পতঞ্জলির মতো বিলিয়ন ডলারের আয়ুর্বেদিক প্রতিষ্ঠান মানুষকে ‘প্রতারিত’ করছে: ভারতীয় বিচারক
ধরুন কোভিড-১৯ থেকে বাঁচার কোনো জাদুকরী বড়ি রয়েছে, কিংবা ইনসুলিনের পরিবর্তে আপনি সবজির জুস ও ভেষজ কোনো বড়ি দিয়েই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন। আবার এমন যদি হয় যোগব্যায়াম ও শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামগুলো নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমেই আপনি হাঁপানি থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
এমন সব দাবি করেই মানুষের কাছে নিজের পণ্য মেলে ধরছে ভারতের অন্যতম বৃহৎ আয়ুর্বেদিক পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান 'পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ। তাদের এসব দাবি হিন্দু নিরাময় অনুশীলনের তিন হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের বিশ্বাসেরই এক প্রতিফলন।
'আয়ুর্বেদা' শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ 'আয়ুর' (জীবন) ও 'বেদা' (বিজ্ঞান বা জ্ঞান) থেকে। এর অনুশীলনকারীরা আয়ুর্বেদিক পণ্য তৈরির জন্য শতাব্দী প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করে নানা ধরনের ভেষজ, প্রাণির নির্যাস ও খনিজ ব্যবহার করে থাকে।
অবশ্য অনেক বিজ্ঞানীই এসব পণ্যের সুরক্ষা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে গবেষণার অভাব নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র এসব আয়ুর্বেদিক পণ্য অন্যান্য খাবারের পরিপূরক হিসেবে চিহ্নিত করলেও এগুলো রোগ সারাতে পারে এমনটা মনে করে না।
ভারতীয়দের মাঝে আয়ুর্বেদের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসা ভারতের হিন্দু-জাতীয়তাবাদী সরকারের অধীনে আয়ুর্বেদসহ ও অন্যান্য বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিতে সরকারের পক্ষ থেকে নজিরবিহীন সহায়তা দেওয়া হয়। সরকার থেকে ভারতের বিকল্প চিকিৎসা মন্ত্রণালয় বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার পায়। সরকার তার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কূটনৈতিক চ্যানেলগুলো মাধ্যমেও আয়ুর্বেদের প্রচার করে থাকে। আর এর ফলে পতঞ্জলির ভাগ্যও উপর দিকে উঠতে শুরু করে।
সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পতঞ্জলিকে কিছু পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করার ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যদিও এটি একটি অন্তর্বর্তী আদেশ এবং পতঞ্জলি চাইলে এ আদেশের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। কিন্তু এখনও প্রতিষ্ঠানটিকে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
পতঞ্জলি বা সরকারও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
এ বিষয়ে ভারতের আদালতভিত্তিক ওয়েবসাইট লাইভল.কমের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, আদালতের শুনানি পরিচালনাকারী দুই বিচারকের একজন আহসানউদ্দিন আমানউল্লাহ সরকারপক্ষের আইনজীবীকে বলেন, 'পুরো দেশকে প্রতারিত করা হয়েছে। আপনি চোখ বন্ধ রেখেছেন।'
২০২২ সালের আগস্টে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন আদালতে করা এক মামলায় দাবি করেছিল, পতঞ্জলি এবং এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বাবা রামদেব প্রমাণ-সমর্থিত আধুনিক ওষুধের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক মিথ্যাচার করেছেন এবং কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়েছেন।
মামলায় এও বলা হয়, বাবা রামদেব আধুনিক চিকিৎসাকে 'মূর্খ ও দেউলিয়া বিজ্ঞান' বলেও কটাক্ষ করেছেন।
ওই বছরেরই জুলাইয়ে ভারতীয় সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত একাধিক বিজ্ঞাপনে পতঞ্জলি দাবি করেছিল যে তাদের আয়ুর্বেদিক পণ্যগুলো ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও অটোইমিউনের মতো দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক জটিলতা সারাতে পারে।
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের পিটিশনে এ ধরনের দাবি ভারতের ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রিমেডিজ (আপত্তিকর বিজ্ঞাপন) আইনের লঙ্ঘন বলে অভিযোগ আনা হয়।
চিকিৎসার রাজনীতি
এ ঘটনার একটি রাজনৈতিক দিকও রয়েছে। পতঞ্জলির সর্বজনীন মুখ যোগগুরু বাবা রামদেব ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সোচ্চার সমর্থক। ২০১৭ সালে পতঞ্জলির আয়ুর্বেদিক গবেষণা সুবিধার উদ্বোধনও করেন মোদি।
সুপ্রিম কোর্টের ওই আদেশ প্রধানমন্ত্রী মোদি ও তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলসহ আয়ুর্বেদিক ওষুধ ব্যবহারকারীদের জন্য একটি আঘাতই বলা যায়।
কয়েকজন বিজ্ঞানীর অভিযোগ- ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার অংশ হিসেবে সরকার আধুনিক ওষুধের জন্য বরাদ্দ থেকে এসব বিকল্প ওষুধের প্রচারে খরচ করছে।
ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির সভাপতি ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায় বলেন, 'এই সরকারের অন্যতম রাজনৈতিক ভাবনা হলো হিন্দু ঐতিহ্যকে মহিমান্বিত করা। কিন্তু আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের নামে সরকার অস্পষ্ট ও অবৈজ্ঞানিক ধারণা প্রচার করছে।'
যেমন, পতঞ্জলির সঙ্গে মোদি সরকারের সম্পর্কের কথাই ধরা যাক।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ২০১৭ সালের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিজেপি নিয়ন্ত্রিত রাজ্যগুলোতে জমি অধিগ্রহণের জন্য পতঞ্জলি আনুমানিক ৪৬ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি ছাড় পেয়েছে।
মিলিয়ন বিক্রয়ে বিলিয়ন আয়
২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর কয়েক মাস পর ভারতের তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন পতঞ্জলির একটি বড়ি উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে যোগগুরু রামদেব দাবি করেছিলেন যে রোগীদের ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে বড়িগুলোর 'শতভাগ কার্যকরী ফলাফল' পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ না থাকার কথা জানানোর পরও প্রতিষ্ঠানটি ছয় মাসে আড়াই মিলিয়ন কিট বিক্রি করে, যার মধ্যে ছিল কোভিড-১৯ থেকে বাঁচার বড়ি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর বোতলজাত তেল।
এর মধ্য দিয়ে প্রচুর অর্থ আয় করে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির আয় ছিল ১.৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি এবং ট্যাক্স বাদ দিয়েই এর মুনাফা ছিল ৭৪ মিলিয়ন ডলার।
এর আগে ২০২৩ সালের নভেম্বরে আদালতের এক আদেশে প্রতিষ্ঠানটিকে বিভ্রান্তিকর দাবি সম্বলিত বিজ্ঞাপন প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবী জানান, বিজ্ঞাপন প্রচারে নিষেধাজ্ঞার পরদিনই রামদেব এক সংবাদ সম্মেলনে উচ্চ রক্তচাপের প্রতিকার ও 'অ্যালোপ্যাথি দ্বারা ছড়ানো মিথ্যা'র প্রসঙ্গ তুলে ধরেন।
সমালোচকরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন যে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণেই কোম্পানিটি আদালতের আদেশ অমান্য করেছে।
এ বিষয়ে পতঞ্জলির মুখপাত্রের সঙ্গে মার্কিন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এনপিআর যোগাযোগ করলেও তিনি সাড়া দেননি।
আয়ুর্বেদিক চিকিত্সা সম্পর্কে ভুল তথ্যের সামগ্রিক প্রভাবের বিষয়টি তুলে ধরে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডা. জয়েশ লেলে বলেছেন, 'আমাদের উদ্বেগ হলো মানুষকে ভুল বোঝানো হচ্ছে। আমরা এমন রোগীও পেয়েছি, যারা আমাদের চিকিৎসা ছেড়ে দিয়ে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার শরণাপন্ন হয়েছেন এবং বলেছেন এই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা তাদের কিডনির অসুখ সারিয়ে তুলবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কিডনি বিকল হয়ে গেছে। হেপাটাইটিস রোগে আক্রান্ত এমন রোগী যারা ভুল চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের বেলায়ও এমনটা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে আরও অনেক শারীরিক জটিলতাও তৈরি হয়েছে তাদের।'
তিনি বলেন, 'আপনি যদি প্রতিদিনই বলেন যে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো নয়, তবে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়।'
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক