দৈনিক সামরিক বিরতিতে ইসরায়েলের সম্মতি; তবে সংঘাত চলছেই
ইসরায়েল উত্তর গাজার কিছু অঞ্চলে দৈনিক চার ঘণ্টার জন্য সামরিক অভিযান বন্ধে সম্মত হয়েছে। গতকাল (বৃহস্পতিবার) হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে এমনটাই জানানো হয়েছে।
কিন্তু এই ঘোষণার পরেও গাজায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হামলা বন্ধের কোনো প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়নি। বরং ইসরায়েলের ক্রমাগত বোমা হামলায় উপত্যকাটিতে মৃত্যুর মিছিল যেন বাড়ছেই।
এ সম্পর্কে হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা-বিষয়ক মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, "সামরিক অভিযান সাময়িক বন্ধ হলে বাসিন্দারা দুটি মানবিক করিডোর ধরে যাতায়াত করতে পারবে। একইসাথে জিম্মিদের মুক্তির ক্ষেত্রে এটি প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে।"
তবে ইসরায়ালের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মনে করেন, সামরিক অভিযানে বিরতির সিদ্ধান্তটি বেশ বিক্ষিপ্ত হবে। আর তাই তেল আবিবের পক্ষ থেকে বিরতির পরিকল্পনার বিষয়ে কোন আনুষ্ঠানিক নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি।
লড়াইয়ে বিরতি প্রদান সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ফক্স নিউজ চ্যানেলকে নেতানিয়াহু বলেন, "না। হামাস সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই অব্যাহত রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট স্থানে কয়েক ঘণ্টার জন্য বিরতি দেব। কেননা আমরা বেসামরিক নাগরিকদের লড়াইয়ের অঞ্চল থেকে দূরে নিরাপদে যাওয়ার সুবিধা দিতে চাই। তাই আমরা আমরা এটা করছি।"
এদিকে উত্তর গাজায় এখনো পর্যন্ত যুদ্ধে বিরতির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। বরং ইসরায়েলি বাহিনী গাজা শহর ঘেরাও করে রেখেছে। একইসাথে ট্যাংকগুলো হামাসকে উৎখাতের উদ্দেশে শহরের কেন্দ্রস্থলে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র লড়াইয়ে প্রতিটি পক্ষ অপর পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর দিচ্ছে।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে অবশ্য আগে থেকেই প্রতিদিন তিন বা চার ঘণ্টার জন্য দক্ষিণে গাজার প্রধান পথ ধরে বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে হোয়াইট হাউসের সাম্প্রতিক মন্তব্যে বাসিন্দাদের জন্য দ্বিতীয় রুট খোলার আভাস দেওয়া হয়েছে।
এ সম্পর্কে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেন, "গাজা শহর থেকে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের দক্ষিণাঞ্ছলে সরে যেতে আমরা স্থানীয়ভাবে নির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। যাতে করে বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা যুদ্ধ থেকে সরে আসছি।"
অন্যদিকে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর প্রধান মুখপাত্র এডমিরাল ড্যানিয়েল হ্যাগারি দাবি করেন, উত্তর গাজায় অবস্থিত হামাসের 'সিকিউরিটি কোয়ার্টার' এ অভিযান চালিয়েছে ইসরায়েলি সৈন্যরা। এতে ছিল কমান্ড সেন্টার, যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন কারখানা এবং অন্যান্য নানা গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ।
হ্যাগারি বলেন, "আমরা লড়াই করে ৫০ জনেরও বেশি সন্ত্রাসীকে শেষ করেছি। আমরা অনেক অস্ত্রও খুঁজে পেয়েছি। এরমধ্যে বেশিরভাগ ছিল গোয়েন্দা যন্ত্রপাতি। আমরা সেগুলো পর্যবেক্ষণ করবো। একইসাথে আমরা এই অঞ্চল এবং বাকি অঞ্চল শত্রুমুক্ত করতে থাকবো।'
অন্যদিকে জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, "লড়াইয়ে বিরতির মতো যেকোনো উদ্যোগের বিষয়ে জাতিসংঘের সাথে সমন্বয় করতে হবে। বিশেষ করে সময় ও অবস্থানের বিষয়ে এটা জরুরি। একইসাথে মানবিক উদ্দেশ্যে এটিকে সত্যিকার অর্থে নিরাপদে বাস্তবায়নের জন্য সংঘাতের সকল পক্ষের সাথে একমত হতে হবে।"
গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় প্রায় ১৪০০ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। একইসাথে জিম্মি করা হয় প্রায় ২৪০ জনকে; যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।
এই ঘটনার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে গাজায় ক্রমাগত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এতে প্রায় ১১ হাজার গাজাবাসী নিহত হয়েছে; যাদের মধ্যে প্রায় ৪০ ভাগই শিশু। একইসাথে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে উপত্যকাটিকে খাবার, ঔষধ ও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক মার্কিন শীর্ষ কূটনীতিবিদ বারবারা লিফ গত বুধবার মার্কিন কংগ্রেশনাল কমিটির মিটিংয়ে জানান, গাজায় নিহতের সংখ্যা যতটা বলা হচ্ছে সেটি হয়তো এরচেয়েও বেশি। যুদ্ধ বন্ধের পর হয়তো প্রকৃত সংখ্যাটি বেড়িয়ে আসবে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, যখন কি-না ধ্বংসস্তূপ পুরোপুরি পরিস্কার করা হবে, তখন গাজায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
অন্যদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন এক কর্মকর্তা জানান, সিআইএ ও মোসাদের প্রধান দোহায় গতকাল (বৃহস্পতিবার) কাতারের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। সেখানে হামাসের কাছে থাকা ইসরায়েলের জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
অন্যদিকে প্যারিসে মোট ৮০টি দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা গাজার মানবিক সংকট নিয়ে আলোচনার বসেছিলেন। সেখানে সংকট মোকাবেলা পরস্পর একসাথে হয়ে কাজ করা এবং করণীয়গুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।
এ সম্পর্কে নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের সেক্রেটারি জেনারেল জ্যান এগেল্যান্ড বলেন, "যুদ্ধবিরতি, অবরোধ প্রত্যাহার এবং নির্বিচারে বোমাবর্ষণ বন্ধ ছাড়া মানুষের প্রাণহানি অব্যাহত থাকবে।"
অন্যদিকে ইসরায়েল ও ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে হামাস লাভবান হবে। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল (বৃহস্পতিবার) ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী পুনরায় যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা নাকচ করে দেন।