কেন আরো বেশি অমুসলিমরা রমজানের অংশ হচ্ছেন?
ইরাকে বসবাসকারী ৫৩ বছর বয়সী খুলাউদ খারদৌম বলেন, রমজান শুধু ধর্মের বিষয় নয়। এটি মানুষকে একত্রিত করারও বিষয়। মুসলিম অধ্যুষিত ইরাকের যেসব অঞ্চলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বসবাস, বিশেষ করে খ্রিস্টানদের, তাদেরকে মুসলিমদের সাথে ইফতারি করতে দেখা যায়। তারা মুসলিমদের সাথে খাবার এবং ঐতিহ্য ভাগ করে নিয়ে ঐক্য এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা তৈরি করেন।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্য অঞ্চলেও একই ধরনের ঘটনা দেখা যায়। কায়রোর দক্ষিণে বসবাসকারী ৫০ বছর বয়সী খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী উম আমির বলেন, "আমার সবচেয়ে পুরানো এবং সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের মধ্যে একজন একজন মুসলিম। তাই আমরা কিছু রীতিনীতি ভাগাভাগি করে নেই। উদাহরণস্বরূপ, আমি রমজানে দিনের বেলা রোজা রেখে তার পরিবারের সাথে ইফতার করি।"
পশ্চিমের অমুসলিমরা আরো বেশি রমজান পালন করছেন
খ্রিষ্টান অধ্যুষিত দেশগুলোতে রমজান ধীরে ধীরে একটি বড় ছুটিতে পরিণত হচ্ছে৷
গত বছর লন্ডন প্রথম বড় ইউরোপীয় শহর হিসেবে রমজান মাসে আলো দিয়ে শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা সাজিয়েছিল। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট অ্যাম মেইন শহর এ বছর লন্ডনের উদাহরণ অনুসরণ করে রমজান মাসে আলো দিয়ে সড়ক সাজানো প্রথম বড় জার্মান শহর হয়ে উঠেছে।
অস্ট্রিয়ার ক্যারিন্থিয়া রাজ্যে এ সপ্তাহে ১ হাজারের বেশি মানুষ একটি 'উন্মুক্ত ইফতার' এর জন্য একত্রিত হয়েছিল। সেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সকল সদস্যকে (তারা মুসলিম না হলেও এবং রোজা না রাখলেও) রমজানের রোজা ভাঙতে এবং একসাথে খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। আয়োজকরা জানিয়েছেন, এ অনুষ্ঠান প্রতি বছর আরো বেশি মানুষকে আকৃষ্ট করছে। এ আয়োজনে অংশগ্রহণকারী একজন আঞ্চলিক সংবাদপত্র ক্লাইন জেইতুংকে বলেছেন, "আমি এতজন অমুসলিম এখানে দেখতে পাব বলে আশা করিনি।"
ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে অধ্যাপনা করা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উলফ ইনস্টিটিউটের পরিচালক এসথার-মিরিয়াম ওয়াগনার নিশ্চিত করে বলেছেন, "বৈচিত্র্য উদযাপন করতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, দাতব্য সংস্থা এবং গির্জা থেকে আয়োজিত ইফতারের পরিমাণ অবশ্যই বৃদ্ধি পেয়েছে।"
ওয়াশিংটনের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক 'ইসলামোফোবিয়া' তদন্তকারী প্রকল্প ব্রিজ ইনিশিয়েটিভ-এর সিনিয়র গবেষক ফরিদ হাফেজ যুক্তি দিয়েছেন, রমজানের তাৎপর্য "জনগণের মধ্যে মুসলমানদের জন্য রাজনৈতিক স্বীকৃতি এবং সমতা বৃদ্ধির" জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
উদাহরণস্বরূপ হাফেজ বর্ণনা করেন, ১৯৯০ এর দশকে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডেলিন অলব্রাইট তার কূটনৈতিক বিভাগে 'ইফতার' করা শুরু করেছিলেন।
