দ্বিতীয় রণাঙ্গনে লড়াইয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে ইসরায়েল
গাজার জনগণকে সরে যেতে বলেছে ইসরায়েল, সেখানে আক্রমণ পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশটি। তবে একইসঙ্গে ইসরায়েলের উত্তরে লেবানন সীমান্তেও যেন অশনি সংকেত — কারণ সেখানে যদি হিজবুল্লাহর সঙ্গে লড়াইয়ে নতুন ফ্রন্ট সৃষ্টি হয়, তাহলে তা ইসরায়েলের সেনাবাহিনীকে জটিল পরিস্থিতিতে ফেলবে, বাড়বে সংঘাতের পরিসরও।
গত ১৩ অক্টোবর লেবাননে অবস্থানকারী ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমিরাবদুল্লাহিয়ান বলেছেন, গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ চলতে থাকলে লেবানন সীমান্তে যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট তৈরি হওয়ার 'সব ধরনের সম্ভাবনা' রয়েছে। ইরানের মদতপুষ্ট শিয়া সশস্ত্রগোষ্ঠী হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা এখন যুদ্ধোদ্যমে রয়েছে।
সদ্য ইসরায়েল-লেবানন সীমান্ত ঘুরে আসা এক হিজবুল্লাহ কমান্ডার বলেন, 'একবার ভাবুন আমরা কী কী করতে পারব।' তার ভাষায়, ইসরায়েল সীমান্ত অতিক্রমের জন্য হিজবুল্লাহর কাছে 'খেলা বদলে দেওয়া' পরিকল্পনা রয়েছে। হিজবুল্লাহর ওপর ইসরায়েলের হামলার জবাবে গোষ্ঠীটি তেল আবিব ধ্বংস করতে পারবে, বলেন ওই কমান্ডার। এছাড়া তার মতে, পশ্চিমাদের জন্য ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার তুলনায় হিজবুল্লাহর জন্য ইসরায়েলের পারমাণবিক রিয়্যাক্টর আরও সহজ লক্ষ্যবস্তু।
হয়তো একটু বাড়িয়ে বলেছেন তিনি, তবে অনেক লেবানিজ এখন আসন্ন যুদ্ধের আশঙ্কায় নানা প্রস্তুতি নিচ্ছে। দক্ষিণের মানুষেরা উত্তরের পথ ধরেছেন, রাজধানী বৈরুতে পেট্রোল স্টেশনগুলোতে মানুষ লাইন ধরেছেন জ্বালানি কেনার জন্য।
হিজবুল্লাহ-ইসরায়েল ইতোমধ্যে একে অপরের ওপর রকেট হামলা করেছে। এছাড়া দুই পক্ষেরই কিছু সৈন্য নিহত হয়েছেন। দুপক্ষই নতুন করে সেনাবল বাড়াচ্ছে: ইসরায়েল তা করছে যাতে কোনো লড়াই শুরু হওয়ার আগে থেকেই থামানো যায়। দক্ষিণ লেবাননে থাকা জাতিসংঘের এক পর্যবেক্ষক বলেন, হিসাবের ভুলচুক হওয়ার আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে।
সেই ২০০৬ সালের মতোই হিজবুল্লাহ হয়তো ইসরায়েলের গাজায় আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করছে। ওই সময় গাজায় ইসরায়েলের স্থল আক্রমণের দুই সপ্তাহের মাথায় আক্রমণ করে বসে হিজবুল্লাহ। হামাসের মতো হিজবুল্লাহও প্যালেস্টাইনিয়ান অথোরিটি (পিএ), পশ্চিম তীরের প্রশাসনের বিরুদ্ধে একটি গণ-উত্থানের আশা করছে। এ দুটি কর্তৃপক্ষকেই হামাস-হিজবুল্লাহ উভয়ই ইসরায়েলিদের দুর্নীতিগ্রস্ত হাতিয়ার হিসেবে মনে করে। ওই হিজবুল্লাহ কমান্ডার বলেন, "পিএ'র কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।"
২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধে গোষ্ঠীটির পেশাদারিত্ব ও উচ্চ-মানসম্পন্ন অস্ত্র দেখে অবাক মেনেছিল ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ)। ১৯৯০-এর দশকের ওই গেরিলাদলটি ততদিনে চিরায়ত এক সেনাবাহিনীর প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হয়েছে। স্বল্প-প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আইডিএফ ট্যাংক বাহিনীর বিরুদ্ধে জটিল ও 'ঝাঁকে ঝাঁকে' আক্রমণের সক্ষমতা দেখিয়েছিল হিজবুল্লাহ।
তারপর থেকে হিজবুল্লাহর সক্ষমতা আরও একধাপ বেড়েছে। ২০০৬ সালে এটি ইসরায়েলের ওপর এক মাসে চার হাজার রকেট নিক্ষেপ করেছিল। এখন দলটির কাছে দেড় লাখের মতো রকেট ও মিসাইল রয়েছে। এসব অস্ত্রের অনেকগুলোই দক্ষিণ লেবাননের কলাবাগানগুলোতে লুকোনো। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ নামক একটি থিংক-ট্যাংকের ফাবিয়ান হিঞ্জ বলেন, তাদের এখন 'অনেক ইসরায়েলি প্রতিরক্ষাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলার সক্ষমতা রয়েছে।'
