যুক্তরাষ্ট্র কেন টিকটক নিষিদ্ধ করতে চায়?
ভিডিও শেয়ারিং প্লাটফর্ম টিকটক নিষিদ্ধ করতে মার্কিন কংগ্রেসে একটি বিল পাশ হয়েছে। বিলটি আইনে পরিণত হলে টিকটকের চীনা মালিক বাইটড্যান্সকে ছয় মাসের মধ্যে তাদের সকল মার্কিন সম্পদ বিক্রি করতে হবে। অন্যথায় নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হবে। টিকটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মার্কিন রাজনীতিবিদদের মধ্যে তাই এখন বইছে আলোচনার ঝড়।
যুক্তরাষ্ট্রে কারা টিকটক নিষিদ্ধ করতে চায় এবং কেন?
যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হলে টিকটককে অবশ্যই এর চীনা প্যারেন্ট কোম্পানি বাইটড্যান্স থেকে আলাদা হতে হবে। অন্যথায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। এমন দাবি থেকেই কংগ্রেসে উভয় দলের রাজনীতিবিদরা একটি বিল উত্থাপন করেন।
বিলটি গত বুধবার (১৩ মার্চ) মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসে ৩৫২-৬৫ ভোটে পাশ হয়।
বিলটির এখনও সিনেটের অনুমোদন পাওয়া বাকি। তারপরে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্বাক্ষর করলেই এটি আইনে পরিণত হবে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনেটর বিলটি অনুমোদন করবেন কি-না তা এখনও স্পষ্ট নয়।
বাইটড্যান্স চীন সরকারের হয়ে টিকটক দিয়ে ১৭০ মিলিয়ন আমেরিকান ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে, মূলত এমন উদ্বেগ থেকেই টিকটক নিষিদ্ধের আইন পাশ করার উদ্যোগ নিচ্ছে বাইডেন সরকার।
এর আগে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২০ সালে হোয়াইট হাউসে থাকাকালীন অ্যাপটি নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন।
তবে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে নিশ্চিত হওয়া ট্রাম্প নতুন আইনের সমালোচনা করে যুক্তি দিয়েছেন, টিকটক সীমিত করলে ফেসবুক অন্যায়ভাবে লাভবান হবে।
বিলটি আইনে পরিণত হলে টিকটক নিষিদ্ধ হবে কবে?
বিলটি এখনো আইনে পরিণত হয়নি। তবে সিনেটে পাস হলে এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেন এতে স্বাক্ষর করলে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার আগে টিকটক বিক্রির জন্য বাইটড্যান্স ছয় মাস সময় পাবে।
টিকটকের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা কীভাবে কাজ করবে?
বেশিরভাগ লোক তাদের স্মার্টফোন ও ট্যাবগুলোতে অ্যাপলের অ্যাপস্টোর ও গুগলের প্লেস্টোরের মাধ্যমে সকল অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোড করেন। তাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য টিকটক নিষিদ্ধ করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো অ্যাপল ও গুগলের অ্যাপ স্টোর থেকে টিকটক অ্যাপটি সরিয়ে ফেলা। তাই নতুন করে কেউ আর ডাউনলোড করতে পারবেন না।
এছাড়া নতুন আইনের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত বিদেশি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত অ্যাপ্লিকেশনগুলোর আপডেট এবং রক্ষণাবেক্ষণ করাও নিষিদ্ধ হবে। এর ফলে অ্যাপটি কারও ডিভাইসে থাকলেও কোনো সিকিউরিটি ও মেইন্টেন্যান্স আপডেট পাবেন না আর কেউ।
নিষেধাজ্ঞার জবাবে টিকটক কী বলছে?
টিকটক এই আইনের কড়া সমালোচনা করেছে। প্রধান নির্বাহী শো জি চিউ সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এই বিলের ফলে মুষ্টিমেয় কিছু সামাজিক মাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে আরও ক্ষমতা দেওয়া হবে এবং হাজার হাজার মার্কিন নাগরিক চাকরি হারাবে।
টিকটক বিক্রির জন্য বাইটড্যান্সকে চীনা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে, তবে বেইজিং এ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করবে বলে জানিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক ব্যবহারকারীরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন?
