'এই স্কুল আমার আলোর দিশা', আফগানিস্তানে মেয়েদের গোপন স্কুল
সদর দরজায় ঠকঠক শব্দে চমকে উঠলেন পরস্তো হারিছা (ছদ্মনাম)। শ্রেণিকক্ষে থাকা মেয়েদের সংখ্যা দ্রুত গুণে নিলেন তিনি। দেখলেন সবাই আছে। আশঙ্কা করলেন, তালেবান সদস্যরাই এসেছে। এবং সেটিই সত্য হলো।
দরজা খুলতেই দেখা গেলো পাঁচ তালেবান সদস্য এসেছে। কোনো নিয়ম ভঙ্গ হচ্ছে কিনা সেটি তারা পরীক্ষা করে দেখছেন।
দুই বছর আগে ক্ষমতায় আসার পর নারীদের শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তালেবান। তারমধ্যেই একটি গোপন স্কুল চালাচ্ছিলেন হারিছা।
তালেবানদের দেখেই হারিছা তাৎক্ষণিকভাবে স্কুলের নিরাপত্তা প্রটোকল কাজে লাগান। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তার কর্মীদের এবং ছাত্রীদের প্রতি আগেই নির্দেশনা দেওয়া ছিল তালেবানরা পরিদর্শনে আসলে কি করতে হবে।
আফগানিস্তানের বাইরে একটি অজ্ঞাত স্থান থেকে হারিছা সিএনএনকে বলেন, 'আমি মেয়েদের বলেছিলাম তালেবানরা সরাসরি তোমার সাথে কথা বললেও 'নীরব থাকো, চোখ নামিয়ে রাখো এবং কথা বলবে না'।
'তাই যখন তারা (তালেবান) প্রশ্ন করছিল, তখন মেয়েরা শুধু আমার দিকে তাকিয়ে ছিল এবং আমাকে উত্তর দিতে হয়েছিল। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।' যোগ করেন হারিছা।
হারিছা জানান, কথা বলার জন্য তালেবানরা মেয়েদের ঘুষও দিতে চেয়েছে। কিন্তু তারা চুপ থাকে। তারপর তালেবান জঙ্গিরা তার ওপর এবং আরেক শিক্ষকের ওপর চিৎকার করতে থাকে এবং প্রশ্ন চালিয়ে যায়। তবে এক পর্যায়ে তারা চলে যায়। এ যাত্রায় বেঁচে গেলেও পরবর্তীতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে, এমন আশঙ্কা আছে হারিছার। তবে নিজের লক্ষ্যে তিনি অবিচল।
হারিছা এসআরএকে নামক গোপন স্কুলের একটি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করেন। এসআরএকে'র অধীনে ১৫০ সাহসী শিক্ষক ও কর্মী আফগানিস্তানের আট প্রদেশের প্রায় ৪০০ মেয়েকে শিক্ষা দিচ্ছেন। সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিএনএন এর প্রতিবেদনে কারো প্রকৃত নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করা হয়নি।
শিক্ষার্থীদের পরিচয় এবং শ্রেণিকক্ষের স্থান গোপন রাখার শর্তে এসআরএকে-এর স্কুলগুলাতে প্রবেশ করে ভিডিও ধারণ করার অনুমতি পায় সিএনএন।
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ
২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে নিজেদের সেনা সরিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। আবার ক্ষমতায় ফেরে তালেবান। ক্ষমতা দখলের পরপরই এক সংবাদ সম্মেলনে তালেবানের জ্যেষ্ঠ নেতারা প্রতিশ্রুতি দেয়, যে কোনো সহিংসতার হাত থেকে নারীদের সুরক্ষা দেওয়া হবে এবং শিক্ষা সবার অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করা হবে। হারিছা জানান, তিনি একটি শব্দও বিশ্বাস করেননি।
তিনি বলেন, তারা (তালেবান) আগেও একই ধরনের কথা বলেছে। তারা বলেছিল, আফগানিস্তানে শরিয়া আইন ও ইসলামী নীতি বাস্তবায়ন করা হবে। তবে মেয়েরা স্কুলে যাবে, নারীরা কাজ করতে পারবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়েও যাবে। তখন আমি নিজে নিজে ভাবলাম, তারা মিথ্যে বলছে। তারা পাল্টাবে না। তারা আবারও মেয়েদের স্কুলে যেতে দেবে না।
দ্রুতই দেখা গেলো তালেবানরা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে। ৬ষ্ঠ শ্রেণির পর নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়। গত ডিসেম্বরে সব স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও গুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়, তাদের নারী কর্মীরা যাতে কাজে না আসে।
চলতি বছরে আফগানিস্তানের সব বিউটি সেলুন বন্ধ করা হয়। যে খাতে প্রায় ৬০,০০০ নারীর কর্মসংস্থান ছিল।
জাতিসংঘ চলতি বছরের জুনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে তালেবানের কঠোর বিধিনিষেধকে 'বৈষম্যমূলক এবং অসামাজিক' হিসাবে মন্তব্য করে ।
হারিছা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, নারী শিক্ষা চালিয়ে যাওয়াই তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই করার একমাত্র উপায়। ২৫ বছর আগেও তালেবানের হুমকির মুখে আফগান নারীদের রেখে যাওয়া সাহসী উদাহরণের পুনরাবৃত্তি করার লক্ষ্য নেন তিনি ।
হারিছা বলেন, আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, ১৯৯৬ সালে যখন তালেবান ক্ষমতায় ছিল তখন তরুণ প্রজন্ম কী করছিল? তারা কীভাবে জীবনযাপন করছিল?
