কাশ্মীর নিয়ে ২০১০ সালের বক্তব্যের জেরে বিচারের মুখে অরুন্ধতী রায়
জনসম্মুখে বিতর্কিত বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে ভারতের বিখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে মামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। ১৩ বছর আগে কাশ্মীর ইস্যুতে 'উস্কানিমূলক' বক্তব্য প্রদানের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
দিল্লি পুলিশের মুখপাত্র সুমন নালওয়া নিজে অরুন্ধতী রায় ও কাশ্মির বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা চালানোর তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন।
ভারতীয় আইন অনুযায়ী, দণ্ডবিধির ১৫৩এ, ১৫৩বি ও ৫০৫ ধারায় মামলা বিচারের জন্য রাষ্ট্রের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। ১৩ বছর পর দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর ভি কে সাক্সেনা সেই অনুমতি দেওয়ায় মামলাটি বিচারে যাওয়ার পথ খুলল।
২০১০ সালে দায়ের করা এ মামলায় বিদ্বেষ ছড়ানো, সম্প্রীতির জন্য ক্ষতিকর কাজ করা, জাতীয় ঐক্যের জন্য ক্ষতিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযোগ করা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে এ মামলায় অরুন্ধতী রায়ের সাত বছরের কারাদণ্ড হতে পারে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর জানান, সরকার এই মামলায় অরুন্ধতী রায় ও শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের আরও গুরুতর অভিযোগ দায়ের করার কথা বিবেচনা করছে।
অন্যদিকে চলতি মাসের শুরুতে দিল্লি পুলিশ চীনা অর্থায়নের পরিচালনার অভিযোগে সন্ত্রাস দমন আইনে ভারতের সংবাদ পোর্টাল নিউজক্লিক-এর সম্পাদকসহ দুই জনকে গ্রেপ্তার করে। এছাড়াও ওই পোর্টালের প্রায় ৫০ জন সাংবাদিক ও নিয়মিত লেখকদের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চালানো হয়।
সাংবাদিকের গ্রেফতার ও তাদের বাড়িতে তল্লাশি চালালে ঐ ঘটনার কড়া ভাষায় সমালোচনা করেন অরুন্ধতী রায়। ঠিক এর পরেই এই লেখিকার বিরুদ্ধে মামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
তল্লাশি ইস্যুতে অরুন্ধতী রায় গণমাধ্যম দ্য ওয়্যারকে বলেন, "ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি জরুরি অবস্থার চেয়েও বেশি ভয়ানক।"
অরুন্ধতী রায় মনে করেন, জরুরি অবস্থা শুধু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আরোপ করা হয়। কিন্তু বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদি মূলত ভারত রিপাবলিকের 'প্রকৃতি' পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। দলটি যদি ফের ক্ষমতায় যায়, তবে তারা সংবিধান ও জনগণের কণ্ঠস্বরকে দমিয়ে রাখবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
সবাইকে সতর্ক করে অরুন্ধতী রায় বলেন, "বিজেপি যদি ২০২৪ নির্বাচনে জয়লাভ করে, তবে ভারত আর গণতান্ত্রিক দেশ থাকবে না।"
এদিকে গত মঙ্গলবার দিল্লির এক আদালত নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতাসহ গ্রেফতারকৃত দুই সাংবাদিকের জামিন আগামী ১০ দিনের জন্য না মঞ্জুর করেছে।
গ্রেফতারকৃত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দেশটির 'আনলফুল অ্যাক্টিভিটি প্রিভেনশন অ্যাক্ট' নামের নিবর্তনমূলক আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই আইনের অধীনে অভিযুক্ত বহু ব্যক্তিই বিচার শুরুর পূর্বে বছর জেলে কাটিয়েছেন।
মামলা চালানোর সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে অধ্যাপক শেখ শওকত হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমসকে জানান, অভিযোগ গ্রহণের বিষয়ে তিনি এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক মেইল পাননি।
অন্যদিকে অরুন্ধতী রায়ের কাছেও নিউ ইয়র্ক টাইমসের পক্ষ থেকে মামলা চালানোর বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। এ বিষয়ে বিখ্যাত এই সাহিত্যিক জানান, মামলা নিয়ে আলোচনা করার আগে তাকে তার আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করতে হবে।
অভিযোগের তালিকায় অরুন্ধতী ও শওকত হোসেন ছাড়াও আরও দুইজন অভিযুক্ত রয়েছেন। তারা হলেন কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রভাবশালী নেতা সৈয়দ আলী শাহ জিলানি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর সৈয়দ আব্দুর রহমান জিলানি। তারা দুজনেই অবশ্য মৃত্যুবরণ করেছেন।
মূলত 'উস্কানিমূলক' বক্তব্যের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটি দেওয়া হয়েছিল ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর দিল্লিতে, 'ফ্রিডম-দ্য অনলি ওয়ে' কনফারেন্সে। ঠিক ঐ সময় কাশ্মীরে ১৭ বছর বয়সী এক ছেলের নিহতের খবরে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল।
মূলত ঐ ছেলেটি একটি টিউটরিং সেন্টার থেকে ফিরে আসার সময় ভারতীয় বাহিনীর ছোড়া টিয়ার-গ্যাসের ক্যানিস্টারে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। ঐ বছর উত্তেজনায় কাশ্মীরে প্রায় ১২০ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন।
কনফারেন্সে দেওয়া অরুন্ধতী রায়ের বক্তব্যে সুশীল পণ্ডিত নামের এক নাগরিক অধিকারকর্মী এবং কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সংগঠন 'রুটস ইন কাশ্মীর' দিল্লির ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে এ মামলা দায়ের করেন। তাদের অভিযোগ, অরুন্ধতীর বক্তব্যে 'জনসাধারণের শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত' করার মতো উপাদান ছিল। একইসাথে এই লেখিকা 'ভারত থেকে কাশ্মীরকে আলাদা করার' প্ররোচনা দিয়েছেন বলেও মনে করেন অভিযোগকারী।
ঐ বক্তব্যে অরুন্ধতী রায় বলেন যে, একজন একজন রিপোর্টার তাকে বারবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, "কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ কি-না?"
জবাবে অরুন্ধতী রায় বলেন, "কাশ্মীর কখনই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল না। আপনি আমাকে আক্রমণাত্মকভাবে এবং যতবারই জিজ্ঞাসা করেন না কেন, আমি সেটাই বলবো। এমনকি সরকারও স্বীকার করেছে যে, এটি ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়।"