গাজার মাটির নিচে হামাসের সুড়ঙ্গ হবে ইসরায়েলের মূল রণক্ষেত্র
নগর যুদ্ধে (আরবান ওয়ারফেয়ার) চার স্তরে লড়াই হয়। একটি হচ্ছে শহরের আকাশ, যার ওপর দিন দিন ড্রোনের ওড়াউড়ি বেড়ে চলেছে। আরেক স্তর হচ্ছে উঁচু ভবন—যেখান থেকে শত্রুর ওপর নজর রাখা এবং গাঢাকা দেওয়ার কাজ করা যায়। তৃতীয় স্তর হচ্ছে শহরের সড়ক ও অলিগলি। আর চতুর্থ স্তর হচ্ছে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ।
গাজা উপত্যকায় স্থল আক্রমণ চালালে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে (আইডিএফ) এই চতুর্থ স্তর, অর্থাৎ সুড়ঙ্গগুলোই ভোগাবে সবচেয়ে বেশি। আইডিএফের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে এসব সুড়ঙ্গ।
১৯৮১ সালে মিসর-গাজা সীমান্ত চিহ্নিত করার পর সীমান্তের উভয় পাশের বেদুইন গোষ্ঠীগুলো এ অঞ্চলে প্রথম সুড়ঙ্গ তৈরি করে। উদ্দেশ্য, সীমান্তের ওপার থেকে নানা ধরনের পণ্যসামগ্রী চোরাচালান করে আনা। গাজা উপত্যকা থেকে প্রথম সুড়ঙ্গ আক্রমণ করা হয় ১৯৮৯ সালে।
তবে ২০০১ সালে হামাস এক অসাধারণ ভূগর্ভস্থ নেটওয়ার্ক নির্মাণ আরম্ভ করে। এসব সুড়ঙ্গ নির্মাণের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল মিসর থেকে রসদ ও অস্ত্র আনা। কিন্তু সুড়ঙ্গগুলো আরও অনেক কাজে আসতে লাগল। ২০০৫ সালে গাজা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়। এরপর ২০০৬ সালের নির্বাচনে জিতে এ ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয় হামাস।
গাজার ফোন নেটওয়ার্ক ট্যাপ করে রেখেছে ইসরায়েল। তাই এর ওপর নির্ভর করেন না হামাসের কমান্ডাররা। তারা আত্মগোপন এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য এসব সুড়ঙ্গ ব্যবহার করেন। এছাড়া এই সুড়ঙ্গগুলো অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুকানোর কাজেও ব্যবহার করা হয়।
ইসরায়েল গাজায় স্থল যুদ্ধ শুরু করলে অতর্কিত আক্রমণের (অ্যাম্বুশ) জন্য এসব সুড়ঙ্গ ব্যবহার করতে পারবে হামাস। এছাড়া এই সুড়ঙ্গগুলো সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েল পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছেন হামাসের যোদ্ধারা। এই আন্তঃসীমান্ত সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে ইসরায়েলে আক্রমণও করেছেন তারা। ২০০৬ সালে তারা এরকম একটি সুড়ঙ্গ দিয়ে ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে কর্পোরাল গিলাদ শালিতকে অপহরণ করেন। শালিতের মুক্তির বিনিময়ে পরে ১ হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে ছাড়িয়ে এনেছে হামাস।
লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহও ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তে এরকম সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে। যদিও সেগুলোর বেশিরভাগই ২০১৮-১৯ সালে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
এই টানেলগুলো তৈরি করা হয়েছিল দীর্ঘমেয়াদে ইসরায়েলের লড়াইয়ের পদ্ধতি বদলে দেওয়ার করার জন্য। একজন হামাস নেতা ২০০৮ সালে গাজার ওপর চালানো সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র যুদ্ধের প্রসঙ্গে কথা বলার সময় বলেছিলেন, '[ইসরায়েলের] বিমান হামলা এবং বিমান নজরদারি আমাদের হতচকিত করে দিয়েছিল। …সে কারণে আমরা এ যুদ্ধ ভূপৃষ্ঠ থেকে মাটির নিচে নিয়ে আসার কৌশলগত পরিকল্পনা করেছি।'
থিঙ্ক ট্যাঙ্ক র্যান্ড কর্পোরেশনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৪ সাল নাগাদ হামাসের সুড়ঙ্গ তৈরি প্রকল্পে ৯০০ জন পূর্ণকালীন কর্মী কাজ করছিলেন। প্রতিটি সুড়ঙ্গ তৈরি করতে সময় লাগে তিন মাস, আর গড়ে খরচ হয় ১ লাখ ডলার। গাজার মসজিদগুলোর মাধ্যমে এসব সুড়ঙ্গ তৈরির টাকা তুলেছে হামাস। এছাড়া অর্থ ও প্রকৌশলী দিয়ে সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক নির্মাণে ইরান ও উত্তর কোরিয়া তাদের সাহায্য করেছে বলেও ধারণা করা হয়।
