বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাণিজ্যপথ তৈরির চেষ্টা শুরুতেই যেভাবে হোঁচট খেল
মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য পথ তৈরির সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা– বাস্তবায়ন শুরুর আগেই থমকে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
'ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ ইকোনমিক করিডর' বা আইএমইসি– হিসেবে পরিচিত এ প্রকল্পের অগ্রগতি থমকে গেছে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে। অথচ গত বছরে যখন এটির উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন এর বিপুল সম্ভাবনার বিষয়ে দারুণ আশাবাদ ছিল ওয়াশিংটন ও তার প্রধান মিত্রদের। নতুন বাণিজ্যপথের অংশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নতুন রেলপথ সংযোগ নির্মাণের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু, বর্তমানে গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর নারকীয় গণহত্যার প্রতিবাদে লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা করছে হুথিরা। একইসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যজুড়েও বাড়ছে অস্থিরতা। বিস্ফোরক এই পরিস্থিতি, আইএমইসি'র বাস্তবায়নকে কার্যত শিকেয় তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের জন্যে এটি বড় ধাক্কা। কারণ, এর আওতায় চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড অবকাঠামো প্রকল্পকে মোকাবিলা, 'বৈশ্বিক দক্ষিণ' হিসেবে পরিচিত উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রভাব আরো বিস্তার, এবং ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপনকে দ্রুততর করার প্রচেষ্টাও ছিল ওয়াশিংটনের।
পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে প্রস্তাবিত নতুন বাণিজ্যপথ
জার্মানির মার্শাল ফান্ডের সম্মানীয় ফেলো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাবেক সংযোগ বিষয়ক বিশেষ দূত রোমানা ভ্লাহুতিন বলেন, "সঙ্গতকারণেই, এ প্রকল্প ইরান, রাশিয়া, চীন এবং এমনকি তুরস্কেও উদ্বেগ সৃষ্টি করে। আর ঠিক এ বিষয়টিই প্রকল্পটির কৌশলগত গুরুত্বের সেরা প্রমাণ।"
আইএমইসি পরিকল্পনার বিষয়ে অবহিত একজন কর্মকর্তার কাছে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় সম্পর্কে জানতে চায় মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গ। তিনি জানান, মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সহিংসতার কারণে আইএমইসি নিয়ে আলাপ-আলোচনা থেকে মনোযোগ সরে গেছে।
"খেলার মোড় পরিবর্তনকারী!"
চীনের সাথে বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায়– যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন – উন্নয়নশীল বিশ্বের সমর্থন আদায়ে হিমশিম খাচ্ছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরে উদীয়মান অর্থনীতির অনেক দেশ নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখে। বর্তমানে তারা গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে সমর্থন দিচ্ছে। উভয় ক্ষেত্রেই তারা আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিকে অনুসরণ করতে অসম্মতি জানিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে, বেকায়দায় পড়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। উন্নয়নশীল বিশ্বের ওপর প্রভাব বাড়াতে উন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭ নানান আকর্ষণীয় প্রস্তাব দিচ্ছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের তথাকথিত একক মূল্যবোধের আবেদন কমে গেছে বুঝতে পেরে– তারা এখন বাস্তবসম্মত অবকাঠামো প্রকল্পে সহায়তা দেওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে।
এরমধ্যে সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিল আইএমইসি'র উদ্যোগ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে যা চূড়ান্ত ঘোষণা হয়– যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের একযোগে হ্যান্ডশেকের মধ্যে দিয়ে।