তিনি বলেন, "মার্কিন দূতাবাসগুলো মূলত মুসলিমদেরকে (রমজান চলাকালীন) এক ধরনের কাঠামোগত সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল। তারপর মার্কিন দূতাবাসগুলো এটিকে ইউরোপের দেশগুলোতে নিয়ে আসে। তারপরে ইউরোপের দেশগুলোতে এ ধরনের আয়োজন শুরু হয়। তাই চ্যান্সেলর ও প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীরা এর সাথে জড়িত ছিল।"
রমজানের বাণিজ্যিক প্রভাবেও রমজান মাসের গুরুত্ব বেড়েছে। মুসলমানরা রমজান মাসে উপহার এবং পোশাক থেকে শুরু করে খাবার ও গাড়ি পর্যন্ত সবকিছুতে বেশি অর্থ ব্যয় করেন। শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই ২০২৩ সালে রমজান মাসে খরচ হয়েছিল প্রায় ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রমজানে বিজ্ঞাপনের পরিবর্তন ঘটেছে এবং সংখ্যায় বেড়েছে। পাশাপাশি এটি সম্ভাব্য সম্প্রদায়ের বাইরেও বার্তা পাঠাচ্ছে।
সাংস্কৃতিক অপব্যবহারের দায়ে অভিযুক্ত
রমজানের ব্যবপারে উলফ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ওয়াগনারের আরেকটি তত্ত্ব ভাষা এবং প্রজন্মের পরিবর্তনকে ঘিরে আবর্তিত হয়। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, কোনো দেশে নবাগত বা অভিবাসীরা ওই দেশের ভাষায় সঠিক উচ্চারণ ছাড়াও যদি কথা বলে- তাহলেও তাঁদের মূল জনগোষ্ঠীর সাথে অন্তর্ভুক্তির একটি জায়গা তৈরি হয়।
ফ্রান্সেও এমনটি ঘটছে। সেখানের গবেষকরা উল্লেখ করেছেন, পরবর্তী প্রজন্মের ফরাসি মুসলমানরা মনে করেন (যারা ফরাসিত ভাষায় আরো সাবলীল) যে তারা আরো খোলামেলাভাবে ধর্ম পালন করতে পারে। আরও দৃশ্যমান ধর্মীয় অনুশীলনের মাধ্যমে এই তরুণ নাগরিকরা ফরাসি সমাজের পূর্ণ সদস্য হিসেবে তাদের মর্যাদা দাবি করে।
ফ্রান্সের ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড স্টাডি অন আরব অ্যান্ড ইসলামিক ওয়ার্ল্ডস-এর গবেষক জামেল এল হামরি গত সপ্তাহে সংবাদ মাধ্যম লা মন্ডেকে বলেছিলেন, "তারা নিজেদেরকে ফরাসি এবং মুসলিম উভয়ই মনে করেন।"
কিছু মুসলমান রমজানের বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে অখুশি। রক্ষণশীল ধর্মগুরুরা যুক্তি দিয়েছেন, অমুসলিমদের মোটেও রমজানে অংশ নেওয়া। ডানপন্থি ইউরোপীয়রা বিশ্বাস করেন, এ ধরনের অনুশীলন সভ্যতার সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কয়েকজন পরিচিত ব্যক্তি (যারা রমজানে রোজা রেখেছিলেন) এটিকে এক ধরনের অনলাইন স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করেন। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক অপব্যবহারের দায় দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু হাফেজ বা ওয়াগনার কেউই বিশ্বাস করেন না, এ ধরনের মতামত অন্যদের ভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে বাঁধা প্রদান করে।
খ্রিস্টান-সংখ্যাগরিষ্ঠ সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা মুসলমানদের জন্য এর সাথে অন্তর্ভুক্তির সম্পর্ক থাকতে পারে। হাফেজ যুক্তি দিয়েছেন, "রমজানকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে এটিকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।"
ওয়াগনার যোগ করেন, অমুসলিমদের জন্য এটি বৈচিত্র্য উদযাপন এবং পরিচালনার বিষয়ে হতে পারে।
তিনি উপসংহারে বলেন, "যখন আমাদের সমাজে বৈচিত্র্য থাকে তখন আমরা দেখতে পাই এটি একটি প্রাণবন্ত এবং আরো ন্যায়সংগত সমাজকে সমর্থন করে।"
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়