আমরা কেন বামে চালাই? ব্রিটিশরা শিখিয়ে গেছিল বলে?
যুক্তরাজ্যের রাস্তায় একটু খেয়াল করে হাঁটলেই আপনি দেখতে পাবেন রাস্তার বাম দিক দিয়ে গাড়ি চলছে। সেক্ষেত্রে আমেরিকার যেকোনো ব্যক্তি সেখানে গাড়ি চালাতে গেলেই পড়তে হবে বিপাকে। একসময়কার ব্রিটিশ ঔপনিবেশ থাকা এই দেশটিতে গাড়ি চালানোর নিয়ম ডান দিক দিয়ে। দেশভেদে রাস্তার দুই দিক দিয়ে গাড়ি চালানোর কারণে প্রায়শই বেশ বিপজ্জনক অবস্থায় পড়তে হয়।
তবে যুক্তরাজ্যই একমাত্র দেশ নয় যেখানে বাম দিক দিয়ে গাড়ি চলার নিয়ম রয়েছে। দেখা যায়, বিশ্বের প্রায় ৩০ শতাংশ দেশে বাম দিকে গাড়ি চালানো বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশেও রাস্তার বাম দিক থেকে গাড়ি চালানো হয়। অনেকেই বলে থাকেন, ব্রিটিশরা আমাদের তা শিখিয়ে গিয়েছে বলেই এমনটা করে থাকি। তবে তা কতটুকু সত্য?
এদিকে প্রায় ৭০ শতাংশ বা তার বেশি দেশে নিয়ম রয়েছে ডানদিকে গাড়ি চালানোর। ঠিক কীভাবে নিয়মের এমন হেরফের হলো তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না।
তবে ধারণা করা হয়, ইউরোপে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হেনরি ফোর্ডকে মূল ভূমিকায় রাখা হলেও ডানদিকে গাড়ি চালানোর গল্পটি আরো অনেক পুরোনো। এর নেপথ্যের ঘটনাটি শুধু গাড়ি চলাচলের ইতিহাসের আগেই না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠারও আগের ইতিহাস।
পেনসিলভানিয়ার কনেস্টোগায় একটি পরিত্যক্ত তামাক শুকানোর শস্যাগারে গিয়ে একটি ওয়াগনের খোঁজ করতে গিয়ে জানা যায় রাস্তায় গাড়ি চালানোর ইতিহাস। খোঁজ পাওয়া যায় জন স্টেহম্যানের, যার পরিবার ১৭৪৩ সাল থেকে এই এলাকায় জমি চাষ করছে। তিনি কনেস্টোগা এরিয়া হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির সভাপতি। তার থেকে জানা যায় 'কনস্টোগা ওয়াগন' ই ছিল এই গল্পের মূল ভূমিকায়।
ওয়াগন ট্রেন
বড় ওয়াগনগুলো লম্বা, খিলানযুক্ত কাপড়ের ছাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পাশ্চাত্যগামী হওয়ার 'আইকন' হয়ে উঠেছিল। যদিও ১৭০০ শতকের গোড়ার দিকে পশ্চিম পেনসিলভানিয়া ছিল দূরবর্তী সীমান্ত। সেসময় কনস্টোগা ওয়াগনগুলো উৎপাদন করতো স্থানীয় ছুতার ও কামাররা।
নেটিভ আমেরিকান বা আদিবাসী আমেরিকানদের কাছ থেকে কেনা জিনিসপত্রসহ কৃষি পণ্য এবং অন্যান্য আরো জিনিসপত্র বহন করে ফিলাডেলফিয়ার বাজারে নেয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল কনস্টোগা ওয়াগন।
ফিলাডেলফিয়া ছিল তৎকালীন সময়ে উপনিবেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বড় শহর। ওয়াগন চালক যে কোনো একটি ঘোড়ায় চড়তে পারতো বা ওয়াগনের পাশের বোর্ডে বসতে পারতো। কিন্তু যখন আরও বেশি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হতো তখন তিনি ঘোড়ার পাশাপাশি হাঁটতেন, লিভার ও দড়ি টানতেন।