এই ঘোষণা অনেককেই বিস্মিত করে। কারণ, এর মূল অঙ্গ হচ্ছে, রেললাইনের মাধ্যমে নতুন একটি সংযোগ তৈরির পরিকল্পনা। মূলত ভারত থেকে শুরু হয়ে ইউরোপ অবধি রেল ও নৌ নেটওয়ার্ক চালুর পরিকল্পনা রয়েছে আইএমইসির আওতায়। এটি নৌবাণিজ্য বন্দর এবং ট্রাকে পণ্য পরিবহনের নেটওয়ার্ককে একসূত্রে গাঁথবে। জি-২০ সম্মেলনে বাইডেন এটিকে 'আঞ্চলিক বিনিয়োগের মোড় পরিবর্তনকারী" হিসেবে উল্লেখ করেন।
ইসরায়েল আইএমইসির বড় সুবিধা পাবে। আর ঠিক একারণেই প্রকল্পটিকে বাইডেন প্রশাসনের আসল লক্ষ্য– ইসরায়েল ও সৌদির মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক দৃঢ় করার দিকে একধাপ এগিয়ে যাওয়া হিসেবে মন্তব্য করেন অনেক বিশ্লেষক।
গত সপ্তাহে সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান বলেন, "ইসরায়েলের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আরব রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয় থাকবে– এমন একটি প্যাকেজ চুক্তির উদ্দেশ্যে নেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ।" একইসঙ্গে, ফিলিস্তিনিদের জন্যেও একটি "রাজনৈতিক পথ" নির্মাণের প্রচেষ্টা ছিল। হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর আগে, আমাদের এসব লক্ষ্য ছিল।
কিন্তু, ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে সামরিক অভিযান চালায় হামাস। এই সংঘাত এখন মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক ফ্রন্টে ছড়িয়ে পড়ছে। ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের সাথে সংঘাত হচ্ছে হামাসের মিত্র– হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুথিদের। মধ্যপ্রাচ্য আরো একবার বারুদের স্তূপে পরিণত হয়েছে। এমনকী ইরানের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধের হুমকি তৈরি হয়েছে।
"কাগুজে সম্ভাবনা"
মধ্যপ্রাচ্যে হানাহানি ও রক্তপাতের এসব ঘটনা হঠাৎ করেই থমকে দিয়েছে আইএমইসি বাণিজ্যপথ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। প্রস্তাবিত এই বাণিজ্যপথে মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশযুক্ত তারা এখন গাজায় চলমান যুদ্ধের আঁচ অনুভব করছে। গাজায় বিপুল বেসামরিক মানুষ হত্যার প্রতিবাদে ক্ষোভে ফুঁসছে আরব জনতা। এই অবস্থায়, এই ইসরায়েলের সাথে ইতোমধ্যেই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা সংযুক্ত আরব আমিরাতকে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। অন্যদিকে, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হলে– ইসরায়েলের সাথে যেকোনো ধরনের চুক্তির সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছে সৌদি আরব।
আইএমইসি যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হলেও– এটি বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে একটি যুদ্ধ নাহলেও হয়তো আইএমইসি ব্যর্থ হতো।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক চিন্তক সংস্থা– ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস' এর জ্যেষ্ঠ ফেলো ক্রেইগ সিঙ্গেলটন বলেন, "কাগজে-কলমে আইএমইসি প্রচুর সম্ভাবনাময় হলেও– ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের জটিলতা এর বাস্তবায়নকে বিভিন্নভাবে অবশ্যই চ্যালেঞ্জ করতো।"
তবে ভিন্নমতও রয়েছে অনেক বিশেষজ্ঞের। তাঁরা বলছেন, গতবছরের সেপ্টেম্বরে এই আইএমইসি ঘোষণা দেওয়া দেশগুলো– আঞ্চলিক অস্থিরতা দূর হলে আবার এ উদ্যোগ নিয়ে এগুবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের একজন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, "এই উদ্যোগের কৌশলগত যুক্তি এখনো অটুট রয়েছে, এমনকী হয়তো আগের চেয়েও দৃঢ় হয়েছে। অংশগ্রহণকারী দেশগুলো এই ভিশন বাস্তবায়নে গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।"
জি-২০ সম্মেলনে একাধিকবার এ প্রকল্পকে একাধিকবার 'ঐতিহাসিক' বলে উল্লেখ করেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগকে মোকাবিলায় এটিকে মোক্ষম উপায়ও বলেন তিনি।
এরপর অক্টোবরের শুরুতে হোয়াইট হাইসে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, "আমরা এটির (বেল্ট অ্যান্ড রোড) বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করব। তবে ভিন্নভাবে তা করা হবে।"