এক ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত হেরে যাওয়া ম্যালেরিয়ার যুদ্ধকে আরও কঠিন করে তুলেছে
বিশ্ব ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে। এশিয়া ও আফ্রিকায় তাণ্ডব চালানোর পর ম্যালেরিয়া এখন হানা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোতেও।
১০ বছরেরও আগে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম মশারি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের নেওয়া একটি ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তই যেন এ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে।
সস্তা, টেকসই, কীটনাশকের আবরণ দেওয়া মশারিগুলো গত দুই দশক ধরে ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এগুলো শুধু মশাদের আমাদের বিছানা থেকেই দূরে রাখে না বরং কীটনাশকের আবরণের কারণে মশাদের মেরে ফেলে তাদের বংশবৃদ্ধিও নিয়ন্ত্রণ করে।
বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মতে, ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ৬৮ শতাংশ ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য মূল কৃতিত্ব মশারির।
কিন্তু এর পরের সালগুলোতে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের ইতিবাচক এ দৃশ্যে অনেক পরিবর্তন আসে।
পাপুয়া নিউ গিনির রোটারিয়ানস অ্যাগেইনস্ট ম্যালেরিয়ার প্রোগ্রাম ম্যানেজার টিম ফ্রিম্যান বলেন, 'ফলাফল অবাক করে দেওয়ার মতো। ২০১৫ সাল পর্যন্ত আমি ভেবেছিলাম এখন আমাদের একটা সুযোগ আছে। আমরা হয়ত এ দেশ থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূলের অনেক কাছাকাছি ছিলাম। এখন এখন আর আমি কোনও সম্ভাবনা দেখছি না।'
রোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা কত দ্রুত ব্যর্থ হতে পারে তার জন্য পাপুয়া নিউ গিনি অন্যান্য দেশের জন্য একটি উদাহরণ হিসেবে কাজ করে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর অস্ট্রেলিয়ার উত্তরপূর্ব উপকূলের দরিদ্র দ্বীপরাষ্ট্রটিতে ১০ মিলিয়নেরও বেশি লোক বাস করে। পাপুয়ানিউগিনিতে (পিএনজি) ২০১৭ সালের শুরু থেকে গবেষকরা ম্যালেরিয়ার তীব্র বৃদ্ধি লক্ষ্য করেছেন এবং ২০২২ সালের মধ্যে এ সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়ে ৮৮ শতাংশে পৌঁছেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি ৯০ লাখে পৌঁছেছে, আর মৃত্যু হয়েছে ৬ লাখ ৮ হাজার জনের।
বিজ্ঞানীদের মতে, বিনিয়োগ ও তহবিল হ্রাস, কীটনাশক প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং জলবায়ু পরিবর্তন এর মূল কারণ।
তবে পিএনজির গবেষকরা বলছেন যে তারা সুইস কোম্পানি ভেস্টারগার্ডের তৈরি পারমানেট ২.০ নামের মশারিতে একটি অতিরিক্ত সমস্যা আবিষ্কার করেছেন। প্রতিষ্ঠানটি তাদের মশারির রাসায়নিক আবরণ বা কীটনাশকে পরিবর্তন এনেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই পরিবর্তন মশার বিরুদ্ধে দেশটির প্রাথমিক প্রতিরক্ষাকে অকার্যকর করে তুলেছে।
তবে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের তদারকিতে নিয়োজিত বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর কাছে এই পরিবর্তন প্রতিষ্ঠানটি প্রকাশ করেনি।
বাড়ছে প্রকোপ
মশারি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ভেস্টারগার্ড জানায়, আগের আবরণটিতে পিএফএএস (পলিফ্লুরোয়ালকাইল পদার্থ) নামে পরিচিত ক্ষতিকারক রাসায়নিক ছিল, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করত। এ কারণেই এ পদার্থকে বাদ দেয়া হচ্ছে। এর পরিবর্তে যে রাসায়নিক পদার্থটি বেছে নেওয়া হয়েছে তা সস্তা এবং স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হলেও ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কম কার্যকর।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভেস্টারগার্ড আরও দামি কীটনাশক এবং ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে মশারির কার্যকারিতা রক্ষার জন্য তাদের উৎপাদন পদ্ধতিতে সামঞ্জস্য আনতে পারত।
তবে প্রতিষ্ঠানটি মশারির কার্যকারিতা হ্রাসের বিষয়টি স্বীকার করেনি বরং বলেছে যে তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা মেনেই উৎপাদন করছে। তারা জানায়, ২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত নাকি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না।
ভেস্টারগার্ডের মতো অন্যান্য নির্মাতারাও একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। তাই ধারণা করা হচ্ছে পাপুয়া নিউ গিনির মতো অন্যান্য দেশগুলোতেও ম্যালেরিয়া সংক্রমণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে পারে।
এক বিলিয়ন মশারি বিক্রি
গত সেপ্টেম্বরে ভেস্টারগার্ড এক বিলিয়ন কীটনাশক মশারি বিক্রির মাইলফলক উদ্যাপন করেছে। অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের কর্পোরেট নেতা, সমাজসেবী এবং বিশ্বস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানায় ভেস্টগার্ড।
সাবেক প্রধান নির্বাহী মিকেল ভেস্টারগার্ড ফ্রান্ডসেন বলেন, 'আমাদের সরঞ্জাম আছে, আমাদের উদ্ভাবন আছে। ম্যালেরিয়ায় আর কাউকে মরতে হবে না'। কিন্তু পিএনজির গবেষকরা বলছেন যে ভেস্টারগার্ডের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে।
পিএনজির মশাগুলো কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারায় দেশটি একচেটিয়াভাবে কীটনাশকযুক্ত পারমানেট ২.০ মশারি ব্যবহার করেছে।
২০১৯ সালে বিজ্ঞানীরা সেখানকার গ্রাম এবং প্রাদেশিক স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলো থেকে অব্যবহৃত এবং খোলা ভেস্টারগার্ড মশারির ওপরে পরীক্ষা চালান। তারা দেখেন যে, ২০১২ সালের আগে তৈরি মশারিগুলোর বেশিরভাগই মশার বিরুদ্ধে কার্যকর ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের পর তৈরি করা মশারিগুলোর মধ্যে মাত্র ১৭ শতাংশ মশারি ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হয়েছে।
পাপুয়া নিউগিনি ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল রিসার্চের বিজ্ঞান ও গবেষণা বিভাগের উপ-পরিচালক মোসেস লামান বলেন, 'আমাদের দল ভেবেছিল হয়ত কোনো ভুল হয়েছে। কিন্তু না কোনো ভুল হয়নি।'
ফ্রিম্যান এবং পাপুয়া নিউ গিনি ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল রিসার্চের কীটতত্ত্ব ল্যাবের প্রধান স্টিফেন কার্ল সহ গবেষকরা ২০২০ সালে নেচার জার্নালে তাদের ফলাফল প্রকাশ করেন। তবে মশারিগুলো কেন তার কার্যকারিতা হারাচ্ছে তা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি । তারা জানান, মশারির রাসায়নিক আবরণের পরিবর্তনের যোগসূত্র তৈরি করতে তাদের আরও দেড় বছর সময় লাগবে।
ভেস্টারগার্ডের একজন মুখপাত্র ক্যারল এসেক্স, গবেষকদের পরীক্ষা কৌশলটির সমালোচনা করে ব্লুমবার্গ নিউজকে বলেন, পারমানেট ২.০ মশারিটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড পূরণ করে।
এসেক্সের মতে, গবেষকদের করা 'কোন টেস্ট' সরাসরি ম্যালেরিয়া সংক্রমণ পরিমাপ করার জন্য ডিজাইন করা হয়নি। তিনি যুক্তি দেন যে, ম্যালেরিয়া সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য শুধু পারমানেট ২.০ কে দায়ী করা যায় না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এজন্য দুটি পৃথক পরীক্ষা করার অনুমতি দেয়। একটি 'কোন টেস্ট' পরীক্ষা এবং এটি ব্যর্থ হলে 'টানেল টেস্ট' পরীক্ষা। 'কোন টেস্ট' পরীক্ষাটি সংক্ষিপ্ত এবং মশাকে কয়েক মিনিটের জন্য কীটনাশকের সংস্পর্শে আনে আর টানেল টেস্ট প্রায় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা স্থায়ী হয়।
পিএনজির গবেষকরা 'কোন টেস্ট' পরীক্ষা পরিচালনা করেছিলেন। কারণ তাদের মতে, এটি টানেল টেস্ট পরীক্ষা থেকে আরও ভালো ফলাফল দেয়।