২০১৪ সালে 'অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ' নামক অভিযান চালায় আইডিএফ। বিমান ও স্থল আক্রমণের সমন্বয়ে সাজানো ওই অভিযানের লক্ষ্য ছিল হামাসের সুড়ঙ্গগুলো। ওই অভিযানে প্রায় ৩২টি সুড়ঙ্গ ধ্বংস করে ইসরায়েল, যার মোট দৈর্ঘ্য হবে ১০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৪টি সুড়ঙ্গ সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলে ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু হামাসের সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক বিশাল। ধারণা করা হয়, এ নেটওয়ার্কে ১ হাজার ৩০০-র মতো সুড়ঙ্গ আছে। আর হামাসের তথ্যমতে, তাদের সবগুলো সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি মোট ৫০০ কিলোমিটার—যা কিনা গাজার দৈর্ঘ্যের চেয়েও দশগুণ বড়।
ওই যুদ্ধের পর একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে ইসরায়েল। কমিশনের অনুসন্ধানে উঠে আসে, এসব সুড়ঙ্গ যেরকম হুমকি তৈরি করতে পারে, তার জন্য মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত নয় আইডিএফ। দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বকে তখন সতর্ক করে দেওয়া হয় যে, হামাসের সুড়ঙ্গগুলো ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে বড় পাঁচ হুমকির একটি। ওই সময় ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী দম্ভভরে বলেছিলেন, আইডিএফ মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে সুড়ঙ্গগুলো ধ্বংস করবে। যদিও কাজটি করতে তাদের কয়েক সপ্তাহ লেগেছে।
সুড়ঙ্গ খুঁজে বের করা ভীষণ কঠিন ছিল। ২০১৩ সালে ইসরায়েলের একটি ডিভিশনের নেতৃত্ব দেওয়া জেনারেল নাদাভ পাদান বলেন, 'আমরা মূলত তাত্ত্বিকভাবে এসব সুড়ঙ্গ সম্পর্কে জানতাম। মাঠ পর্যায়ের কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের ছিল না।' আইডিএফ 'জিওফোন' এবং ভূগর্ভে কাজ করে এমন রাডার ব্যবহার করেছে, যা মাটির কম্পনকে ভোল্টেজে পরিণত করে। এছাড়া নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণের প্রতিধ্বনি শনাক্ত করার প্রযুক্তিও ব্যবহার করে তারা। ইসরায়েল অবশ্য অনেকগুলো সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখ খুঁজে পায়। এ কাজের জন্য ইসরায়েলি সিগন্যালস-ইন্টেলিজেন্স নজর রাখত কোন কোন জায়গায় হুটহাট ফিলিস্তিনিদের ফোনের সিগন্যাল চলে যায়।
তবে কোনো সুড়ঙ্গ খুঁজে পাওয়া গেলেও সেটি ধ্বংস করা ছিল আরেক কষ্টকর কাজ। ইসরায়েলি বিমান বাহিনী সুড়ঙ্গগুলো যে পথে গেছে, ঠিক সেই পথগুলোর ওপর বোমা ফেলতে চেষ্টা করে। কিন্তু অনেক বোমার বিস্ফোরণের ধাক্কাই পর্যাপ্ত গভীরতা পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। আইডিএফ 'এমুলসা' নামে জেলের মতো একটি বিস্ফোরক দিয়েও চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিটি সুড়ঙ্গের জন্য গড়ে ৯ থেকে ১১ টন বিস্ফোরক লাগত। পাশাপাশি স্থল বাহিনীকে দীর্ঘ সময় সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখ পাহারা দিতে হতো। গাজায় বিস্ফোরক আনার জন্য ইসরায়েলি সেনারা সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো থেকে ট্রলি ও কৃষি যন্ত্রপাতি ধার করে আনত।
অতীতে আইডিএফ সদস্যরা সাধারণত সুড়ঙ্গে লড়াই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। কারণ বহু সুড়ঙ্গেই বুবি-ট্র্যাপ থাকে। ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা এক প্রান্ত উড়িয়ে দেওয়া কিংবা নিরাপদ করার আগপর্যন্ত সৈন্যদের সুড়ঙ্গে ঢুকতে নিষেধ করেছেন। এ আদেশের যৌক্তিকতা আছে। অনেক দিক থেকেই মাটির নিচে লড়াই নগর যুদ্ধের সবচেয়ে কঠিন অংশ।