'আমি চিৎকার করতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি'
হারিছা আংশিকভাবে অনুপ্রাণিত হন ক্রিস্টিয়ানে আমানপোর-এর ১৯৯৬ সালের তথ্যচিত্র 'ব্যাটল অব আফগানিস্তান' থেকে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন নতুন প্রজন্মের আফগান মেয়েদের জন্য গোপন স্কুল পরিচালনার।
সে রাতেই হারিছা পরিচিত অনেকজনকে কল করেন। যাদের মধ্যে ছিল তার পুরনো বান্ধবী মরিয়ম। হারিছা সেদিন মরিয়মকে বলেছিলেন, গোপন কোনো স্থানে মেয়েদের একসাথে জড়ো হওয়া এবং শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর জন্য আমাদের কিছু করা দরকার। আমার কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আছে। সেগুলো সম্প্রসারিত করতে তোমার সহায়তা দরকার।
হারিছা বলেন, আমি চাকরি করতাম। তাই গোপন স্কুলের জন্য প্রয়োজনীয় বই, খাতা এবং অন্যান্য জিনিসের জন্য অর্থ ছিল আমার কাছে।
মরিয়ম একজন প্রশিক্ষিত শিক্ষক। তিনি জানান, হারিছার কথা শুনার পরই তিনি রাজি হয়ে যান এবং তালেবানের বিধিনিষেধ ভাঙতে চান বলে জানান।
মরিয়ম জানান, তালেবান মেয়েদের শিক্ষায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর তার কাছে নিজেকে বন্দী বলে মনে হতো। যেন কিছু করার নেই, যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। এই পরিস্থিতিতে মরিয়ম চরম হতাশায় পড়েন।
তিনি বলেন, এ অবস্থায় আমি জোরে চিৎকার করে উঠতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে সময় ছিল সেটি।
মরিয়ম জানান. গোপন স্কুলের কথা ছড়িয়ে পড়তেই অনেক মেয়ে আসতে শুরু করে। মরিয়ম দেখতে পান, মেয়েরা ঘরবন্দী দশা থেকে বের হতে পেরে স্বস্তিতে আছে।
'কিছু মেয়ে সরকারি ছুটির দিনেও ঘরে থাকতে চায় না। স্কুলে কোনো শিক্ষক না থাকলেও তারা এখান আসার অনুমতি চায়। এটাই দেখায় যে, মেয়েরা বন্দী দশা থেকে মুক্তি পেতে কতটা মরিয়া।' যোগে করেন মরিয়ম।
মরিয়মের গোপন স্কুলে গিয়ে সিএনএন দেখতে পায়, ছোট্ট ঘরে ৩০ জন মেয়ে বসে আছে। তারা ইংরেজি, গণিত থেকে শুরু করে সেলাইয়ের কাজ শিখছে এখানে।
মরিয়ম বলেন, স্কুলটি আমার কাছে আলোর মতো। এটি এমন সড়ক, যার শেষেই আছে সুখ এবং নতুন সূর্যোদয়। এটি আমাকে আশা দেয় যে, একদিন নিয়মিত স্কুলগুলো আবারো খুলবে এবং সব মেয়ে স্কুলে ফিরে যাবে। নারীরা তাদের কাজে যোগ দেবে।
'এটা কারাগারে বন্দী থাকার মতো অনুভূতি'
মরিয়মের শিক্ষার্থী ১৬ বছর বয়সী ফাতিমা (ছদ্মনাম) জানায়, মনে হচ্ছিল আমাকে সমাজ থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। এটি বন্দী হওয়ার মতো অবস্থা বলে মনে হয়েছিল, যাকে কেবল খাওয়া এবং পান করার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু অন্য কিছু করার অনুমতি দেওয়া হয় না।
'অশিক্ষিত অবস্থায় বাড়িতে বসে থেকে আমরা কিছু অর্জন করতে পারব না। আমি আমার পরিবার এবং সমাজের বোঝা হতে চাইনি। আমি শিক্ষিত হয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।' যোগ করে ফাতিমা।
পরিবারের সমর্থনে মরিয়মের গোপন স্কুলে আসে ফাতিমা। সে সেলাই করতে পছন্দ করে এবং এখন একজন বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
