জাতিসংঘে গাজা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে বাধা দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র, যুদ্ধের ওপর এর কী প্রভাব পড়বে?
গাজায় ইসরায়েলের চালানো ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের পাঁচ মাসেরও বেশি সময়ের পর সোমবার (২৫ মার্চ) জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অবিলম্বে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্বে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আসলেও অবশেষে এটি পাস করার সময় কোন ভেটো দেয়নি।
এদিকে যুদ্ধবিরতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনি ইসরায়েল। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এই প্রস্তাবের প্রতি নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, তাদের হামলা বন্ধ করার কোনো ইচ্ছা নেই।
গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর থেকেই দেশটি গাজায় অভিযান ও হামলা চালাচ্ছে। এতে এখন পর্যন্ত ৩২ হাজারের বেশী মানুষ নিহত হয়েছে যার অধিকাংশই নারী ও শিশু।
প্রস্তাবের ভাষার সমালোচনা করে ইসরায়েল বলেছে, এটি গাজায় বন্দী জিম্মিদের মুক্তির সাথে যুদ্ধবিরতিকে দৃঢ়ভাবে যুক্ত করে না। প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানোর পাশাপাশি সমস্ত জিম্মিদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে। পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জিম্মিদের মুক্তির সাথে সরাসরি যুদ্ধবিরতিকে যুক্ত করার একটি প্রস্তাবনা দেয় যা ব্যর্থ হয়েছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, সর্বশেষ প্রস্তাবনাটি বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এই ব্যাখ্যার সাথে একমত নন। তারা বলেন, নথিতে ব্যবহৃত ভাষার মধ্যেই প্রস্তাবটির মূল বিষয়বস্তু নিহিত রয়েছে।
গাজায় যুধবিরতির প্রস্তাবের প্রভাব কতটুকু হবে?
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখান করে মঙ্গলবার (২৬ মার্চ) গাজায় হামলা চলমান রেখেছে ইসরায়েল।
জাতিসংঘে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান নিরাপত্তা পরিষদের সমালোচনা করে বলেছেন, 'জিম্মিদের মুক্তির শর্ত ছাড়াই' যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস করেছে জাতিসংঘ।
তিনি জাতিসংঘে বলেছেন, "এটি তাদের মুক্তি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে দেয়।"
এদিকে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ বলেছেন, তার দেশ এ প্রস্তাবনা মেনে চলবে না।
তিনি বলেন, "ইসরায়েল যুদ্ধ বিরতিতে যাবে না। আমরা হামাসকে ধ্বংস করব এবং শেষ জিম্মি দেশে ফিরে না আসা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাব।"
এ সপ্তাহে গাজার সর্বদক্ষিণের শহর রাফায় আসন্ন অভিযান নিয়ে আলোচনা করতে একটি উচ্চপদস্থ ইসরায়েলি প্রতিনিধিদলের যুক্তরাষ্ট্র সফরের কথা থাকলেও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাসের পর সেই সফর বাতিল করে দিয়েছে ইসরায়েল।
ইসরায়েল কী প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য?
প্রস্তাবটি পাস হওয়ার পরে, মার্কিন কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন, এটি বাধ্যতামূলক নয়। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার একটি সংবাদ সম্মেলনের সময় বারবার বলেছেন, প্রস্তাবটি বাধ্যতামূলক নয়। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, প্রস্তাবটির আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলের আইনজীবীরা নিশ্চিত করতে পারবেন।
একইভাবে হোয়াইট হাউজের জাতীয় পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি এবং জাতিসংঘে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রীনফিল্ড পৃথকভাবে বলেছেন, প্রস্তাবটি বাধ্যতামূলক নয়।
প্রস্তাবটি পাস হওয়ার পরে জাতিসংঘে নিয়োজিত চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুন বলেছেন, এ জাতীয় প্রস্তাবগুলো সত্যি বাধ্যতামূলক। জাতিসংঘের ডেপুটি মুখপাত্র ফারহান হক বলেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলো আন্তর্জাতিক আইনের মতোই বাধ্যতামূলক।
বিশেষজ্ঞরা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, একটি প্রস্তাব বাধ্যতামূলক কিনা তা নির্ভর করে সেটিতে ব্যবহৃত ভাষার উপর। কারণ ভাষার অস্পষ্টতা থাকলে তার ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড়াতে পারে। বর্তমানে পাস হওয়া প্রস্তাবটির ক্ষেত্রে সেটি জাতিসংঘের সনদের অধ্যায় ৬ (অ-বাধ্যতামূলক) বা অধ্যায় ৭ (বাধ্যতামূলক) এর অধীনে পড়ে কিনা তা নিয়ে ভিন্ন মতামত রয়েছে। সোমবারে পাস হওয়া প্রস্তাবটি 'যুদ্ধবিরতি' দাবি করে।
ব্রাসেলস-ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) একজন বিশ্লেষক মায়া উঙ্গার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি সংকীর্ণ আইনি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যুক্তি দিয়েছে, প্রস্তাবটিতে 'সিদ্ধান্ত নিয়েছে' লেখা না থাকায় অথবা অধ্যায় ৭-এর উল্লেখ না থাকায় এটি বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু অন্যান্য দেশ এবং আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দিয়েছেন, পূর্বের আইনি অভিজ্ঞতা অনুযায়ী পরিষদ যখন একটি দাবি করে তখন এটি মূলত সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।