এটি বোঝাতে তারা ২০১৪ সালে করা একটি 'কোন টেস্ট' পরীক্ষার ফলাফল তুলে ধরেন যেখানে দেখা যায়, ২০০৯ সাল পর্যন্ত পাপুয়া নিউ গিনিতে ব্যবহৃত হওয়া মশারিগুলোর ৯২% কার্যকর ছিল।
নেচার জার্নালে গবেষণার ফলাফল প্রকাশের পর গবেষকরা ২০২২ সালের নভেম্বরে ম্যালেরিয়া জার্নালে আরেকটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন, যেখানে দেখানো হয় ভেস্টারগার্ডের মশারির রাসায়নিক আবরণ পরিবর্তনের ফলেই এর কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে, প্রতিষ্ঠানটি একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বলে, 'আমাদের পণ্যগুলোতে আনা যেকোনো ধরনের পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী বিধিবিধানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়। সকল পণ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড উভয়ই পূরণ করে তা যাচাই করার পরেই প্রয়োগ করা হয়।'
গত আগস্টে পিএনজির স্বাস্থ্যমন্ত্রী লিনো টম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুসকে লেখা এক চিঠিতে মশারি আগের মতো কার্যকর না হওয়ার কারণ খুঁজে বের করতে সংস্থাটিকে একটি টাস্কফোর্স গঠনের আহ্বান জানান।
ডব্লিউএইচও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং গবেষকদের কাছ থেকে আরও তদন্তের জন্য তথ্য চেয়েছে।
ম্যালেরিয়ার ভয়াবহতা
ম্যালেরিয়া প্রধানত পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু এবং গর্ভবতী মহিলাদের বেশি প্রভাবিত করে। বিশ্বব্যাংকের মতে, কিছু আফ্রিকান দেশে এর কারণে বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় ১.৩% হ্রাস পেয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ এতদিন না থাকলেও ২০২৩ সালে নয়টি ম্যালেরিয়ার ঘটনা ধরে পরে যা ২০ বছরের মধ্যে প্রথম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৩ সালের বৈশ্বিক ম্যালেরিয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী এখন ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক এলাকায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে এবং আফ্রিকার কিছু দেশে মশা বিভিন্ন কীটনাশকের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে।
বিশ্বের দরিদ্রতম অঞ্চলগুলোতে ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে মশারিই প্রাথমিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে। তাই এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানসম্পন্ন মশারি ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ।
পাপুয়া নিউ গিনির মাদাং প্রদেশের সিয়ার গ্রামের তিন সন্তানের জননী ২৩ বছর বয়সী হ্যানিপিন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন।
তিনি বলেন, 'আমার প্রথম সন্তানের বয়স তখন মাত্র দুই মাস ছিল এবং এটি সত্যিই আমাকে এবং আমার বাচ্চা উভয়ের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে। আমি কখনই চাই না যে আমার কোনো বাচ্চার এমন অভিজ্ঞতা হোক। তাই আমি নিশ্চিত করি যে, তারা সবাই যেন মশারির নিচে ঘুমায়।'
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও তাদের মশারির মান নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে। এপ্রিলে ডব্লিউএইচও জার্মানিভিত্তিক মেইনপোল জিএমবিএইচের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে, কারণ তাদের কিছু মশারিতে কীটনাশকের মাত্রা ভুল ছিল।
এর উত্তরে মেইনপোল ডব্লিউএইচও-এর একটি নথি সরবরাহ করে। যেখানে লেখা ছিল, 'গৃহীত ও পরিকল্পিত সংশোধনমূলক পদক্ষেপ বিবেচনায়' তাদের চীনের কারখানাটি আন্তর্জাতিক মান মেনে চলছে।
২০২১ সালে এইডস, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গ্লোবাল ফান্ডের এক তদন্তে দেখা যায়, দুবাইভিত্তিক কোম্পানি তানা নেটিংয়ের তৈরি মশারিও যথেষ্ট টেকসই নয়।