এছাড়া, ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর অস্ত্রাগারের বড় অংশই গড়ে উঠেছিল আনগাইডেড অস্ত্র নিয়ে। কিন্তু গত এক দশকে ইরানের সহায়তায় এটি প্রিসিশন-গাইডেড (নিখুঁত লক্ষ্যভেদী) মিসাইল সংগ্রহ করেছে যেগুলোর অনেকগুলোই লক্ষ্যবস্তুর ১০ মিটারের মধ্যে পড়তে সক্ষম বলে দাবি গোষ্ঠীটির।
এসব অস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলের বিভিন্ন ঘাঁটি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে হিজবুল্লাহ আগের যুদ্ধের তুলনায় আরও সফলভাবে হামলা চালাতে পারবে বলে মন্তব্য করেন হিঞ্জ। হিজবুল্লাহর কাছে দীর্ঘপাল্লার জাহাজ-বিধ্বংসী মিসাইলও রয়েছে। চীনের নকশার এ মিসাইলগুলো ইরানি প্রযুক্তিতে মডিফাই করা। এগুলো দিয়ে ইসরায়েলি জাহাজকেও লক্ষ্য করতে পারবে হিজবুল্লাহ।
ইয়েমেন, সিরিয়া ও ইরাকে ইতোমধ্যে যুদ্ধ করেছে হিজবুল্লাহ। 'আমরা যুদ্ধে পোড়-খাওয়া,' বলেন ওই কমান্ডার। 'ইসরায়েলি কাপুরুষদের মতো নই। ওরা স্থলে যুদ্ধ করে না।'
হিজবুল্লাহ কি মাঠে নামবে? তবে মনে হচ্ছে, একাধিক বিষয় বিবেচনা করছে এটি। সে কারণেই হয়তো দলটির নেতা হাসান নাসরাল্লাহ তার ১০ অক্টোবরের প্রত্যাশিত বক্তব্যটি দিতে দেরি করেছেন। এর একটি কারণ হচ্ছে, লেবাননের বর্তমান অবস্থা। দেশটি এখন অর্থনৈতিক সংকোচনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, এর মুদ্রামান ৯৮ শতাংশ পড়ে গিয়েছে।
তবে একদিক বিবেচনায় এ আর্থিক সংকট থেকে কিছুটা মুক্ত রয়েছে হিজবুল্লাহ। মার্কিন স্যাংশন এড়াতে এটি সমান্তরাল একটি আর্থিক ব্যবস্থা চালু করেছে। নিজেদের যোদ্ধাদের ডলারে মাইনে পরিশোধ করে এটি। তবে লেবাননে সংখ্যালঘু শিয়ারা। তাই দেশটিতে নিজেদের অবস্থানের কথাও বিবেচনা করতে হবে হিজবুল্লাহকে।
আরেকটি মৌলিক বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, হিজবুল্লাহর পৃষ্ঠপোষক ইরান কি আদৌ একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের জন্য উন্মুখ কি না। ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমিরাবদুল্লাহিয়ান বলেছিলেন, হামাসের আক্রমণ 'স্বতঃস্ফূর্ত এবং সম্পূর্ণ ফিলিস্তিনি'। পশ্চিমা সরকারগুলো বলছে, হামাসের আক্রমণে ইরানের নির্দেশনা ছিল এ নিয়ে তাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই।
তারপরও হিজবুল্লাহ কমান্ডারের তথ্যমতে, ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর লেবানেন লজিস্টিক্যাল সহায়তা দিচ্ছে। সিদ্ধান্তগ্রহণের ব্যাপারে ইরান এখন আরও শক্ত হয়ে উঠেছে। ২০২১ সালে হাসান রুহানি থেকে ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি তার মন্ত্রীসভায় সাবেক জেনারেলদের এনে বসিয়েছেন। ইরানের প্রভাব থাকা অন্য জায়গাগুলোতেও একই দৃষ্টান্ত দেখা গিয়েছে।
ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বিতীয় রণাঙ্গন উন্মুক্ত করতে হিজবুল্লাহকে অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে ইরান ইসরায়েল ও কিছু আরবদেশের মধ্যকার আব্রাহাম চুক্তিকে নষ্ট করা ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পশ্চিমা-বিরোধিতা শুরু করার আশা করতে পারে।
এর বিপরীতে অনেকে মনে করছেন, হিজবুল্লাহর রকেটের ভান্ডার সংরক্ষণ করতে চায় ইরান, যাতে নিজেদের পারমাণবিক প্রোগ্রামের বিরুদ্ধে যেকোনো আক্রমণ দমিয়ে রাখতে পারে এটি। আর বহির্বিশ্বের শক্তিগুলোর কথাও মাথায় রাখতে হবে ইরানকে। যেমন দেশটির সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার চীন খুব সম্ভবত চাইবে না মধ্যপ্রাচ্যে এমন কোনো আঞ্চলিক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ুক যার দরুন তেলের দাম আরও বেড়ে যায়।
আর লেবাননের উপকূলে মার্কিন নৌবহরের আগমনও মনোযোগ কেড়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতোমধ্যে হুঁশিয়ার করেছেন কেউ যেন এ পরিস্থিতিতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা না করে। হিজবুল্লাহ ও ইরান কি সেটা শুনছে? হিজবুল্লাহর কৌশলের একটি অংশ হচ্ছে ইসরায়েলকে চাপে রাখা। বিদায়কালে ওই হিজবুল্লাহ কমান্ডার বলেন, 'দেখা হবে কিরিয়াতে।' কিরিয়াত ইসরায়েলে একটি সীমন্তবর্তী শহর। কবে দেখা হবে তা অবশ্য তিনি খোলাসা করেননি।