তিনি আরো বলেন, প্রস্তাবনা নিয়ে বিভিন্ন ধারণার প্রধান কারণ সদস্য রাষ্ট্রগুলো কীভাবে প্রস্তাবের ভাষা এবং জাতিসংঘের সনদকে ব্যাখ্যা করছে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সমালোচনা ও সমর্থনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ত ধারণা করেছে, প্রস্তাবটি বাধ্যতামূলক নয় দাবি করার ফলে দেশটি ভেটো না দেওয়ার জন্য ইসরায়েলের তোপের মুখে কম পড়বে।
লন্ডনের চ্যাথাম হাউস থিংক ট্যাংকের মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা প্রোগ্রামের সহযোগী ফেলো ইয়োসি মেকেলবার্গ বলেছেন, যদি আইনি বিশেষজ্ঞরা সিদ্ধান্ত নিয়েও থাকেন যে প্রস্তাবটি বাধ্যতামূলক, তাহলে কীভাবে এবং কে এটি প্রয়োগ করতে পারে তা নিয়ে একটি প্রশ্ন থেকে যায়।
সিএনএনকে মেকেলবার্গ বলেছেন, 'এটা কেউই পারবে না। একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এটি সম্ভব থাকলেও প্রস্তাব পাস করার পরেই তারা জানিয়ে দিয়েছে যে এটি বাধ্যতামূলক নয়।'
প্রস্তাবের জন্য কী ইসরায়েল একঘরে হয়ে যাবে?
এর আগে গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধের সময় ওয়াশিংটন বেশিরভাগ সময় 'যুদ্ধবিরতি' শব্দটি এড়িয়ে গিয়েছিল এবং হামাসের বিরুদ্ধে চালানো হামলায় ইসরায়েলকে রক্ষা করার জন্য জাতিসংঘে ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করেছিল। সোমবার (২৫ মার্চ) জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকলেও কোন ভেটো দেয়নি। পরবর্তীতে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি পাস হয়েছে।
নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, ভেটো না দেওয়ার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে সরে এসেছে এবং এর ফলে চলমান যুদ্ধে ইসরায়েল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এদিকে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইসরায়েলের এমন সিদ্ধান্তে হতবাক হয়েছে বাইডেন প্রশাসন। তারা জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে ইসরায়েল অহেতুক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। মার্কিন প্রশাসন দাবি করেছে, তারা নীতিতে কোন পরিবর্তন আনেনি।
ইসরায়েল আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। গাজায় অসংখ্য বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর মুখে মার্কিন রাজনীতিবিদ এবং ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয়ের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানানো হয়েছে ইসরায়েলকে।
কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। যার ফলে নেতানিয়াহু বাইডেনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলে দেশটিতে মার্কিন সামরিক সহায়তার উপর সম্ভাব্য বিধিনিষেধ নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে।
রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেটিক প্রশাসনের হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সাবেক মধ্যস্থতাকারী অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, "এ থেকে দেখা যাচ্ছে, বাইডেন প্রশাসন এবং নেতানিয়াহুর মধ্যে বিশ্বাস কমে আসছে। যদি সংকটটি যত্ন সহকারে সমাধান না করা হয় তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।"
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিক বৈঠক বাতিল করার ইসরায়েলি সিদ্ধান্ত আমেরিকান কর্মকর্তাদের বিভ্রান্ত করেছে। হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কৌশলগত যোগাযোগ সমন্বয়কারী জন কিরবি জানিয়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতে 'খুব হতাশ' হলেও ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি।
ইসরায়েলের বিভিন্ন সমালোচনার পরেও দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে এসেছিলেন। তিনি মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিনের কাছে মার্কিন অস্ত্র ও সরঞ্জামের একটি তালিকা দিয়েছেন যা ইসরায়েল কিনতে চায় এবং দ্রুত সরবরাহ চায়।
জাতিসংঘে নিয়োজিত সাবেক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত গ্যাব্রিয়েলা শালেভ বলেছেন, যদিও সরকারি পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে, ইসরায়েলের বেশিরভাগ মানুষ সম্পর্ক উন্নত করতে চায়।
অতীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন প্রস্তাবে ভোট না হতে দিলেও দেশটির বর্তমান অবস্থান নিয়ে শালেভ বলেন, "এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের মানবিক দিকগুলো বিবেচনা করার পাশাপাশি সমস্ত জিম্মিদের নিঃশর্ত মুক্তির বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করতে চেয়েছিল।"
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়