স্টেহম্যান বলেন, "ওয়াগন চালকেরা 'জি', 'হাউল' বা এই ধরণের কোন কিছু বলে ঘোড়াগুলোকে আদেশ দিতেন এবং ঘোড়া সেই নির্দেশ মতো কাজ করতো। এছাড়াও তারা কখনো কখনো দড়ি ধরে টান দিতেন।"
মনে করুন, আপনি কোন এক দীর্ঘ ধুলোময় পথ ধরে হাঁটছেন এবং ঘোড়ার একটি দল এই নীল রঙের ওয়াগন টেনে নিয়ে চলেছে। বেশিরভাগ লোকই সেখানে ডানহাতি। ঠিক সেই কারণে কনস্টোগা ওয়াগনগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল বাম দিকে, ওয়াগন চালকের ডান হাতের কাছাকাছি। এর মানে চালক রাস্তার মাঝখানে এবং ওয়াগন ডানদিকে ছিল।
অবশেষে, ল্যাঙ্কাস্টার কাউন্টি, পেনসিলভানিয়া এবং ফিলাডেলফিয়ায় বাণিজ্য এবং যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আমেরিকায় প্রথম প্রধান কোন হাইওয়ে তৈরি করা হয়েছিল। ফিলাডেলফিয়া ও ল্যাঙ্কাস্টার টার্নপাইক রোড ১৭৯৫ সালে খুলে দেয়া হয়েছিল জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য।
এম. জি. লের 'ওয়েজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড' বই অনুসারে চার্টারে লিখিত নিয়মগুলোর মধ্যে কনস্টোগা ওয়াগনগুলো যেমন ডানদিকে চলতো সেভাবেই সমস্ত ট্র্যাফিককে ডানদিকে থাকার নিয়ম করা হয়েছিল। ১৮০৪ সালে নিউইয়র্ক প্রথম রাজ্য হিসেবে সমস্ত রাস্তা এবং মহাসড়কে গাড়িকে ডানদিকে থাকার নির্দেশ দেয়।
অনেকেই আমেরিকাতে গাড়ি ডান দিকে থাকার এই নিয়মের জন্য হেনরি ফোর্ডকে কৃতিত্ব দেয়। এর কারণ হিসেবে ১৯০৮ সালে ফোর্ড মোটর কোং তাদের অত্যন্ত জনপ্রিয় মডেল টি-এর স্টিয়ারিং হুইলটি বাম দিকে রেখেছিল। তবে ফোর্ড কেবলই গাড়ি চালানোর বহু পুরোনো এবং প্রতিষ্ঠিত অভ্যাসের বিষয়গুলোতেই সাড়া দিয়েছিল। মজার ব্যাপার হল, ব্রিটেন ছাড়া ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেই আমেরিকানদের মতো ডানদিকে গাড়ি চালানোর নিয়ম রয়েছে।
ইউরোপে নেপোলিয়নের পদযাত্রা
ব্রিটিশরা কেন তাদের নিজের মহাদেশেও বহিরাগত? এর জন্য দায়ী কিংবা কৃতিত্ব দেয়া যায় ফরাসিদের। ১৮ শতকের শেষের দিকে ম্যাক্সিমিলিয়েন রবেসপিয়েরের অধীনে ফরাসি বিপ্লবী সরকার নির্দেশ দিয়েছিল যে, প্রত্যেকের ডানদিকে গাড়ি চালাতে হবে।
এতে করে দীর্ঘ সময় ধরে রাস্তার বাম দিক দিয়ে গাড়ি চালানোর সংস্কৃতি তৈরি হয়। বামদিকটা ছিল ঘোড়ার গাড়ির বা ঘোড়ার পিঠে চড়ে যাতায়াতের জন্য সংরক্ষিত। মূলত, বামদিকটা ছিল ধনী শ্রেণীর জন্য।
পথচারী বা দরিদ্র লোকেদের জন্য রাখা হয়েছিল ডানদিকের রাস্তা৷ পরবর্তীতে রাস্তার একইপাশে সবাইকে চলাচলে বাধ্য করায় যানবাহন চলাচলে সুবিধা হওয়ার পাশাপাশি রাস্তায় চলাচলের সময় শ্রেণি বিভেদের বিষয়টি অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হয়েছিল।
