হাঁটা বনাম দৌড়ানো: দীর্ঘস্থায়ী সুস্বাস্থ্যের জন্য কোনটি বেশি উপকারী?
পৃথিবীতে যত ধরনের ব্যায়াম রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে হাঁটা অন্যতম। এটি বেশ সহজেই করা যায় এবং খুবই কার্যকরী। প্রতিদিন হাঁটাহাঁটির অভ্যাস উদ্বেগ, বিষণ্নতা, ডায়াবেটিস ও কখনো কখনো ক্যান্সার প্রতিরোধেও কাজ করে থাকে।
এ সম্পর্কে এক্সারসাইজ ফিজিওলজিস্ট অ্যালিসা ওলেনিক বলেন, "একবার আপনার শরীর হাঁটতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, আপনি হাঁটার প্রবণতা বাড়াতে চাইবেন।"
আপনি যদি হাঁটার ক্ষেত্রে কিছুটা সময় দৌড়াতে পারেন; তবে সেটি আরও ভিন্নধর্মী শারীরিক ও মানসিক সুবিধা প্রদান করে। সেক্ষেত্রে ব্যায়াম হিসেবে দৌড়ানো ঠিক কতটা ইতিবাচক, সেটি জানা প্রয়োজন। একইসাথে কীভাবে হাঁটার মাঝেই দৌড়ে ব্যায়াম করা যায়, সেটি সম্পর্কেও জানা দরকার।
হাঁটা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
যখনই হাঁটা কিংবা দৌড়ানোর উপকারিতা নিয়ে প্রসঙ্গ উঠবে, তখনই দুটি মূল বিষয় মনে রাখতে হবে। একটা হচ্ছে, এই ব্যায়ামগুলোর ফলে দেহের ফিটনেসে প্রভাব। এরমধ্যে রয়েছে হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের কার্যকারীতা বৃদ্ধির মতো বিষয়। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এর ফলে কি আয়ুস্কাল বৃদ্ধি পায় না-কি সেই সংক্রান্ত আলোচনা।
নর্থওয়েস্টার্ন মেডিসিন ব্লুহম কার্ডিওভাসকুলার ইনস্টিটিউটের স্পোর্টস কার্ডিলজিস্ট অ্যালিসন জিলিনস্কি জানান, ফিটনেস যাচাইয়ের সবচেয়ে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড হচ্ছে ভিও২ ম্যাক্স পদ্ধতি। এতে ভারী ব্যায়ামের সময় দেহে অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপ করে। একইসাথে আয়ুস্কাল সংক্রান্ত কোনো জোরাল অনুমান করততেও এটি ব্যবহার করা হয়।
২০২১ সালে প্রায় দুই হাজার মধ্যবয়স্কী নারী ও পুরুষকে নিয়েও একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। সেখানে দেখা যায়, প্রতিদিন কয়েক কদম হাঁটার মতো ছোট ছোট কাজও ভিও২ এর পরিস্থিতি উন্নতিতে সহায়তা করে। তবে আরও বেশি উপকার হয় যখন তুলনামূলক আরেকটু গতিতে হাঁটা কিংবা দৌড়ানো হয়। এটি হৃদস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাস বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ওলেনিক বলেন, "হাঁটার সময় যদি পরিস্থিতি এমন হয় যে, আপনি কথা বলতে পারছেন কিন্তু গাইতে পারছেন না, তবে সেটিকে হালকা থেকে মাঝারী মানের ব্যায়াম বলে মনে করা হয়। গবেষণায় দেখা যায় যে, মাঝারী মানের অনুশীলনের (দৌড়ানো) ফলে হৃদপিণ্ড শক্তিশালী হয় এবং কোষে নতুন করে মাইট্রোকন্ডিয়া তৈরি হয়। এটি পেশিতে শক্তি যোগায়।"
দৌড়ানো কেন অধিক উপকারী?
