে যাওয়ার পর একদিন ডায়ানা ও দোদির মার্সিডিজকে তাড়া করে পাপারাজ্জিরা। সেদিন গাড়ির চালক প্রচুর পান করেছিলেন এবং মাতাল অবস্থায় পাপারাজ্জিদের মোটরবাইক এড়াতে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে তাদের গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পোন দেল আলমা টানেলে একটি পিলারের সঙ্গে ধাক্কা খায় এবং এ দুর্ঘটনায় দোদি ও ডায়ানা দুজনেই মারা যান।
ছেলের মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে এবং তাদের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে- এমন অনুভূতি থেকে আল-ফায়েদ এ দুর্ঘটনার সঠিক তদন্তের জন্য আইনি লড়াই লড়তে লাখ লাখ পাউন্ড ব্যয় করেন।
গাড়ি দুর্ঘটনার এক দশক পরে লন্ডনে এই মামলা শুরু হওয়ার পর আল-ফায়েদ প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ার থেকে শুরু করে ডায়ানার বোন সারাহ, ডায়ানার মৃতদেহ সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকা ফরাসি কর্মী ও প্যারিসের অ্যাম্বুলেন্সের চালকসহ ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ তোলেন।
কিন্তু জুরি জানায় যে, চালকের অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি চালানোর কারণেই এই ডায়ানা ও দোদি নিহত হয়েছেন। এরপরে আল-ফায়েদ বলেছিলেন যে তিনি রায় মেনে নিয়েছেন এবং এই জুটিকে হত্যা করা হয়েছে কিনা তা প্রমাণের জন্য আর আইনি লড়াইয়ে যাবেন না তিনি।
তিনি বলেছিলেন, "আমার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বাকিটা আমি সৃষ্টিকর্তার হাতে ছেড়ে দিচ্ছি।"