উত্তরাঞ্চল ত্যাগের ইসরায়েলি নির্দেশ মানছে না গাজার চিকিৎসকেরা
গাজার চিকিৎসক নিসরিন আল-শোরাফা গত সাত দিনে মাত্র ১০ ঘন্টা ঘুমিয়েছেন। শহরটির তাল আল-জাতারে অবস্থিত আল আওদা হাসপাতালের ইমারজেন্সি রুমে দিনরাত নিজের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। শেষ কবে এত বেশি পরিশ্রম করেছেন সেটি মনে নেই ৩০ বছর বয়সী এই সার্জনের।
গত সাত দিনের সহিংসতায় গাজা উপত্যকায় একের পর এক বোমাবর্ষণ করছে ইসরায়েল। এতে একদিকে নিহতের সংখ্যা যেমন ব্যাপকভাবে বাড়ছে; তেমনি আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে বহু বাসিন্দা। তাদের জীবন বাঁচাতেই নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে আল-শোরাফা।
এরই মাঝেই গতকাল (শনিবার) আল আওদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ওয়ার্নিং কল পেতে শুরু করে। ঐ কলে কঠোরভাবে বলা হয় যে, "হাসপাতালটি খালি করতে হবে। কেননা এটি বোমা হামলায় ধ্বংস হতে পারে।"
এ সম্পর্কে আবাসিক নার্স আসালা আল-বাতশ বলেন, "একটি হাসপাতালে বোমা হামলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, ইসরায়েলের সেনাবাহিনী এমন কাজে বেশ গর্বিত বোধ করছে।"
নার্স আসালা আরও বলেন, "ইসরায়েলের সেনাবাহিনী চাচ্ছিল যে, হাসপাতাল থেকে সবাইকে সবকিছু নিয়ে সরে যেতে। অর্থাৎ হাসপাতালের সকল কর্মী, আইসিইউতে থাকা রোগী এবং মর্গে থাকা মৃতদেহ; সব সরানোর নির্দেশ দিয়েছে তারা!"
প্রথমদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে সবাইকে হাসপাতাল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে সরিয়ে নেওয়া যে অসম্ভব, সেটা বোঝানোর চেষ্টা করে। তবে এক পর্যায়ে ব্যর্থ হয়ে কর্তৃপক্ষ হাল ছেড়ে দেয়।
এমতাবস্থায় আল-শোরাফা বলেন, "আমরা হাসপাতাল না ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ ঠিক জানে না যে, আমাদের ওপর বোমা হামলা করা হবে কি-না। তবে এটা নিশ্চিত যে, এখানে অবস্থান করে আমরা সঠিক কাজটিই করছি।"
আল-শোরাফা আরও বলেন, "আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি, সেটি একেবারে সঠিক। একজন ডাক্তার ও নার্স হিসাবে এমন সময়ে আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ থাকা দরকার।"
হাসপাতালে একদিকে চিকিৎসার জন্য আসা শত শত আহত বাসিন্দাদের দিনরাত সেবা প্রদান করা হচ্ছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে ঘরবাড়ি হারানো মানুষের ভয়ে আশ্রয়স্থল হিসেবে হাসপাতালটিতে এসে ভিড় জমিয়েছে। কেননা বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকের কাছেই অন্যসব জায়গা অপেক্ষা হাসপাতালকেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল বলে মনে হচ্ছে।
এদিকে গত শুক্রবার গাজা শহরের ১০ লাখের বেশি বাসিন্দাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে সরে যেতে বলে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। গাজার সীমান্তজুড়ে বিপুল সংখ্যক ট্যাংক ও অন্যান্য ভারী যুদ্ধাস্ত্র সমবেত করেছে তারা। ইসরায়েল এখন গাজায় স্থল অভিযান শুরু করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গতকাল (শনিবার) স্থানীয় সময় সকাল ১০ টা থেকে বেলা ৪ টা পর্যন্ত মাত্র ছয় ঘণ্টা সময়ের ব্যবধানে দুটি রাস্তা ব্যবহার করে গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের দক্ষিণাঞ্চলে সরে যাওয়ার ফের নির্দেশনা দিয়েছে আইডিএফ।