দৌড়ানোর উপকারিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে লোয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডাক চুল লি বলেন, "হাঁটার সাথে দৌড়ানোর সম্পর্কটা তুলনামূলক বেশি কার্যকরী। কেননা এক্ষেত্রে শুধুমাত্র গতির বিষয়টিই মুখ্য নয়। হাঁটাতে এক মুহূর্তে যেখানে এক কদম ফেলা যায়, কিন্তু দৌড়ানোতে সেক্ষেত্রে বেশ কয়েক কদম পার করে ফেলা যায়। এর ফলে তুলনামূলক বেশি শক্তির প্রয়োজন হয়।"
এমনকি খুব অল্প গতিতে দৌড়ানো শুরু করলেও সেটি হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসকে কর্মক্ষম করতে বাধ্য করে। এতে করে দেহে ভারী কাজ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
ফেডারেল হেলথ গাইডলাইন প্রতি সপ্তাহে ১৫০ থেকে ৩০০ মিনিট মাঝারী মানে ব্যায়াম করার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে অনুমান করা হয় যে, হাঁটার বিষয়টি দৌড়ানোর তুলনায় দিগুণ কার্যকরী হয়। অন্যদিকে আয়ুস্কালের কথা চিন্তা করলেও কিছু গবেষণায় দেখা যায় যে, হাঁটার থেকে দৌড়ানো উপকারী।
২০১১ সালে গবেষকেরা তাইওয়ানের প্রায় ৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্কদের কাছ থেকে জগিং ও দৌড়ানোর মতো ভারী ব্যায়াম এবং দ্রুত হাঁটার মতো মাঝারী ব্যায়াম করার তথ্য সংগ্রহ করে। এতে দেখা যায় যে, দৈনিক পাঁচ মিনিটের হাঁটা ১৫ মিনিটের হাঁটার মতোই আয়ুস্কাল বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। আর প্রতিদিন ২৫ মিনিট এবং ১০৫ মিনিটের দৌড়ানো মৃত্যুর ঝুঁকি শতকরা ৩৫ ভাগ পর্যন্ত কমিয়ে ফেলে।
হাঁটার অভ্যাস তৈরি ও দৌড়ানো
কিছু নিয়ম-নীতি না মেনে দৌড়ানোর অভ্যাসের আবার একটা খারাপ দিকও আছে। এটি ব্যক্তির দেহের সংযোগকারী টিস্যুতে অনেক সময় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে কয়েকটি ধাপে ধীরে ধীরে হাঁটার ও দৌড়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করলে ভালো হয়। তাই নতুন করে কেউ একজন এমন অনুশীলন শুরু করলে কিছু ধাপ অবলম্বন করতে হবে।
স্টেপ ১: কদমের সংখ্যা ঠিক করা
চিকিৎসক লি মনে করেন, আপনার যদি আগে থেকে ব্যায়ামের অভিজ্ঞতা না থাকে তবে শুরুর দিকে দৈনিক মোট ৩ হাজার কদম হাঁটার চেষ্টা করার কথা বলেছেন। সপ্তাহে অন্তত কয়েকদিন এটি চালু রাখতে হবে।
স্টেপ ২: হাঁটার গতি বৃদ্ধি করা
চিকিৎসক ওলেনিক মনে করেন যে, এরপর প্রতি সপ্তাহে তিন থেকে চারবার দ্রুত হাঁটার জন্য ১০ মিনিট আলাদা করে রাখা উচিত। এক্ষেত্রে ধীরে ধীরে সময়কাল বাড়াতে হবে, যতক্ষণ না আপনি এক ঘন্টার জন্য অভ্যাস তৈরি হয়।
স্টেপ ৩: দৌড়ানোতে অভ্যস্ততা আনা
প্রতিনিয়ত নিয়ম মেনে হাঁটাহাঁটির ফলে একটা ফিটনেস তৈরি হয়। তখন খুব অল্প সময়েই মাঝারী মানের দৌড়ানো সম্ভব হবে। এমনটায় অভ্যস্ততায় এসে গেলে সাধারণত প্রায় এক বা দুই মাস পরে বিরতি নিয়ে নিয়ে দৌড়ানোর অভ্যাস করতে হবে। পাঁচ মিনিটের দ্রুত হাঁটার সাথে ওয়ার্ম আপ করুন। তারপর তিন মিনিট হাঁটার সাথে এক মিনিট জগিং করুন। এটি তিন থেকে পাঁচ বার পুনরাবৃত্তি করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
স্টেপ ৪: ক্রমাগত দৌড়াতে থাকা
প্রতি এক কিংবা দুই সপ্তাহ অন্তর দৌড়ানোর ব্যবধান বাড়াতে হবে এবং মাঝে সময়ের পরিমাণ কমাতে হবে। একটানা দৌড়াতে না পারা পর্যন্ত এমন কৌশলই আয়ত্ত করতে হবে।
তবে এক্ষেত্রে আগে থেকেই চিকিৎসকের কাছ থেকে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে যে, নিজের হৃদপিণ্ড সংক্রান্ত কিংবা অন্যান্য সমস্যা রয়েছে কি-না। এক্ষেত্রে অসাবধানতাবশত বুকে ব্যাথার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।