শহরে বেশিদূর নজরদারি করা যায় না, লড়াইয়ের সময় দুই পক্ষ খুব কাছাকাছি থাকে। আর উঁচু ভবনের মধ্য দিয়ে রেডিও সিগন্যাল দুর্বল হয়ে পড়ে বলে যোগাযোগ ব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে যায়। সুড়ঙ্গে এই সবগুলো জিনিসই আরও খারাপ হয়ে পড়ে। সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির ড্রোনও মাটির নিচে কী চলছে দেখতে পারে না। জিপিএস ব্যবহার করে পথ খুঁজে বের করাও অসম্ভব। রেডিও সিগন্যাল ব্যবহার করেও খুব বেশি দূর পর্যন্ত যোগাযোগ করা যায় না।
সম্প্রতি ইংল্যান্ডের লিডসে একদল ব্রিটিশ সৈনিক সুড়ঙ্গে লড়াই করার প্রশিক্ষণ নিয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিয়েছে আইডিএফের সৈন্যরা কী কী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গে থাকবে কালিগোলা অন্ধকার, সেখানে নাইট-ভিশন গগলস কোনো কাজে আসবে না। কারণ এ চশমা ক্ষীণ আলোকে বর্ধিত করে রাতের আঁধারে দেখতে সাহায্য করে। মাটির নিচের বদ্ধ জলার স্থির পানিকে নাড়িয়ে দিলে সেখান থেকে বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মাটির ওপরের চেয়ে মাটির নিচের তাপমাত্রা দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কম। প্রশিক্ষণ নেওয়া একজন ব্রিটিশ সৈন্য বলেন, মাটির নিচে দীর্ঘদিন না কাটালে সেখানে দ্রুত নড়াচড়া করা যাবে।
বদ্ধ জায়গায় গুলির আওয়াজও বহুগুণ তীব্র হবে। এ কারণে বড় দল নিয়ে নিচে নামতে হলে আগে সুড়ঙ্গে খালি করতে হবে। এছাড়া বেশি মানুষের চাপ থাকলে গুলি করলে ধুলা ও ময়লা ওড়ে, ফলে বেশিদূর দৃষ্টি চলে না।
একসময় যেসব পদ্ধতিতে সুড়ঙ্গ খালি করা হতো, সেগুলো এখন বেআইনি বিবেচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন, আমেরিকা ভিয়েতনামে টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করেছিল।
প্রযুক্তির ওপর আইডিএফের নির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে। যেমন, তাদের রিমোট-কন্ট্রোলড গ্রাউন্ড রোবট রয়েছে। এরা পেতে রাখা বুবি-ট্র্যাপ বা অ্যাম্বুশের আয়োজন শনাক্ত করতে পারে। মাটির নিচে এই রোবট ব্যবহার করতে পারে আইডিএফ। কিন্তু প্রযুক্তিটি নির্ভরযোগ্য নয়। এ রোবট বেশ কয়েকবার সুড়ঙ্গের ভেতর আটকে গেছে বলে অভিযোগ করেন একজন এলিট আইডিএফ সেনা। সেক্ষেত্রে সুড়ঙ্গের ৪০০ মিটার ভেতরে আটকে যাওয়া একটা রোবট ফিরিয়ে আনতে কোনো সৈন্যকেই ছুটে যেতে হবে। আর ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের ভেতর ১৫০ মিটার দৌড়ানো কোনো মরুভূমিতে এক মাস দৌড়ানোর মতো বলে মন্তব্য করেন ওই আইডিএফ সেনা।
অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ-এর পর ৯ বছর কেটে গেছে। এই ৯ বছরে আইডিএফ সুড়ঙ্গ অভিযানের ওপর বিপুল বিনিয়োগ করেছে। নতুন প্রযুক্তি ও বিশেষায়িত ইউনিট তৈরি করেছে তারা। প্রশিক্ষণের জন্য হামাসের টানেলের মতো করে নিজস্ব সংস্করণ বানিয়ে নিয়েছে।
আইডিএফের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। ১৬ অক্টোবর আইডিএফের চিফ অভ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারজি হালেভি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তারা গাজায় প্রবেশ করে হামাস যেসব জায়গায় বসে প্রস্তুতি নেয়, কাজ ও পরিকল্পনা করে, হামলা করে, ওইসব জায়গায় যাবেন। তারপর প্রত্যেকটা জায়গায় আক্রমণ করে হামাসের প্রত্যেক কমান্ডার, সৈনিক ও অবকাঠামোকে ধ্বংস করবেন। কিন্তু বাস্তব হলো, মাটির নিচে বিস্তৃত কয়েকশো কিলোমিটার সুড়ঙ্গ ধ্বংস করতে কয়েক সপ্তাহ বা মাস নয়—কয়েক বছর কাজ করতে হবে।