ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত: গাজা-যুদ্ধ কি বদলে দিচ্ছে আঞ্চলিক রাজনীতি?
চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ এবং কীভাবে এ অঞ্চল বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করবে– এমন সব বিষয়ে গুরুতর কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। বিশেষত যখন ইসরায়েলের সব ধরনের অন্যায়, অনাচারের পেছনে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমা বিশ্ব। এরমধ্যে কিছু আরব দেশ নিজদের (শাসকগোষ্ঠীর) স্বার্থ সামলাতে এবং গাজায় চলমান গণহত্যার প্রেক্ষাপটে জনরোষ সামাল দিতে লোকদেখানো কূটনৈতিক তৎপরতা ও বিবৃতি দানে ব্যস্ত।
গত ১১ নভেম্বর সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত হয় ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ নিয়ে জরুরি আরব-ইসলামী যৌথ সম্মেলন। শনিবার সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান জানিয়েছেন, এই সম্মেলনের একটি প্রতিনিধি দল বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের রাজধানীতে গিয়ে গাজায় একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পক্ষে কথা বলবে।
প্রথমেই এ প্রতিনিধি দল যাবে চীনে, ও তারপরে রাশিয়ায়; এতে পশ্চিম থেকে আরব দেশগুলো এবার পুবমুখো হচ্ছে কিনা সেই প্রশ্নও দেখা দিচ্ছে। সাম্প্রতিক এ যুদ্ধের শুরু থেকেই বেশকিছু শক্তিশালী আরব রাষ্ট্র সতর্ক এক কূটনৈতিক খেলায় অবতীর্ণ হয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের অভ্যন্তরে এক মারাত্মক অভিযান পরিচালনা করে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ গোষ্ঠী ও গাজার শাসনক্ষমতায় থাকা হামাস। তারপর থেকেই শুরু হয় এ যুদ্ধ। প্রতিশোধ নিতে প্রথমে গাজায় নির্বিচারে বোমা ফেলতে থাকে ইসরায়েল, এরসাথেই পরবর্তীতে শুরু করে স্থল আগ্রাসন। এপর্যন্ত ইহুদিবাদী রাষ্ট্র সাড়ে ১৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, এবং একইসাথে ধবংস করে দিয়েছে গাজার অধিকাংশ বেসরকারি অবকাঠামো। বসতবাড়ি থেকে শুরু করে হাসপাতাল– ধবংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পায়নি কোনোটিই।
ফিলিস্তিনিরা আরব জনগণকে জানে, জানে আরবের রাজপথগুলোয় জনমানুষের প্রাণের দাবি কি, এবং ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আরব জনতার গভীর সমর্থনকে। কিন্তু, এসব দেশের নেতারা ফিলিস্তিনের ন্যায্য সংগ্রামকে পরিত্যাগ করেছে। ফিলিস্তিনিরা মনে করেন, তাঁরা শুধু কথাই বলেন, কিন্তু কথা অনুসারে কাজের উদ্যোগ কখনোই নেন না।
আরব দেশগুলো গাজার বিরুদ্ধে পরিচালিত ইসরায়েলি যুদ্ধকে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিলেও – ইতোমধ্যেই যেসব দেশ ইসরায়েলের সাথে শান্তিচুক্তি করেছে– নতুন এ সম্পর্ক রক্ষার বিষয়েও তারা সতর্ক থাকছে।
২০২০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্ততায় আব্রাহাম অ্যাকর্ড নামক চুক্তির অধীনে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কো ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ৭ অক্টোবরের আগের সময়ে ধারণা করা হচ্ছিল– অচিরে সৌদি আরবও একই পথে হাঁটবে। সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ, এবং ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনকারীদের মধ্যে নির্দ্বিধায় সৌদি আরবই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতো।
প্রভাবশালী ব্রিটিশ চিন্তক সংস্থা– চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা প্রোগ্রামের সহযোগী ফেলো এলহাম ফাখরো বলেন, "ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আলোচনা বন্ধ করে সৌদি আরব তুলনামূলক শক্ত অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু, অন্যান্য যেসব আরব রাষ্ট্র ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে তারা এটি ঝুঁকিগ্রস্ত করতে চাইছে না।"
গত ২ নভেম্বর বাহরাইনের পার্লামেন্ট এক বিবৃতিতে জানায়, ইসরায়েল থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মানামা। পরবর্তীতে অন্যান্য গণমাধ্যমের খবরে এ দাবি খণ্ডন করা হয়েছে। এবং সে বিষয়ে বাহরাইনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো মন্তব্যও করেনি।
আব্রাহাম অ্যাকর্ডে সই করা অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও তাঁদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিষয়টি উল্লেখ করেন ফিলিস্তিনি নীতি নেটওয়ার্ক আল-শাবাকার মার্কিন নীতি বিশেষজ্ঞ তারিক কেনি শাওয়া।
তিনি বলেন, এসব দেশের তুলনামূলক নিস্ক্রিয়তায় ফিলিস্তিনিরা মোটেও বিস্মিত নয়। "বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি এসব দেশের প্রতিক্রিয়ায়, বা সেটার ঘাটতিতে চরম বীতশ্রদ্ধ। কারণ, ফিলিস্তিনিরা আরব জনগণকে জানে, জানে আরবের রাজপথগুলোয় জনমানুষের প্রাণের দাবি কি, এবং ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আরব জনতার গভীর সমর্থনকে। কিন্তু, এসব দেশের নেতারা ফিলিস্তিনের ন্যায্য সংগ্রামকে পরিত্যাগ করেছে। ফিলিস্তিনিরা মনে করেন, তাঁরা শুধু কথাই বলেন, কিন্তু কথা অনুসারে কাজের উদ্যোগ কখনোই নেন না।"