কিছু মার্কিন কন্টেট ক্রিয়েটর এবং ব্যবহারকারীরা প্রস্তাবিত এ নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করেছেন।
লস অ্যাঞ্জেলেসের তরুণ প্রতিবন্ধী অ্যাডভোকেট টিফানি ইউ হোয়াইট হাউসের বাইরে এক বিক্ষোভে বিবিসিকে বলেন, প্ল্যাটফর্মটি তার কাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
টিকটক তাদের ১৭ কোটি মার্কিন ব্যবহারকারীকে তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছে এবং বিলটি সমর্থন না করতে বলেছে।
টিকটক ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে রাজনীতিবিদদের কাছে প্রচুর পরিমাণে কল আসছে, যা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদদের প্রভাবিত করার পরিবর্তে, এটি তাদের টিকটকের প্রভাব সম্পর্কে আরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে এবং অ্যাপটি নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করার আইনটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হচ্ছে।
অন্যান্য দেশে কি টিকটক নিষিদ্ধ?
বিলটি যদি যুক্তরাষ্ট্রের আইনে পরিণত হয়, তাহলে অন্যান্য দেশেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।
টিকটক ইতোমধ্যে ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২০২০ সালের জুনে নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত অ্যাপটির অন্যতম বড় বাজার ছিল ভারত।
এছাড়া ইরান, নেপাল, আফগানিস্তান এবং সোমালিয়ায়ও ব্লক করে রাখা হয়েছে।
ইউরোপীয় কমিশনের মতো যুক্তরাজ্য সরকার ও পার্লামেন্ট ২০২৩ সালে কর্মীদের কাজের ডিভাইস থেকে টিকটক নিষিদ্ধ করেছে।
বিবিসি নিরাপত্তার কারণে তাদের কর্মীদের কর্পোরেট ফোন থেকে টিকটক মুছে ফেলার পরামর্শ দিয়েছে।
টিকটক কীভাবে কাজ করে এবং ব্যবহারকারীর কী ধরনের ডেটা সংগ্রহ করে?
টিকটকের মূলে রয়েছে এর অ্যালগরিদম। অর্থাৎ ব্যবহারকারীর কী ধরনের কন্টেন্ট বা ভিডিও দেখবেন তা তাদের রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী ঠিক করে দেয়। কোনো কন্টেন্টের স্ক্রিন টাইমের ওপর ভিত্তি করে টিকটক আপনার সামনে পরবর্তী কন্টেন্টগুলো হাজির করে।
অ্যাপটিতে ব্যবহারকারীদের জন্য তিনটি প্রধান ফিড রয়েছে: ফলোয়িং (অনুসরণ), ফ্রেন্ডস (বন্ধু) এবং ফর ইউ (আপনার জন্য)।
ফলোয়িং এবং ফ্রেন্ডস ফিডে মূলত টিকটকের যারা আপনার বন্ধুতালিকায় আছেন এবং যাদেরকে আপনি ফলো বা অনুসরণ করেন তাদের কন্টেন্ট দেখবেন।
আর 'ফর ইউ' ফিডে আপনি যে ধরনের কন্টেন্ট বেশি দেখেন বা আপনার রুচি ও পছন্দের সাথে মিলে এমন কন্টেন্ট টিকটক আপনাকে দেখাবে। পছন্দানুযায়ী নতুন কন্টেন্ট খুঁজতে হলে বেশিরভাগ এই ফিডেই এসে সার্চ দেন। তাছাড়া কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্যও ফর ইউ ফিড অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এইখানে কোনো ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেলে মিলিয়ন ভিউ অর্জন করা সম্ভব।
সমালোচকরা বলছেন যে, অ্যাপটি তার অত্যন্ত ব্যক্তিগতকৃত সিস্টেমকে শক্তিশালী করার জন্য অন্যান্য সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের চেয়ে বেশি ডেটা সংগ্রহ করে।
এর মধ্যে ব্যবহারকারীদের অবস্থান, ডিভাইস, তারা যে সব কন্টেন্ট দেখেন এবং ব্যবহারকারীদের কিবোর্ডে টাইপ করার ধরণ সম্পর্কিত তথ্যও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
তবে একই ধরনের তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও ব্যবহার করে থাকে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন