কেন গাজার এই হাসপাতালগুলো ইসরায়েলি হামলার শিকার?
গাজা উপত্যকার হাসপাতাল তথা স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রগুলোতে ইসরায়েলি হামলা ক্রমেই বাড়ছে। একাধিক হাসপাতাল ঘিরে রেখেছে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান ও ট্যাঙ্ক। এসব হামলায় কেবল যে চিকিৎসাধীন হাজারো রোগীই আক্রান্ত হচ্ছেন তা নয়- এক লাখ ২২ হাজার ফিলিস্তিনি- যারা ঘরবাড়ি হারিয়ে এসব হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারাও ভুগছেন।
গতকাল শুক্রবার (১০ নভেম্বর) থেকে গাজার অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে হামলার আশঙ্কা আরো বেড়েছে। কীভাবে এসব হাসপাতাল লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে তা জানিয়েছে আল জাজিরা।
কোন হাসপাতালগুলো ইসরায়েলি ট্যাঙ্কে ঘেরা?
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক গতকাল শুক্রবার চারটি হাসপাতালকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। এ হাসপাতালগুলো হলো- আল-রানতিসি হসপিটাল, আল-নাসর হসপিটাল, একটি চক্ষু হাসপাতাল ও একটি মানষিক স্বাস্থ্য হাসপাতাল।
প্রায় এক হাজার মানুুষ আল-রানতিসি হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছে। এটি শিশুদের ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য গাজায় বিশেষায়িত একটি হাসপাতাল। এটি গাজার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। সম্প্রতি ইসরায়েল হাসপাতালটির বাইরে রাখা গাড়িগুলোর ওপর হামলা চালায়।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাই আল-কাইলা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে এবং হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও উপত্যকাজুড়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অবিরাম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
আল-শিফা হাসপালের পরিস্থিতি
উপত্যকাটির সবচেয়ে বড় চিকিৎসা কেন্দ্র আল-শিফা হাসপাতালে প্রথমে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরায়েল। এরপর থেকে আরও কয়েকবার হাসপাতালটিতে হামলা হয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ আল-কুদরা গতকাল শুক্রবার বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাতের পর থেকে ইসরায়েল হাসপাতালটিতে পাঁচ বার বোমা হামলা করেছে।
গত মাসজুড়ে এ হাসপাতালকে লক্ষ্য করে ধারাবাহিক হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল।
আল-শিফা হাসপাতালের চিকিৎসক আহমেদ মোখাল্লালাতি আলজাজিরাকে বলেন, "আপনি অনেক গুলির শব্দ শুনতে পাবেন। এরপর আপনি দেখবেন যে ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক আল-শিফা হাসপাতালের কাছাকাছি চলে আসছে।"
মেডিকেল শিক্ষার্থী এজুদিন লুলু স্থানীয় সময় শুক্রবার ইনস্টাগ্রামে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। সেখানে তিনি সতর্ক করেন যে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সম্পূর্ণ হাসপাতালটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হতে পারে।
এক চিকিৎসক জানান, আল-শিফা গাজা উপত্যকার বেশ বড় একটি হাসপাতাল। এর শয্যা সংখ্যা ৭০০। তবে বর্তমানে হাসপাতালটিতে ৫ হাজার রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস হাসপাতালটি তাদের সামরিক কার্যক্রমের উদ্দেশে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ ইসরায়েলের। হামাস অবশ্য এ অভিযোগ নাকচ করেছে। সংগঠনটি বলছে, আল-শিফা হাসপাতালের গাজার ৪০ হাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছে।
গত সপ্তাহে বিভিন্ন সময়ে আল-শিফা হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলা হয়েছে। হামলায় ধ্বংস হয়েছে হাসপাতালটির বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স।
কীভাবে হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম প্রভাবিত হচ্ছে?
গাজার আরেও কয়েকটি হাসপাতালের বিভিন্ন অংশ ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর শিকার হয়েছে। এর ফলে অবকাঠামোগত ও ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি চিকিৎসা কার্যক্রমও ভেঙে পড়েছে।
আল-কুদরা হাসপাতালের তথ্যমতে, চলতি সপ্তাহে হাসপাতালটির মাতৃত্ব বিভাগ ও বহির্বিভাগে হামলা হয়েছে।
বর্তমানে ইসরায়েল কর্তৃক গাজা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। আল-শিফা হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ ও জ্বালানি ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জ্বালানি না থাকায় হাসপাতালের জেনারেটরগুলো চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যে কারণে হাসপাতালের ভেন্টিলেটর ও ডায়ালাইসিসের জন্য ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো চালানো যাচ্ছে না।
আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মাদ আবু সালমিয়া বলেন, "এটি আমাদের চিকিৎসক দলের জন্য সত্যিই কষ্টের। এটি স্বাভাবিক বিষয় নয়। হয় রোগী কষ্ট পাচ্ছে, নয়ত প্রাণ হারাচ্ছে।"
এ দুটি হাসপাতালই উত্তর গাজায় অবস্থিত। জাতিসংঘের মানবিক কার্যালয়ের মুখপাত্র জেনস লেরকে বলেন, মিসর হয়ে দক্ষিণ গাজার রাফা সীমান্ত দিয়ে যে ত্রাণ সহায়তা আসছে, তা উত্তর গাজায় পৌঁছাচ্ছে না। তিনি এ অঞ্চলে ত্রাণ সহায়তা বাড়ানোর জন্য কারেম আবু সালেম সীমান্ত খুলে দেওয়ার জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানান।
এ পর্যন্ত যা হয়েছে
গাজায় হাসপাতালের সংখ্যা ৩৫টি। এরমধ্যে জ্বালানি ঘাটতি ও বোমা হামলায় অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির কারণে ২১টি হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গাজা সিটি ও জাবালিয়ায় প্যালেস্টিনিয়ান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির দুটি কেন্দ্রসহ গাজার খান ইউনিসের নাসের হাসপাতাল ও আল-কুদস হাসপাতালেও হামলা করেছে ইসরায়েল। এমনকি গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
গত ১৮ অক্টোবর আল-আহলি আরব হাসপাতালে বিমান হামলায় প্রায় ৫০০ মানুষ নিহত হয়। তবে ইসরায়েল এ হামলার জন্য ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীকেই দায়ী করেছে।
হাসপাতাল হামলার বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন কী বলে?
১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনে হাসপাতালগুলোকে বেসামরিক জায়গা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে ১৯৭৭ সালে এ আইনের সংযোজিত অংশে বলা হয়, শত্রুদের বিরুদ্ধে হামলার জন্য যদি হাসপাতাল ব্যবহৃত হয়, তাহলে হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষ এই নিরাপত্তা সুবিধা কার্যকর থাকবে না।