আইডিএফের নির্দেশকৃত রাস্তাগুলো ব্যবহার করে যাতায়াত করলে বেসামরিক নাগরিকদের কোন ধরনের ক্ষতি হবে না বলেও আশ্বস্ত করেছেন মুখপাত্র আদরাই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার সময় বিমান হামলায় বহু হতাহতের ঘটনা ঘটছে।
এমতবস্থায় চিকিৎসক ও নার্স থেকে শুরু করে রোগীরা স্বাভাবিকভাবেই হাসপাতাল ত্যাগ করতে চাইছে না। কেননা এতে করে পথিমধ্যেই বোমা হামলায় নিহত হওয়ার সম্ভবনা প্রবল।
হাসপাতালটিতে খাবার এবং পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে আশেপাশের বাসিন্দারা রোগী ও শরণার্থীদের জন্য হাসপাতালে খাবার ও অনন্যা মৌলিক চাহিদা পূরণে এগিয়ে আসছে।
আরেক নার্স বলেন, "হাসপাতালে যখন স্বাভাবিক সময়ে কাজ করি, তখনই খাবার খাওয়ার সময় পাওয়া যায় না। আর বর্তমানে যে পরিস্থিতি, এখন তো আমাদের কাছে এটা মুখ্য বিষয় নয়।"
ইতিমধ্যেই গাজা উপত্যকার সমস্ত হাসপাতালগুলিতে সামর্থ্যের বাইরে রোগী ভর্তি হয়েছে। ফলে অনেকেই চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের করিডোরে অপেক্ষমান অবস্থায় পড়ে রয়েছে। মরদেহগুলিকে দাফনের আগে আইসক্রিমের ট্রাকে কিংবা ফুটপাতে সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। কেননা হাসপাতালের মর্গ লাশে পূর্ণ।
এমতবস্থায় ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ ও সাহায্য প্রত্যাশা করা হয়েছে। কিন্তু এখনও তেমনভাবে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
আল-শোরাফা বলেন, "আমরা যতটা সম্ভব চেষ্টা করছি। কিন্তু হাসপাতালে সবকিছুর বড় ধরণের ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে ইমারজেন্সিতে; যেখানে আহত মানুষকে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। আমরা যেন অনেকটা জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝিতে অবস্থান করছি।"
অনেকটা ভাঙা গলায় আল-শোরাফা আরও বলেন, "আমরা কঠোর পরিশ্রম করছি। আমাদের পক্ষে যা করা সম্ভব, তার সবকিছুই করছি। কিন্তু তবুও রোগীরা মারা যাবে। মনে হয় এই যুদ্ধের শুরু থেকে প্রতিদিন অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে।"
অন্যদিকে ইসরায়েলের হামলায় গতকাল (শনিবার) পর্যন্ত গাজা উপত্যকায় ৭০০-এর বেশি শিশু নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। আহত ফিলিস্তিনি শিশুর সংখ্যা প্রায় ২,৪৫০ জন।
স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে ইউনিসেফের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এছাড়াও ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় স্থল আক্রমণ করলে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সাক্ষাৎকারের সময় আল-শোরাফা যেন ব্যাপক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। অশ্রুসিক্ত নয়নে ক্লান্ত অবস্থায় তিনি বলেন, "খুবই কঠিন পরিস্থিতি চলছে। আমরা একেবারে অসহায় বোধ করছি।"
এদিকে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন জানিয়েছেন, 'ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক কর্মকাণ্ড ঠেকানো বা হামাসের হামলার পর এই যুদ্ধকে আরও প্রসারিত করার যেকোনো প্রচেষ্টা রুখতে' যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ভূমধ্যসাগরে বিমানবাহী দ্বিতীয় রণতরি বহর পাঠাচ্ছে।
ইউএসএস আইজেনহাওয়ার এবং এর অধিভুক্ত যুদ্ধজাহাজের বহর এক সপ্তাহে আগেই যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো আরেক রণতরির সঙ্গে যোগ দেবে।
এক বিবৃতিতে লয়েড অস্টিন বলেন, এই পদক্ষেপ ইসরায়েলের নিরাপত্তার ব্যাপারে ওয়াশিংটনের দৃঢ় অঙ্গীকারের ইঙ্গিত বহন করে।