আরব বিশ্ব ঐতিহাসিক একতা থেকে বহুদূরে অবস্থান করছে
মিশর ও জর্ডান আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের বহু আগে ইসরায়েলের সাথে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। আব্রাহাম অ্যাকর্ডস সই করা আরব দেশগুলোর তুলনায় গাজা যুদ্ধ নিয়ে এ দুটি দেশ থেকে বরং কিছুটা বেশি চাপ দেওয়া হচ্ছে তেল আবিবকে।
মিশরের প্রেসিডেন্ট তথা স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ এল-সিসি স্পষ্ট করেই বলেছেন, গাজাবাসীকে বাস্তুচ্যুত করে মিশরের সিনাই উপদ্বীপে পাঠানোর পরিকল্পনার কঠোর বিরোধিতা করেন তিনি।
ফিলিস্তিনিদের গণহত্যাকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব কতোটা আগ্রহের সাথে সমর্থন দিচ্ছে সেটা প্রত্যক্ষ করছেন আরব নেতারা এবং আরব জনতা। জাতভাই আরবদের প্রতি এই বর্বরতা তাদের চীনের সাথে সম্পর্কোয়নের দিকে ঠেলে দেবে।
তবে আরও সক্রিয়ভাবে রাফাহ সীমান্তপথ উন্মুক্ত না রাখায় কায়রোর সমালোচনাও করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, আম্মান থেকে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে জর্ডান। একইসঙ্গে নিজ রাষ্ট্রদূতকেও ফেরত এনেছে। জর্ডানের জনগণের প্রবল প্রতিবাদের মুখে ইসরায়েলের সাথে জ্বালানির বিনিময়ে পানি সরবরাহের একটি চুক্তি করা থেকেও সরে এসেছে।
উভয় দেশই অবশ্য গাজার সাথে সহমর্মিতা জানিয়ে বিক্ষোভ করা নিজ নাগরিকদের গ্রেপ্তারে সক্রিয় ও তৎপর রয়েছে। একইসঙ্গে, জনগণের মধ্যে থাকা ব্যাপক ক্ষোভ প্রশমনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কিছুটা দৃঢ় পদক্ষেপই নিয়েছে।
কেনি শাওয়া বলেন, '(জর্ডানের) বাদশা আব্দুল্লাহ, এল সিসি ও মোহাম্মদ বিন সালমানের মতো আরব নেতাদের কাছে ইসরায়েলকে চাপ দেওয়ার মতো কিছু উপায় আছে। যেমন তাঁরা সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা বা অতীত চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিতে পারেন।'
তবে তিনি এটাও বলেন, এসব রাষ্ট্রপ্রধানেরা পশ্চিমা দেশগুলোর থেকে পাওয়া সমর্থনকে ধরে রাখতে চায়। এবং এই সম্পর্কের মাধ্যমে পাওয়া অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সুবিধা লাভকেই অগ্রাধিকার দেয়।
তাঁর সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে ফাখরো বলেন, সাম্প্রতিক এ সংঘাতের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে তা নিয়ে বিভাজিত হয়ে পড়েছে আরব বিশ্ব। "ফিলিস্তিন নিয়ে আরব দেশগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিক যে একতা ছিল, আজ সেখান থেকে তারা বহু যোজন দূরে অবস্থান করছে। যেমন ১৯৭৩ সালের তেল নিষেধাজ্ঞার সাথে বর্তমান সময়ের পার্থক্য রাত-দিনের।"
১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় পশ্চিমা বিশ্ব ইসরায়েলকে সমর্থন করায় জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট– ওপেক সৌদি আরবের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোয় তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন সৌদি বাদশাহ ফয়সাল।
নিষেধাজ্ঞার ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোয় প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম তিনগুণ হয়ে যায় রাতারাতি। যুক্তরাষ্ট্রে দেশজুড়ে দেখা দেয় ভয়াবহ জ্বালানি সংকট।
কিন্তু, বর্তমানে কাতারের মধ্যস্ততায় গাজায় সাময়িক এক যুদ্ধবিরতি চললেও– ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষায় আরব দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ অবস্থান আজ যেন দিবাস্বপ্নের মতোই অলীক।
সৌদি আরব বিভিন্ন দেশকে ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইসরায়েলের এমন নিঃশর্ত সমর্থন– মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আরব শাসকদের সাথে এক পর্যায়ে দূরত্ব তৈরি করবে।
কেনি শাওয়ার মতে, পূর্ব ও পশ্চিমা বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে নতুন স্নায়ুযুদ্ধ চলার আজকের দিনের বাস্তবতায় এই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সম্ভাবনা আছে, অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ এসব দেশের সাথে অংশীদারত্ব তৈরি হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত মিত্রদের।
তিনি বলেন, 'ফিলিস্তিনিদের গণহত্যাকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব কতোটা আগ্রহের সাথে সমর্থন দিচ্ছে সেটা প্রত্যক্ষ করছেন আরব নেতারা এবং আরব জনতা। জাতভাই আরবদের প্রতি এই বর্বরতা তাদের চীনের সাথে সম্পর্কোয়নের দিকে ঠেলে দেবে।'