শতকোটি ডলার অনুদান, টিউশন-মুক্ত পড়াশোনার সুযোগ বদলে দিল শিক্ষার্থীদের জীবন
যুক্তরাষ্ট্রের একটি চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান– অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিন এর শিক্ষার্থী হচ্ছেন স্যামুয়েল উ। কোরিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করা বাবা-মার সন্তান স্যামুয়েল এখানকার প্রথমবর্ষের ছাত্র। মনে মনে লক্ষ্য ছিল এক রকম, কিন্তু শিক্ষা খরচের জন্য যেসব ঋণ তিনি করছেন, তা মেটাতে আয়ও বেশি করতে হবে। একথা ভেবেই, পড়াশোনার পর কার্ডিওলজি বা হৃদবিজ্ঞানে ক্যারিয়ার শুরুর কথা ভাবছিলেন।
কিন্তু, সাম্প্রতিক একটি ঘোষণা তাঁর এবং অন্য শিক্ষার্থীদের জীবন পালটে দিয়েছে। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিনের কর্তৃপক্ষ জানান, বড় অংকের একটি অনুদান পাওয়ায়– ছাত্রদের থেকে আর টিউশন ফি নেবেন না তারা।
মেডিকেল শিক্ষার জন্য বিপুল দেনা জমে যাওয়ার দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে ২৩ বছরের এই তরুণ এখন তাঁর স্বপ্নের পেছনে ছুটতে পারবেন। এই স্বপ্ন হলো– রাস্তার ছিন্নমূল মানুষকে চিকিৎসা সেবা প্রদান।
স্যামুয়েল বলেন, "এটি জেনে আমি ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি, এই ঘোষণায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে আমার জীবনে।"
দিনবদলের এই রূপকার হলেন– রুথ গটসম্যান। ওয়ালস্ট্রিটের পুঁজিবাজারের ধনাঢ্য এক বিনিয়োগকারী ছিলেন তাঁর প্রয়াত স্বামী। গত সোমবার ব্রঙ্কসে অবস্থিত মেডিকেল কলেজটিতে ১০০ কোটি ডলার অনুদানের ঘোষণা দেন রুথ। এই উপহারের সুবাদে চার বছর মেয়াদি কোর্সের শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারবেন। তবে এর সুফল অন্যরাও পাবেন কমবেশি।
রুথ নিজেও কিন্তু একজন চিকিৎসক। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিনের সাবেক অধ্যাপক এই সমাজ-দরদী নারী। এই কলেজের সাথে তিনি ৫৫ বছর ধরে জড়িত, এবং ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপার্সন।
তাঁর ঘোষণার দারুণ আবেগী প্রতিক্রিয়াই হয় ছাত্রদের মধ্যে। ৯৩ বছরের রুথ এই ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথে মিলনায়তনে উপস্থিত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা দাঁড়িয়ে সম্মান জানান তাঁকে। তুমুল করতালি, হর্ষধ্বনিতে মুখর হয় পরিবেশ; এসময় অনেকেই আবেগে কেঁদে ফেলেন।
এখানকার প্রথমবর্ষের আরেক শিক্ষার্থী জেড অ্যান্দ্রেঁদে। ফিলিপাইন থেকে তাঁর বাবা-মা যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার একটি গ্রামীণ এলাকায় অভিবাসন করেছিলেন। অভিবাসী বাবা-মার সন্তান জেডও দারুণ খুশি।
তিনি বলেন, "অনেক বড় একটা স্বস্তির ঢেউ আমার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে, শুধু আমারই নয়, ঘোষণাকালে আমরা যতো শিক্ষার্থী মিলনায়তনে উপস্থিত ছিলাম– সবারই একই অবস্থা হয়।"
সুফলভোগী এ দুজন শিক্ষার্থী আশাপ্রকাশ করেন, রুথের দেওয়া এই অনুদানের সুবাদে– নিম্ন আয়ের আরও বেশি অভিবাসী পরিবারের সন্তানেরা এই কলেজে পড়াশোনার সুযোগ পাবেন। এ ধরনের বিনামূল্যের শিক্ষার সুবিধা না পেলে– যাদের পক্ষে মোটা টাকা খরচ করে চিকিৎসক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মেডিকেল শিক্ষাঙ্গনকে দেওয়া এটিই সম্ভবত সবচেয়ে বড় অংকের অনুদান। তবে শুধু টাকার অঙ্কেই নয়, এর গুরুত্ব অন্যদিক দিয়েও অপরিসীম। নিউইয়র্ক শহর এবং রাজ্যের মধ্যে অন্যতম পিছিয়ে পড়া এলাকা ব্রঙ্কস। সেখানকার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে করা এই অনুদান শিক্ষাবৈষম্য কমাতে বড় অবদান রাখবে। এমনটাই বলেছে মন্তেফিওরে আইনস্টাইন– এটি অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিন এবং মন্তেফিওরে হেলথ সিস্টেম- নিয়ে গঠিত মূল সংস্থা।
স্যামুয়েল উ বলেন, "ব্রঙ্কসে অনেকে আছে যারা প্রথম প্রজন্মের (অভিবাসী বাবা-মার সন্তান হিসেবে), এবং নিম্ন আয়ের ছাত্র। তাঁরা মনেপ্রাণে চিকিৎসক হতে চায় এবং এখানকার মানুষকে সেবা দিতে চায়, কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও তাঁদের সেই সামর্থ্য নেই। সেটা আর্থিক সমস্যার কারণেও যেমন, তেমনি সম্পদ বা সুযোগ-সুবিধার অভাবও একটা সমস্যা। আমি আশা করি, টিউশন ফি-মুক্ত পড়াশোনার এই সুবিধা এই ধরনের ছাত্রদের চাপ কিছুটা হলেও কমাবে, এবং চিকিৎসা খাতে আসতে তাঁদের উৎসাহী করবে।"
অনুদানের এই ঘোষণাকে বড় মুক্তিদাতা বলেই অভিহিত করেন জেড অ্যান্দ্রেঁদে।
এই তরুণী বলেন, "অভিবাসী পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে আমি জানি, আর্থিক সঙ্গতির কথা মাথায় রেখেই আমাদের জীবনের প্রায় সকল সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এমন কোনো বিষয় নেই, যার ক্ষেত্রে এই ভাবনা কাজ করে না। আমাদের ভাবতে হয়, কোনখানে সময় দিয়ে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যাবে। বা এই কাজটা আমি করতে চাই, কিন্তু তাঁর সামর্থ্য কী আমার আছে?" অর্থাৎ, সবসময়েই একটা শৃঙ্খল পদে পদে চলায় বাধা দেয়। কিন্তু, একবার যখন এই আর্থিক দুশ্চিন্তা আর থাকে না, তখন যে কেউই বড় স্বপ্ন দেখতে পারে।"