আরেকটা রক্তাক্ত হাসপাতাল...
গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় ক্রমাগত বিমান হামলা করে যাচ্ছে। এতে আহত ও নিহত হচ্ছে হাজার হাজার বেসামরিক গাজাবাসী। ঠিক তেমনি বোমাবর্ষণের দশম দিনে উপত্যকাটির খান ইউনুস শহরে নাসের মেডিকেল সেন্টারে আহত, রক্তাক্ত অবস্থায় ভর্তি হয় অনেকে।
সেদিনই ইসরায়েলের বিমান হামলায় সেখানকার স্থানীয় একটি পরিবারের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়; যারা কিনা গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে আসা বাস্তুচ্যুত একটি পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ওই হামলায় কয়েক ডজন মানুষ আহত ও নিহত হয়, যার মধ্যে ছিল একটি শিশুও।
হাসপাতালের ইমারজেন্সি রুমে চিকিৎসকেরা আহত অবস্থায় আসা মানুষগুলোকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছিল। তার পাশেই ছিল ওই ছেলে শিশুটির দেহ। বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপের পুরু আস্তরণে ঢাকা পড়েছিল সে।
মোহাম্মদ জাকাউত নামের একজন শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শিশুটির অবস্থা পরীক্ষা করে এবং দেখতে পায় যে তার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। এই ঘটনা সম্পর্কে ঐ ইমারজেন্সি রুমে দায়িত্বরত গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আয়মান আল-ফাররা টেলিফোন সাক্ষাৎকারে আল-জাজিরাকে বলেন, "সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। শিশুটির দেহে কোনো আঘাত ছিল না!"
তবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এই শিশুটির বাবা-মা কে, সেটি জানা যায়নি। এমনকি শিশুটির নামও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে হাসপাতালটিতে ভর্তি হওয়া নাম-পরিচয়হীন হিসেবে ভর্তি থাকা এই শিশুটিই প্রথম নয়। বরং ইসরায়েলের বিমান হামলার পর থেকে এমন বহু শিশুই এখানে ভর্তি রয়েছে।
হাসপাতালের ইমারজেন্সি কক্ষের দায়িত্বে থাকা ২৪ বছর বয়সী ইন্টার্ন চিকিৎসক ওমর আল-নাজ্জার এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে জানান, প্রতিটি বিমান হামলা যখন একেকটি বাড়িতে আঘাত করে, তখন প্রায়শই একটি পরিবারের সবাই আহত কিংবা নিহত হয়। তখন তাদের পরিচয় সনাক্তের জন্য কাউকে পাওয়া যায় না।
নাজ্জার বলেন, "তাই আমরা তাদের পাশে অজ্ঞাত ১, অজ্ঞাত ২, অজ্ঞাত ৩ এমন নাম লিখে থাকি। তবে নাম-পরিচয়হীন কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ শিশু খুঁজে পাওয়ার ঘটনা একটু ব্যতিক্রমই ছিল। যদিও এগুলো খেয়াল করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। দিন কখন শুরু হচ্ছে, কখন শেষ হচ্ছে, আমাদের জানা নেই। কেননা আমরা সার্বক্ষণিক ইমারজেন্সি কক্ষে কাজ করছি।"
নাজ্জার খান ইউনুসের পূর্ব প্রান্তে বসবাস করেন। তার বাড়ি থেকে মাত্র আধা মাইল দূরত্বে ইসরায়েলের সীমান্ত। গত ৭ অক্টোবর রাতে হামাস যখন ইসরায়েলের আক্রমণ করে তখন নজ্জার গভীর ঘুমে ছিলেন। ঠিক পরের দিন টেক্সট বার্তার মাধ্যমে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী অতি দ্রুত তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
ইসরায়েলের বোমাবর্ষণের ভয়ে নাজ্জার পরিবারসহ নিজ বাড়ি ত্যাগ করেন। তার পরিবার এখন খান ইউনুস শহরে যেয়ে কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে আবার কেউ জাতিসংঘের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে।
অন্যদিকে নাজ্জার হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা অবস্থান করে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ক্লান্ত হয়ে গেলে ফ্লোরেই ঘুমিয়ে পড়ছে। হাসপাতাল প্রশাসন কর্মীদের ২৪ ঘণ্টা শিফটে ভাগ করে কাজ করাচ্ছেন।
নাজ্জার জানান, তার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সুযোগও অবশ্য নেই। কেননা ইসরায়েলের বোমা হামলার অষ্টম দিনে তার বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ইসরায়েলি বিমান চারপাশের জায়গা ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে।
ঐ হাসপাতালে ইমারজেন্সি রুমে দায়িত্বরত গাজার আরেক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফাররা জানান, অন্যান্য শত শত চিকিৎসক এবং নার্সকেও হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। তারা কেউ হয়তো অফিসে গদির মধ্যে ঘুমাচ্ছেন।
ফাররা বলেন, "নার্স কিংবা চিকিৎসকদের এমন কোনো অফিস নেই যেখানে হাসপাতালের অন্তত ২০ জন কর্মকর্তা থাকছে না।"
ইসরায়েলের ক্রমাগত বিমান হামলা ও স্থল অভিযানের সম্ভাবনায় গাজাবাসী নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছে। এমতাবস্থায় শুধু আহত নয়, বরং হাজার হাজার সুস্থ মানুষও হাসপাতাল কমপ্লেক্সে আশ্রয় নিয়েছে। তারা হাসপাতালের সামনের মাঠে, বারান্দায়, এমনকি ছাদের উপরেও বিছানা করে থাকছে।
নাজ্জার বলেন, "বাস্তুচ্যুত মানুষেরা হাসপাতালের নানা জায়গায় ব্যাগ রেখে নিজেরা থাকা শুরু করেছে। কোনো জায়গায়ই খালি নেই। ফলে হলওয়ে এবং লিফটে জটলা সৃষ্টি হয়েছে। যা চিকিৎসক ও রোগীদের চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি করছে। একইসাথে বাড়তি মানুষের চাপের ফলে হাসপাতালের পানির সংকট দেখা দিয়েছে।"
এই বিষয়ে হাসপাতালটির ম্যাটারনাল মেডিসিনের প্রধান ওয়ালেদ আবু হাতাব বলেন, "কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এমতাবস্থায় কী করতে পারে? আমরা তাদের বাথরুম বা পানির ব্যবহার তো বন্ধ করে দিতে পারি না। এটা করা যায় না।"
এখনও পর্যন্ত হাসপাতালটি বেসামরিক নাগরিকদের একটি নিরাপত্তা বলয় হিসেবে কাজ করছে। কেননা ক্রমাগত বিমান হামলায় আশেপাশের বহু এলাকা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। আর প্রতিনিয়ত যেন পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
ফোনে সাক্ষাৎকার প্রদানের সময় ফাররা তার সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করে, "ইব্রাহিম, আজ কি রুটি এসেছে?" উত্তরে সহকর্মী জানান, খাবার জন্য রুটি এখনো এসে পৌঁছায়নি।
ফাররা ও অন্যান্য চিকিৎসকেরা জানান, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগী ও কর্মীদের খাবার হিসেবে শুধু ভাত দিয়ে পারছে। কখনও কখনও সন্ধ্যার খাবারে পনির কিংবা শসা দেওয়া হচ্ছে।
ফাররা বলেন, "স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ফলমূল দিতে পারছে না। কেননা এখন বেশ কম সাপ্লাই রয়েছে। আমি নিজেও সবজির বাজারে গিয়েছিলাম। সেখানে দাম অনেক বেশি। আমাদের পক্ষে তাদের সেগুলো দেওয়া সম্ভব না।"
হাসপাতালটিতে সাড়ে তিনশত রোগীর ধারণক্ষমতা ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ধারণক্ষমতার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি রোগী রয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জরুরী কক্ষের শয্যা সংখ্যা তিনগুণ বাড়িয়ে ৬০ করেছে। এছাড়াও অপারেটিং কক্ষের সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেছে। আর আইসিইউর সংখ্যা বারো থেকে বৃদ্ধি করে ৪০ টি করেছে।
তবুও আইসিইউতে কিছু রোগীকে ফ্লোরে থাকতে হবে। কারণ সেখানে চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত পরিমানে শয্যা নেই।
নাজ্জার জানান, বোমা হামলার শিকার আহতরা সবসময় অনেক বেশি সংখ্যায় আসে। এক্ষেত্রে, একবারে অন্তত দশজন, এমনভাবে আসে।
এ প্রসঙ্গে ফাররা বলেন, "প্রায় সমস্ত আঘাতই বেশ গুরুতর। তাদের সার্জারি এবং নিবিড় পরিচর্যা প্রয়োজন। কিন্তু এদিকে হাসপাতালে ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। এনেস্থেশিয়া নষ্ট হয়ে গেছে।"
নাজ্জার জানান, এমতাবস্থায় হাসপাতালে টিউব, ডায়ালাইসিস ফিল্টার, স্যালাইন এবং অর্থোপেডিক যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে। এমনকি অবস্থা বিবেচনায় মুখের ক্ষতযুক্ত একজন রোগীকে সেলাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ কিনতে স্থানীয় ওষুধের দোকানে তাকেই পাঠানো হচ্ছে।
তবে হাসপাতালটির জন্য সবচেয়ে বড় সংকট হলো জ্বালানি ও বিদ্যুতের সরবরাহ কমে যাওয়া। কেননা গাজায় ঘন ঘন ব্ল্যাকআউটের সময়ই হাসপাতালটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দিনে ১,৩০০ গ্যালন জ্বালানির প্রয়োজন হতো। আর এখন তো হাসপাতালটি ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞার কারণে বিদ্যুৎপ্রাপ্তির সুবিধা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে।
ফাররা জানান, হাসপাতালটিতে আর মাত্র দুই বা তিন দিন চলার মতো জ্বালানি অবশিষ্ট আছে। সার্জারি ও আইসিইউতে বিদ্যুৎ সরবারাহ নিশ্চিতের জন্য ইতিমধ্যেই শিশুরোগসহ বেশ কয়েকটি ইউনিটে বিদ্যুৎ সরবারাহ বন্ধ রাখা হয়েছে।