'আমি ইহুদিবিরোধী নই': ইউরোপজুড়ে নিষেধের মুখে পড়ছেন ফিলিস্তিনপন্থী শিল্পীরা
গত অক্টোবর মাসে ইসরায়েল গাজায় নির্বিচারে বোমা হামলা শুরু করে। তখন বাংলাদেশের ফটোসাংবাদিক শহিদুল আলম জার্মানিতে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন।
চলমান সহিংসতায় উদ্বেগ অনুভব করে শহিদুল আলম সোশ্যাল মিডিয়ায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদ জানান। তবে এবারই প্রথম নয়, বরং মানবধিকার সংক্রান্ত ইস্যুতে নিজ দেশের (বাংলাদেশ) এবং আন্তর্জাতিক নানা ইস্যুতেই সবসময় সোচ্চার তিনি।
শহিদুল আলম বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার চিত্র কয়েক দশক ধরে নিজের তোলা ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলছেন। তারই স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ সালে বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে তার গল্প উঠে আসে।
একই বছরে খ্যাতনামা এই ফটোসাংবাদিককে প্রায় ১০০ দিনেরও বেশি সময় জেলে কাটাতে হয়েছিল। এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করার পর 'মিথ্যা' বক্তব্যের দেওয়ার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরুর পর থেকে শহিদুল আলম নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে ফিলিস্তিনের সমর্থনে কয়েক ডজন পোস্ট করেছেন। ফেসবুকে তার প্রায় ১১৪,০০০ ফলোয়ার রয়েছে।
হামাসের হামলার পর অক্টোবরের ৮ তারিখ শহিদুল আলম পোস্ট করেন: "অর্ধ-নগ্ন ইসরায়েলি মৃতদেহ প্যারেডের খবরটি ভয়ংকর এবং এটি ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না।... ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী সব ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলির জন্য আমার সমবেদনা।"
অক্টোবরের ২৯ তারিখ আরেকটি পোস্টে শহিদুল আলম বলেন, "এই সপ্তাহান্তের ভয়ংকর সহিংসতা ইসরায়েলি বর্ণবাদের কুৎসিত বাস্তবতার পরিচয় দেয়। এটি মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে রাখা রাষ্ট্রহীন মানুষের প্রতি কয়েক দশক ধরে চলমান দখলদারিত্বের বাজে ফলাফল।"
পরবর্তীতে ২১ নভেম্বর দ্য জার্মান বিনালা ফর কনটেম্পোরারি ফটোগ্রাফি কর্তৃপক্ষ শহিদুল আলমের আলোকচিত্র প্রদর্শনী বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। মূলত তার পোস্ট 'অ্যান্টিসেমেটিক' (ইহুদিবিদ্বেষপূর্ণ) হওয়ার অভিযোগে এটি বাতিল করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, "গত ৭ অক্টোবরের পর শহিদুল আলমের সোশাল মিডিয়া পোস্টে এমন সব বিষয়বস্তুকে তুলে ধরা হয়েছে যা ইহুদি-বিরোধী হিসেবে বিবেচনার যোগ্য।"
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এসব পোস্টের মধ্যে উত্তর গাজায় ইসরায়েলি হামলাকে হলোকাস্টের সঙ্গে তুলনা এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে এমন অভিযোগ রয়েছে। এরপর শহিদুল আলমের সঙ্গে তাদের বিশ্বাসের সম্পর্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।
এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শহিদুল আলমের দুই সহ-কিউরেটর তানজিম ওয়াহাব ও মুনেম ওয়াসিফও প্রদর্শনী থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ফলে আগামী বছর তিন জার্মান শহরে হতে যাওয়া পুরো প্রদর্শনীটিই বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, শহিদুল আলমের প্রোফাইলে ফলোয়ারদের ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে করা 'বর্ণবাদী এবং এমন অন্যান্য কমেন্ট' তিনি মুছে দেননি।
যদিও সামগ্রিকভাবে শহিদুল আলম, তানজিম ওয়াহাব ও মুনেম ওয়াসিফ এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তারা বলেন, "ইতিহাসের কোন দিকে আমরা দাঁড়াবো সেটি নির্ধারণ করার নৈতিক দায়িত্ব আমাদের।"
আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শহিদুল আলম বলেন, "আমি একজন অ্যান্টি-জায়োনিস্ট। যার মানে হচ্ছে আমি উপনিবেশবাদ, দখল করে বসতি স্থাপনকারী, বর্ণবাদ এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে।"
শহিদুল আলম আরও বলেন, "আমি ইহুদিবিরোধী নই। এটা সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক যে, জার্মানি এ দুটিকে একত্রিত করে ফেলে। যেমনভাবে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী এজেন্ডাকে সমর্থন ও প্রচার করা হয়।"
তবে শুধু শহিদুল আলমই নয়, বরং জার্মানি ছাড়াও পশ্চিমা বিশ্বে শিল্প ও সাহিত্যজগতে আরও বহুজনের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে শিল্পী ও প্রতিবাদকারীদের একটা বড় অংশের দাবি, বার্লিনের এমন আচরণের ফলে বরং ইহুদি-বিরোধী বর্ণবাদের সাথে ইসরায়েলি নীতির সমালোচনাকে মিলিয়ে ফেলা হয়।
অক্টোবরের শুরুতে হামাসের আক্রমণের জের ধরে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা ফিলিস্তিনি লেখিকা আদানিয়া শিবলিকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া একটি ইভেন্ট 'অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত' করা হয়েছে। যদিও গত ২০ অক্টোবর উপন্যাস মাইনর ডিটেইল-এর জন্য তার একটি পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল৷
এদিকে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার যুদ্ধবিরতির সময়সীমা শেষ হয়েছে। তবে দুই পক্ষ সময়সীমা বৃদ্ধিতে কোনো ধরনের সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি। আর এতে করে গাজা উপত্যকায় ফের শুরু হয়েছে হামলা।
গাজা শহর এবং এর উত্তরাঞ্চলের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বর্তমানে ফিলিস্তিনি যোদ্ধা ও ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে। গাজার কেন্দ্রস্থলে নুসেইরাত ও বুরেইজ শরণার্থী শিবিরের কাছেও ইসরায়েলি ট্যাঙ্কগুলি গোলাবর্ষণ করছে।
অন্যদিকে তেল আবিবের পক্ষ থেকেও ফের হামলা শুরুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় চালানো হচ্ছে স্থল ও বিমানপথে হামলা।
গাজায় চলমান যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে হামাসের হামলায় ইসরায়েলে নিহত হয়েছেন ১,২০০ জন।