আরেক শিক্ষার্থী ইয়ালদার কাছে এই স্কুল নতুন জীবন পাওয়ার মতো। নিজের প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল সে।
১৪ বছর বয়সী ইয়ালদা জানায়, এটি ছিল (স্কুলে আসা) বাড়িতে থেকে থেকে উদ্বেগ ও বিষন্নতায় ভোগা থেকে মুক্তির মাধ্যম।
ইয়ালদা, ফাতিমা এবং মরিয়মসহ আরো অনেকে তালেবান শাসনবিহীন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন এবং অন্ধকার ছেড়ে বেরিয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ইয়ালদা মন্তব্য করে, তালেবানরা যদি আরো সাত, আট বছরও থাকে এক পর্যায়ে তারা চলে যাবে। তারপর আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারব এবং আমাদের শিক্ষা চালিয়ে যাব।
'যেন অর্ধেক মানুষ'
আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত পূর্ববর্তী প্রশাসনে আইনপ্রণেতা ছিলেন ফৌজিয়া কুফি। প্রথমবার তালেবানের ক্ষমতায় আসার পরের সময়কার কথা বর্ণনা করেন তিনি।
বর্তমানে নির্বাসিত অবস্থায় আছেন তিনি। সেখান থেকে কুফি বলেন, আজকের মতো তখনো নারীরা চলাফেরা এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে একই রকম বিধিনিষেধের মুখোমুখি হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে, হারিছার মতো তিনিও একটি গোপন স্কুল চালাতেন।
কুফি বলেন, তখন কেবল ছয় থেকে সাতজন মেয়ে আসত। আমি তাদেরকে শুধু ইংরেজি এবং বিজ্ঞান শেখাতাম। তালেবানদের মনে কোনো সন্দেহ না জাগিয়ে স্কুল চালাতাম। আমাদেরকে এখনো খুব সতর্ক থাকতে হবে যাতে তালেবানরা আমাদের শনাক্ত করতে না পারে।
'আপনি যখন বাইরে থাকবেন, তালেবানরা আপনাকে এমনভাবে দেখবে যেন আপনি অর্ধেক মানুষ; তখন মুখ ঢাকতে বলা হবে। আপনি সমাজে কী অবদান রাখতে পারেন বা আপনি কতটা প্রতিভাবান তা সেটি মুখ্য বিষয় নয়, আপনি কি পরছেন তা নিয়েই কেবল মাথা ব্যথা।' যোগ করেন কুফি।
কুফি ২০০৫ সালে আফগানিস্তানের প্রথম নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্য হন এবং তারপরে দেশের প্রথম নারী ডেপুটি স্পিকার হয়ে ইতিহাস তৈরি করেন।
২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর তিনি দেশত্যাগ করেন। তবে এখনো একদিন দেশে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
ভয়ের চেয়েও শক্তিশালী আশা
মরিয়ম জানতে পেরেছেন, তালেবানরা আশেপাশের এলাকাগুলোতে অবৈধ কার্যকলাপ চলছে কিনা পরীক্ষা করছে। তাদের ধরা পড়ারও আশঙ্কা আছে।
মরিয়ম বলেন, আমি ভীত, আমি প্রতি মুহূর্তে ভয় অনুভব করি। তবে একই সময়ে, আমি এই আশা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি যে, আগামীকাল আজকের চেয়ে ভাল হবে।
'ভয়ের চেয়ে শক্তিশালী একটি শক্তি আছে, আর সেটি হলো ভবিষ্যতের জন্য আমাদের আশা।'
ফাতিমা এই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যায়। সেই সাথে তার মনে গ্রেপ্তার হওয়ার উদ্বেগও কাজ করে। ফাতিমা জানায়, যদি তারা আমাকে আটক করে, আমি তাদের বলবো আমি শুধু শিক্ষিত হতে চেয়েছি। আমি ঘরে বসে থাকতে চাই না এবং এটি কোনও অপরাধ নয়।