পাকিস্তানের জাতীয় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক মুহাম্মদ মুখতারের মতে, ২০২০ সালে পাকিস্তানের কর্মকর্তারা অপর্যাপ্ত কীটনাশক এবং ভুল আকারের মশারি খুঁজে পেয়েছিলেন। মুখতার প্রস্তুতকারকের নাম প্রকাশ করেননি তবে জানান যে, প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পাকিস্তানে কালো তালিকাভুক্ত। মুখতার বলেন, 'এটা একটা বড় শিক্ষা ছিল।'
ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় গবেষকরা উল্লেখ করেন, একটির পরিবর্তে দুটি কীটনাশক দিয়ে সজ্জিত নতুন মশারিগুলো যতটা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া উচিত ততটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
গবেষকরা উদ্বিগ্ন যে বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির কারণে মূল্য হ্রাসের পাশাপাশি এই জাতীয় ঘটনাগুলো মশারির গুণগত মান আরও হ্রাস করতে পারে।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের মেডিক্যাল এন্টোমোলজির অধ্যাপক মার্ক রোল্যান্ড বলেন, 'এটা অবশ্যই সত্য যে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গুণগত মানের অবনতি হয়েছে। তবে আপনি তাদের পুরোপুরি দোষ দিতে পারেন না কারণ তাদেরও মুনাফা অর্জন করতে হবে।'
পেছনের কাহিনি
গেটস ফাউন্ডেশন সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও দেশের অন্যতম লক্ষ্য হলো ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করা।
তবে, এই প্রচেষ্টার জন্য ২০২২ সালে বরাদ্দকৃত মোট তহবিলের পরিমাণ ছিল ৪.১ বিলিয়ন ডলার, যা ডব্লিউএইচওর বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা ৭.৮ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
গেটস ফাউন্ডেশনের ম্যালেরিয়া বিষয়ক পরিচালক ফিলিপ ওয়েলখফ ইমেইলের মাধ্যমে জানিয়েছেন, মশারির কার্যকারিতা বজায় রাখাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে সংস্থাটি। তবে পাপুয়া নিউগিনির পরিস্থিতি নিয়ে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি।
২০০০ সালের আগ পর্যন্ত ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে ব্যবহৃত মশারিগুলোতে কীটনাশকের প্রলেপ থাকত না। পরিবর্তে, লোকেরা প্রতি বছর নিজেরা মশারিগুলোকে কীটনাশকের দ্রবণে ডুবিয়ে রাখতেন। এই প্রক্রিয়াটি জটিল এবং সময়সাপেক্ষ ছিল, প্রায়শই পুরো গ্রামকে মশারিকে কীটনাশকে ডুবানোর জন্য বালতির চারপাশে জড়ো হয়ে অংশ নিতে হত। তাছাড়া পদ্ধতিটি নোংরা হওয়ার কারণে অনেকেই অপছন্দ করতেন।
জাপানের সুমিতোমো কেমিক্যাল কোম্পানি সর্বপ্রথম কীটনাশকযুক্ত মশারি তৈরি করে। রোল্যান্ড বলেন, তাদের মশারিগুলো বেশ কয়েক বছর ধরে, এমনকি পানিতে ধোয়ার পরেও এর কার্যকারিতা বজায় রেখেছিল।
টাইম ম্যাগাজিন ২০০৪ সালের সেরা আবিষ্কারের তালিকায় এটিকে তালিকাভুক্ত করেছে।
ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়। ভেস্টারগার্ড এবং সুমিতোমোর আধিপত্যের বাইরেও বাজারে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসায় প্রবেশ করে। যার ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ে এবং মশারির বিক্রয়মূল্য হ্রাস পায়। পারমানেট ২.০ এর মতো মশারিগুলো আগে যেখানে পাঁচ ডলারে বিক্রি হতো, এর দাম হ্রাস পেয়ে ১.৮৫ ডলারে এসে পোঁছায়।
রসায়নে পরিবর্তন এবং কিছু উত্তর
২০২১ সালের আগ পর্যন্ত পিএনজির গবেষকরা সাফল্যের মুখ দেখেননি। ভেস্টারগার্ডের কাছ থেকে আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে গবেষকদের একজন কার্ল, মশারি উৎপাদনে পারদর্শী অন্য একজনের সাথে দেখা করেন। আলোচনার মাধ্যমে তিনি মশারিতে প্রলেপ দেওয়া কীটনাশকটি আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন।