উচ্চ শ্রেণীগুলি সম্ভবত সবার পাশাপাশি চলাফেরা করতো। কারণ তৎকালীন সময়ে অভিজাত হিসাবে নিজেকে জাহির করা কেবল বেমানানই ছিল না বরং বিপজ্জনকও ছিল। নানা ফরাসি নীতি নেপোলিয়নের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ইউরোপে। ১৮১২ সালের নেপোলিয়ন সাম্রাজ্যের মানচিত্রের দিকে তাকালেই পাওয়া যাবে এর প্রমাণ।
শুধু একটি জাতিই ছিল যারা নেপোলিয়নের প্রজা বা মিত্র ছিল না। দেশটি হলো সুইডেন। বাম দিকে গাড়ি চালানোর নিয়ম ছিল সুইডেনে। তবে হুট করেই ১৯৬৭ সালের একদিন আশ্চর্যজনকভাবে সেদেশের ড্রাইভাররা ডানদিকে গাড়ি চালানো শুরু করলো।
ব্রিটেন আক্ষরিক অর্থেই ফ্রান্সের উল্টো পথে হেঁটেছে। ইতিহাসবিদ লে-এর ধারণা মতে নিয়মের এই হেরফেরের কারণ হিসেবে ছিল বিভিন্ন ধরনের পরিবহণ। ব্রিটেনে বাণিজ্যিক-আকারের ওয়াগনের সংখ্যা ছিল কম এবং বেশিরভাগই ছিল ছোট গাড়ি ও ঘোড়ার গাড়ি। অশ্বারোহীরা রাস্তার বামদিকে থেকে শুভেচ্ছা জানাতে বা কখনো কখনো প্রয়োজনে মারামারির জন্যও গাড়িগুলোর দিকে তাদের ডান হাত রাখতে পছন্দ করতেন।
ঝুঁকিপূর্ণ ড্রাইভিং
কারণ যাই হোক না কেন গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে ভিন্ন পাশ হওয়ার বেশ কিছু প্রভাব পড়েছে। এ কারণের নানা সময়ে সম্মুখীন হতে হয়েছে গুরুতর কিছু দুর্ঘটনার।
এএএ-এর চালক প্রশিক্ষণের প্রধান উইলিয়াম ভ্যান ট্যাসেল ভিন্ন পাশ দিয়ে গাড়ি চালানোর সময় অতিরিক্ত মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এর মধ্যে একটি হলো রেডিও বন্ধ রাখা।
ট্যাসেল বলেন, "আমি মনে করি আপনি যখন গাড়ি চালাচ্ছেন, আপনার নিজের সাথে কথা বলা ভালো। বিষয়টি আপনাকে ড্রাইভিংয়ে মনোনিবেশ করতে এক প্রকার বাধ্য করে।"
অ্যাভিস বাজেট গ্রুপ যুক্তরাজ্যে গাড়ি চালানোর জন্য আমেরিকানদের প্রচুর গাড়ি ভাড়া দিয়ে থাকে। ভাড়া দেয়ার এজেন্টরা অন্যান্য পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি তারা গ্রাহকদের বাম দিকে গাড়ি চালানোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
আভিস বাজেট এক বিবৃতিতে বলেন, "যুক্তরাজ্যজুড়ে আমাদের সমস্ত যানবাহনে 'বাম দিকে গাড়ি চালান' স্টিকার রয়েছে এবং প্রধান প্রধান স্থানগুলোতে আমরা 'বাম দিকে গাড়ি চালান' রিস্টব্যান্ড চালকদের দিয়ে থাকি যাতে করে তাদের মনে রাখতে সুবিধা হয়।"
এএএ-এর ভ্যান ট্যাসেল একজন যাত্রী সাথে রাখার পরামর্শ দেন। যাতে করে আরেক জোড়া চোখ চালকের পাশে থাকে। মাঝে মাঝে ভয় পেলেও যুক্তরাজ্যে গাড়ি চালানোর সময় এই বিষয়টি তাকে সাহায্য করেছিল।
অনুবাদ: জেনিফার এহসান