অস্ট্রেলিয়ার একটি ল্যাব নিশ্চিত করে যে, ২০১২ বা ২০১৩ সালের কোনো এক সময়ে মশারির রাসায়নিক আবরণে পরিবর্তন আনা হয়েছিল।
জানা যায়, মূল আবরণটিতে পিএফএএস ছিল, যা ধীর ভাঙ্গনের কারণে 'চিরস্থায়ী রাসায়নিক' নামে পরিচিত। পিএফএএস সাধারণত জুতা এবং ব্যাকপ্যাকের মতো পণ্যগুলোতে জল-প্রতিরোধী করার পাশাপাশি অগ্নিনির্বাপক ফেনাতে ব্যবহৃত হয়। তবে এটি ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি, গর্ভধারণের ক্ষমতা হ্রাস এবং শিশুদের বিকাশমূলক বিলম্ব ঘটায়।
এই উদ্বেগের কারণে, অনেক দেশ পিএফএএসের ব্যবহার সীমাবদ্ধ করে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিকল্প উপাদান সন্ধান করতে প্ররোচিত করতে থাকে।
ভেস্টারগার্ডের কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি পিএফএএস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। যার কারণে মশারি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল্প সস্তা রাসায়নিক উপাদান বেছে নেয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি মশারির মানের তদারকি করা ডব্লিউএইচওকে না জানিয়েই রাসায়নিক আবরণে পরিবর্তন আনে।
ভেস্টারগার্ডের মুখপাত্র এসেক্স বলেন, 'আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড পূরণ করার পাশাপাশি মশারিগুলোকে আরও সাশ্রয়ী করে এমন পদার্থ খুঁজছি।
রাসায়নিক উপাদান পরিবর্তন করার প্রধান কারণ ছিল কারণ তাদের সরবরাহকারী মূল প্রতিষ্ঠান এর উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এসেক্স জোর বলেন যে, প্রতিটি শিল্পে পণ্যগুলোকে নির্দিষ্ট মানদণ্ড পূরণ করতে হয়। রাসায়নিক আবরণের পরিবর্তন হলেও পারমানেট ২.০ এখনো সেই মানদণ্ড পূরণ করার সক্ষমতা রাখে।
পারমানেট ২.০ মশারিটি বিশ্বের দুইশোটিরও অধিক দেশে ব্যবহৃত হয়েছে। যে-সব দেশ অন্যান্য মশারি ব্যবহার করে সেখানে ম্যালেরিয়ার হার বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে কম কার্যকরী মশারি নাকি অন্যান্য কারণগুলোও বড় ভূমিকা পালন করে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
তবে পাপুয়া নিউ গিনিতে (পিএনজি) গবেষকরা তাদের মশারির কার্যকারিতা নিয়েই উদ্বিগ্ন। তারা ম্যালেরিয়ার ঘটনা বৃদ্ধির জন্য অন্যান্য অঞ্চলের মতো জলবায়ু পরিবর্তন বা কীটনাশক প্রতিরোধের মতো কারণগুলোকে দায়ী করেন না।
পিএনজিতে রোটারিয়ানস অ্যাগেইনস্ট ম্যালেরিয়ার প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফ্রিম্যান বিশ্বাস করেন যে, এই সমস্যাটি পিএনজির বাইরেও প্রসারিত এবং এটি বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ তৈরি করবে।
পিএনজির গবেষকরা যখন ভেস্টারগার্ড মশারির সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছিলেন, তখন তারা সমস্যাগুলো ডাব্লিউএইচও এবং অন্যান্য সংস্থার কাছে নিয়ে যান।
ফ্রিম্যান জানান, দ্য গ্লোবাল ফান্ড পিএনজিতে অন্যান্য ব্র্যান্ডের মশারিও পাঠিয়েছে কিন্তু সেগুলো খুব বেশি আকর্ষণ তৈরি করতে পারেনি। তিনি বলেন, 'এই মশারিগুলোর অবস্থা ভালো নয়।'
মশা মারতে কীটনাশক আগের মতো কার্যকর না হলেও মশারি এখনও রোগ বহনকারী পোকামাকড়ের বিরুদ্ধে সরাসরি একটি বাঁধা হিসেবে কাজ করে। এই প্রতিবেদনের জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়া প্রত্যেকেই মশারির ব্যাপক ব্যবহারের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন।
মশারির প্রযুক্তিতে উদ্ভাবন অব্যাহত রয়েছে, ভেস্টারগার্ড সহ কিছু সংস্থা রাসায়নিকের মিশ্রণযুক্ত নতুন মশারি বাজারে আনছে। কিন্তু, পারমানেট ২.০ মশারি এখনও বিশ্বব্যাপী বিক্রি হচ্ছে।
ফ্রিম্যান তার হতাশা প্রকাশ করে বলেন, 'এটি বিব্রতকর। গত ১০ বছর ধরে নিম্নমানের মশারি বিক্রি করা হচ্ছে, কিন্তু কেউ তা স্বীকার করছে না।'
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন