পশ্চিমা আধিপত্য কি শেষের পথে?
গাজা ও ইউক্রেনে সংঘাতে জড়িয়েছে আমেরিকা। দুনিয়ার অপরপ্রান্তে চীনের সাথে যুদ্ধের হুমকিও ওয়াশিংটনের ঘাড়ের কাছে শ্বাস ফেলছে। এই সমস্ত প্রেক্ষাপট এবং তাতে পশ্চিমা দুনিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে অধ্যাপক মাইকেল ব্রেনারের দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এশিয়া টাইমসের প্রতিবেদক অ্যাড্রিয়েল কাসন্টা।
আলোচনাকালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন তথাকথিত গণতান্ত্রিক, উদারনৈতিক বিশ্ব ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপন্থা নিয়ে আলোকপাত করেন ব্রেনার। বিশ্ব রাজনীতির উত্তাল এই সময়ে এই আলোচনা যেমন সময়নিষ্ঠ, তেমনি জরুরি।
ব্রেনার আন্তঃআটলান্টিক (যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ) সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক একাডেমিয়ার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক এবং জন হপকিনস স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের আন্তঃআটলান্টিক সম্পর্ক কেন্দ্রের একজন সিনিয়র ফেলো।
দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতের সাথে তিনি যুক্ত রয়েছেন। কাজ করেছেন– মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের ফরেন সার্ভিস ইনস্টিটিউট এবং প্রভাবশালী কোম্পানি ওয়েস্টিংহাউসে। এশিয়া টাইমসের প্রতিবেদকের সাথে তিনি কথা বলেছেন কোনো প্রকার রাখঢাক না রেখে। এই আলোচনা চমকপ্রদ ও চাঞ্চল্যকর। কারণ দ্বিমুখী নীতিতে দুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র এবং সার্বিকভাবে পশ্চিমা বিশ্ব কীভাবে বিশ্বের ওপর তাঁর নৈতিক কতৃত্ব এবং পথ হারাচ্ছে– সেটি তিনি তুলে ধরেছেন অকপটে।
অ্যাড্রিয়েল কাসন্টা: পশ্চিমা রাজনৈতিক শ্রেণি এবং মূলধারার গণমাধ্যমে তাঁদের বংশবদ শ্রুতিলেখকদের (স্টেনোগ্রাফার) থেকে আমরা যা শুনতে পাই– তাতে আমার সব সময়েই মনে হয়েছে, পৃথিবীর বাস্তবতাকে তাঁরা সব সময়েই আমাদের (পশ্চিমা নাগরিকদের) থেকে লুকিয়ে রাখতে চায়। বাস্তব যেন আমরা বিশ্বাস না করি– সেদিকেই তাঁদের আপ্রাণ চেষ্টা। এজন্য ইউরোপ বা আমেরিকার বাসিন্দাদের কথা বাদ দিলে– দুনিয়ার অন্য যেকোন প্রান্তের মানুষ মাত্রই আজ জানে, সার্বিক পশ্চিম এখন খাড়া পতনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সেটা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দুদিক থেকেই। এই অবস্থার মূল কারণ সম্পর্কে আমাদের পাঠকদের একটু ভেঙে বলবেন কি? তাঁর সাথে যোগ করে দিন সার্বিক এই আত্মঘাতী হওয়ার পেছনের কার্যকারণগুলোকে।
মাইকেল ব্রেনার: এ বিষয়ে কথা শুরুর আগে, আমার পরামর্শ হলো নৈতিক অবক্ষয় এবং সম্মিলিত পশ্চিমের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পতনের মধ্যে কার্যকারণের দিকটি কী, সেই প্রশ্নটি রেখে আমরা তার ব্যাখ্যা করি। ইউক্রেনের ক্ষেত্রে এটি হয়েছে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে মৌলিক এক ভুল সিদ্ধান্ত, নৈতিকভাবে যার ভয়াবহ নেতিবাচক পরিণতি তৈরি হয়েছে। পাঁচ লাখের বেশি ইউক্রেনীয়কে ন্যাক্কারজনকভাবে কামানের খোরাক হিসেবে যুদ্ধবলি দেওয়া হয়েছে। রাশিয়াকে দুর্বল ও একঘরে করার চেষ্টায় ইউক্রেনকে পরিণত করা হচ্ছে ধবংসস্তূপে।
আর ফিলিস্তিন বিষয়ে সবচেয়ে স্পষ্ট ও দৃষ্টিকটু দিকটি হলো– অনৈতিক সরকারি অভিজাতদের প্রস্তুতি এবং সার্বিকভাবে পশ্চিমা রাজনৈতিক শ্রেণির পুরোটাই– গত সাত মাস ধরে ইসরায়েলের চালানো যুদ্ধাপরাধ ও বীভৎস হত্যাযজ্ঞকে প্রত্যক্ষ সমর্থন ও আশীর্বাদ দিচ্ছে। তাঁদের বৈশ্বিক অবস্থান এবং প্রভাবের এটি চরম ক্ষতি করছে।
কখনো তারা গর্বের সাথে পশ্চিমা মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠত্বের উক্তি করে অন্যান্য দেশের সমালোচনা করছে; পর মুহূর্তেই তারা সেসব বিস্মৃত হয়ে আরো বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের পক্ষে সাফাই গাইছে, যাতে নিরীহ বেসামরিক মানুষকে যারা পঙ্গু ও হত্যা করছে, তাদের অবাধে অস্ত্র সহায়তা দেওয়া যায়। আর যুক্তরাষ্ট্র তো নিরাপত্তা পরিষদে গণহত্যাকারীদের কূটনৈতিক নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে রেখেছে।
এই প্রক্রিয়ায়, পশ্চিমা দুনিয়ার বাইরের মানুষের কাছে পশ্চিমাদের অসম অবস্থানের চিত্র প্রকট হয়ে উঠছে। আর এই জনগোষ্ঠী হচ্ছে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ। উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো বহু দশক ধরে পশ্চিমা বিশ্বের নিপীড়ন, বৈষম্য আর লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে। এটা তাদের সাম্প্রতিক অতীতের ঘটনা। ফলে বিশ্ব মূল্যবোধের মোড়ল হিসেবে আমেরিকার ভূমিকা সম্পর্কে তাদের মনে গভীর সন্দেহ আগে থেকেই ছিল। গাজায় নারকীয়তা শুরুর পর এই অবিশ্বাস তীব্র ঘৃণায় রূপ নিয়েছে পশ্চিমাদের নির্লজ্জ দ্বিচারীতার প্রদর্শনের ফলে। এই ঘটনা আরো প্রমাণ করে, কিছুকাল ম্রিয়মান থাকলেও– পশ্চিমাদের বর্ণবাদী দর্শনের তিলমাত্র পরিবর্তন হয়নি, বরং তা আরো বীভৎস রূপে ফিরে এসেছে।
মানবাধিকারের মানদণ্ড নিয়ে তুলনার সময় এমন চিত্র আঁকা হয়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র হলো স্বর্গরাজ্য– যা মানবজাতির আশা-ভরসার সর্বোত্তম স্থান; বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় অপরিহার্য এবং মানবতাকে পথ দেখানোর আলোকবর্তিকা। কিন্তু এসব মানদণ্ড নেহাত কাল্পনিক ও ঠুনকো। তুলনায় যাবার পক্ষে তা আদর্শ মাপকাঠিও নয়। বরং ন্যূনতম মানবিকতা, দায়িত্বশীল রাষ্ট্র-পরিচালনা এবং সমগ্র মানবজাতির মতামতের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা না থাকার দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বরাবর নিজেকে হেয় করেছে।
পশ্চিম এবং বাকি বিশ্বের মধ্যে আসন্ন বিচ্ছিন্নতা আন্তর্জাতিক শক্তি সম্পর্কের একটি টার্নিং পয়েন্টে ঘটছে। এমন একটি সময়ে– যখন রাজনৈতিক বিশ্বের টেকটোনিক প্লেটগুলি সরে যাচ্ছে, যখন ক্ষমতা এবং প্রভাবের পুরানো শক্তিগুলোকে সফলভাবে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে, যখন আমেরিকা নিরর্থক পেশিশক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে– বিশ্বের স্বনির্ধারিত বিশ্বনেতা ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকা আস্ফালন করছে। অথচ সে নিজেই ভুগছে আত্মবিশ্বাসের অভাবে।
আমেরিকার রাজনৈতিক অভিজাতদের মধ্যে এই আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি পূরণে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ানোর মিথ্যে বাহাদুরিই আজ প্রবলভাবে দেখা যায়। বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য স্থাপন শুরুর পথে যেটি সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। আমেরিকানরা তাঁদের নিজস্ব প্রতিচ্ছবির প্রতিই বেশি অনুরক্ত, অতিরিক্ত আত্মপ্রেমী হয়ে পড়েছে – সামষ্টিক ও ব্যক্তি– উভয় পর্যায়ে। আত্মসচেতনতা এবং নেতৃত্বহীন অবস্থায় তাঁরা পরিবর্তিত বাস্তবতার সাথে তাল মেলানোর পক্ষে একেবারেই অনুপযুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি পশ্চিম ইউরোপের ক্ষেত্রেও এই ব্যাখ্যা প্রযোজ্য। যার ফলে আমরা একটি নৈতিকভাবে দুঃস্থ, অথচ অনুশোচনাহীন আন্তঃআটলান্টিক সম্প্রদায়কে দেখছি।
অ্যাড্রিয়েল কাসন্টা: আপনার সাম্প্রতিক নিবন্ধ 'দ্য ওয়েস্টস রেকনিং'- এ আপনি উল্লেখ করেছেন যে, ইউক্রেনের পরিস্থিতি পশ্চিমাদের দম্ভ খর্ব করেছে, কিন্তু গাজার বিপর্যয় তাঁকে অপদস্থ করছে। এই বিষয়টি আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলবেন কী?
মাইকেল ব্রেনার: ইউক্রেনীয় বাহিনীর সম্পূর্ণ ধস– যা হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে, চেয়েও অনেক বেশি অর্থবহন করছে ইউক্রেনে (পশ্চিমাদের) পরাজয়। যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের সাথে নিয়ে যে ক্যাম্পেইন শুরু করেছে– তার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে স্থায়ীভাবে রাশিয়াকে দুর্বল করা। ইউরোপে মস্কোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপস্থিতিকে ঝেটিয়ে বিদায় করা, এবং আমেরিকার একচ্ছত্র বৈশ্বিক আধিপত্যের রাস্তাকে বাধা-মুক্ত করা।
এই ক্যাম্পেইনে পশ্চিমা দুনিয়া তার সর্বস্ব: আধুনিক অস্ত্রের মজুত, সামরিক পরামর্শক দল, শত শত কোটি ডলার, নজিরবিহীন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা– ইত্যাদি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাশিয়ার অর্থনীতির কোমড় ভেঙে দেওয়ার অন্তহীন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে। রাশিয়াকে বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি তারা চায় পুতিনের নেতৃত্বে ক্রেমলিনের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর পতন। সে জায়গায় তারা দুর্নীতিপরায়ণ এবং পশ্চিমাদের অনুগত রুশ সরকার কাঠামো চায়।
কিন্তু, এই যথার্থভাবেই এই উদ্যোগ প্রতি পদে ব্যর্থ হয়েছে। এখন যুদ্ধের আগের সময়ের চেয়েও প্রায় সবদিক দিয়েই আরো বেশি শক্তিধর হয়েছে রাশিয়া। পশ্চিমা যেকোনো অর্থনীতির তুলনায় সামর্থ্যের পরিচয় দিয়েছে রুশ অর্থনীতি। রাশিয়া তার সামরিক শ্রেষ্ঠত্বকেও প্রমাণ করেছে। এবং সার্বিক পশ্চিমের বাইরের পুরো দুনিয়ার সহানুভুতি তারা জয় করেছে।
পশ্চিমারা বিশ্বব্যবস্থার রক্ষক এই ধ্যানধারণা এক অলীক হিসেবে আবারো প্রমাণিত হয়েছে। সামষ্টিক এসব ব্যর্থতার অর্থ– বৈশ্বিক অর্থনীতি ও নিরাপত্তাকে নিজের ইচ্ছেমতো ভাঙাগড়ার যুক্তরাষ্ট্রের চিরন্তন খেলা পণ্ড হয়েছে। এই শক্তি যে তার পড়তির দিকে– সেটিও ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে। চীন-রাশিয়ার অংশীদারত্ব এখন প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পশ্চিমা শক্তির প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
পশ্চিমারা এই ফল পেয়েছে– তাদের লাগামহীন দর্প, গোঁড়ামি এবং বাস্তবতা বিবর্জিত আচরণের কারণে। ফিলিস্তিনের ট্রাজেডি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পশ্চিমাদের আত্মমর্যাদার কফিনে শেষ পেরেকটিও ঠোকা হয়ে গেছে। তাই নিজের পূর্ববৎ ক্ষমতার পুনরুদ্ধার এবং নৈতিক ভাবমূর্তির উত্তরণ– এই দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ এখন তার সম্মুখে।
কাসন্টা: উদার বিশ্বব্যবস্থার পতনের দিক থেকে দেখলে– গাজা ও ইউক্রেন কী একই সুতায় গাঁথা নয়? ক্রমাগত ব্যর্থতা নিয়ে যে ব্যবস্থাটি দিকে দিকে সংঘাত, অশান্তিকে উস্কে দিচ্ছে– বিশ্বকে এগিয়ে নিচ্ছে ধবংস, হানাহানির পথে। যদি তাই হয়, তাহলে এর ভবিষ্যৎ কী?
ব্রেনার: ভুলে গেলে চলবে না, কথিত উদার বিশ্বব্যবস্থা সর্বাগ্রে পশ্চিমা স্বার্থরক্ষায় কাজ করে। এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা আমাদের পক্ষে কাজ করে, ফলে এটি বিতর্কিত এবং নিরপেক্ষ নয়। দ্বিতীয়ত, এই বিশ্বব্যবস্থা যে নিয়মতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা তৈরি করেছে, তার সহযোগী সংগঠন হিসেবে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই ব্যবস্থার বিপক্ষশক্তি যেন কেউ না হতে পারে, এসব সংস্থা তা দশকের পর দশক ধরে নিশ্চিত করেছে।
তারপরেও নতুন শক্তিকেন্দ্রের উত্থান হয়েছে– যারমধ্যে চীনই অগ্রণী, তবে অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির হাত ধরেও সর্বস্তরে সম্পদের পুনর্বণ্টন হচ্ছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ওপর নির্ভরশীল ইউরোপীয়দের সামনে দুটি পথই খোলা আছে। নতুন এই পরিস্থিতির সাথে তাল মেলানোর জন্য: ক) নতুন অর্থনৈতিক শক্তিগুলোকে জায়গা করে দিয়ে তাদের সাথে নতুন বিশ্বব্যবস্থার একটা সমঝোতা/চুক্তিতে পৌঁছানো; খ) বর্তমান ব্যবস্থার বিতর্কিত অংশগুলো দূর করে খেলার নতুন নিয়ম তৈরি করা; অথবা গ) আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোয় পশ্চিমা আধিপত্যের অবসান করবে দৃশ্যমান এমন কাঠামো ও নীতির প্রবর্তন, এবং ঘ) নির্ভেজাল কূটনীতিতে আবারো ফেরা।
পশ্চিমা বিশ্বের কোথাও গুরুত্ব দিয়ে এসব উপায়ের কথা ভাবা হচ্ছে না। তাই কাঁদা ছোড়াছুড়ি ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের একটা সময় পার করে সবাই এখন উদীয়মান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আমেরিকার প্রকল্পে নাম লিখিয়েছে– কোনপ্রকার আপস ছাড়াই উদীয়মান শক্তিগুলোকে খর্ব করতে এবং নিজেদের আধিপত্যকে গায়ের জোরে কারেম করতে। যার ফলাফল শূন্যই হচ্ছে। ধারাবাহিক ব্যর্থতা, অপমান এবং ব্রিকস প্রকল্পের দেখানো অনুপ্রেরণা সত্ত্বেও আমরা আগের পথেই আটকে আছি।
কাসন্টা: পশ্চিমা কিছু রাজনীতিক ও নীতিনির্ধারকদের মতে, অন্যান্য বিশ্বশক্তির সাথে পরোক্ষ খেলোয়াড় হিসেবে আচরণ করা হচ্ছে, কারণ তাদের নিজেদের জাতীয় স্বার্থ অনুসারে বিশ্বরাজনীতিকে রূপ দেওয়ার কোনো কর্তৃত্ব বা সামর্থ্য নেই। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বলা হচ্ছে, নিয়মতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে 'গণতন্ত্রের সাথে কর্তৃত্ববাদের' পার্থক্য। এই দর্শনের বিকল্প নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা কি হচ্ছে? খুব বেশি দেরি হওয়ার আগেই কী আমরা তার প্রতিফলনও দেখতে পাব?
ব্রেনার: এবিষয়ে আগের প্রশ্নের জবাবেই বলেছি, নীতিতে দরকারি পরিবর্তন আনার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক, আবেগীয় বা রাজনৈতিক কোনো প্রস্তুতি নেই পশ্চিমা নেতাদের। সবখানেই প্রয়োজনের তাগিদ আবিষ্কারের পথকে উন্মুক্ত করে না। এটি এমনই একটি উদাহরণ। বরং আমরা গোড়া একগুয়েমি, সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা এবং কল্পনারাজ্যে আরো ডানা বিস্তারকে দেখতে পাচ্ছি।
আমেরিকা নিজের পতনোন্মুখ শক্তির অবস্থাকে সরাসরি করার প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, একইসঙ্গে একের পর এক উদ্ধত্যপূর্ণ সব কাজ করে যাবার মতো তার 'দরকার সবকিছু' আছে এই বলে নিজেকে আশ্বস্ত করছে। এই আচরণ কী করেছে– আমরা তার উদাহরণ ইউক্রেনে দেখেছি। এর চেয়েও ভয়ঙ্কর হবে- তাইওয়ানে সেনা পাঠানো।
আর ইউরোপের কথায় বলব, ৭৫ বছর ধরে আমেরিকার ওপর প্রায় সম্পূর্ণ-নির্ভরশীলতা তার রাজনৈতিক নেতাদের মতিভ্রষ্ট করেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বতন্ত্র ইউরোপীয় চরিত্র লোপ পেয়েছে। সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে চিন্তা ও সে অনুযায়ী চিন্তাশক্তির অভাবই হয়েছে যার পরিণতি। যুক্তরাষ্ট্রের দাসত্ব ইউরোপকে এমন অন্ধকার পথে নিয়ে গেছে, যেখানে চোখ বন্ধ করে ওয়াশিংটনের নেওয়া যেকোনো নীতিগত পথে পা বাড়ানোই যেন তার জন্য বাধ্যতামূলক। সেটা যত বিপজ্জনক, অনৈতিক বা হিতে-বিপরীতই হোক না কেন।
নিজের আত্মঘাতী স্বভাবের তাড়নায় যুক্তরাষ্ট্র যেসব খাঁদের অতলে ঝাঁপ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার পেছনেই ছুটছেন ইউরোপের নেতারা। ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তানে আগ্রাসনের বেলাতেও আমরা এর ধারাবাহিকতা দেখেছি। এখন দেখছি, ইরান, ইউক্রেন বা তাইওয়ানকে নিয়ে, বা ইসরায়েল-সম্পর্কিত যেকোনো বিষয়ে। অন্ধ অনুরকরণের বেদনাদায়ক সিরিজ ব্যর্থতার পরেও আমরা এই মানসিকতার কোনো পরিবর্তন দেখছি না।
আর তারা সেটা পারবেও না। ইউরোপীয়রা নিরাপত্তার জন্য পুরোপুরি আমেরিকার বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আত্মস্থ করেছে, ফলাফলের বিষয়ে আমেরিকানদের বিভ্রান্তিকর মতামত এবং তাদের ন্যাকারজনক ধারাবর্ণনা বা ন্যারেটিভ গ্রহণ করেছে। আজীবন মদ্যাসক্ত যেমন এক মুহুর্তের জন্য মদপান ছাড়তে পারে না– তেমনিভাবে ইউরোপীয়রাও এই আসক্তি ছাড়তে পারে না।
কাসন্টা: মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির নব্যরক্ষণশীলতার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অনেক আলোচনা হয়। নব্যরক্ষণশীলতার আলোকে যুক্তরাষ্ট্র (মনরো ডকট্রিন অনুসারে) শুধু পশ্চিমকেই নয়, বরং পুরো পৃথিবীতে (উলফউইৎজের ডকট্রিন অনুসারে) আধিপত্য স্থাপন করতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্রের কিছু চিন্তক সংস্থা এখন মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির অন্তহীন যুদ্ধ অবসানের পক্ষে এবং রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের উস্কানিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ইউরোপের পক্ষে ওকালতি করছে, নব্যরক্ষণশীলতার দর্শন যেন ভেক পাল্টে 'প্রগতিবাদ' বা 'বাস্তববাদিতার' ছদ্মবেশে একমাত্র চীনকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে দেখাচ্ছে। এমনকি ইউক্রেনের মতো পরিস্থিতি তাইওয়ানে তৈরির কথা বলছে তারা। এই বিশ্লেষণ কতোটা সঠিক?
ব্রেনার: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারক মহলের সকলের মধ্যেই এখন নব্যরক্ষণশীলতার মৌলিক দিকগুলোর অনুসরণ আছে। ১৯৯১ সালের মার্চে কুখ্যাত এই স্মারক পেশ করেছিলেন পল উলফউইৎজ। যেখানে আমেরিকার বৈশ্বিক আধিপত্যকে নিয়মতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার অংশে পরিণত করার বিস্তারিত পরিকল্পনা ছিল। বর্তমানে ওয়াশিংটন যা করছে বা ভাবছে, তা সবই এই পরিকল্পনার কোনো না কোনো রূপ।
উলফউইৎজ ডকট্রিনের মূল নীতি: বৈশ্বিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সব রকমের উপায় অবলম্বন করবে আমেরিকা; এই লক্ষ্যে উদীয়মান যেকোনো শক্তিকে সে কোণঠাসা করতে সক্রিয় পদক্ষেপ নেবে, বিশেষত যদি সেই শক্তি তাকে চ্যালেঞ্জ করার মতোন সামর্থ্য রাখে। এভাবে বিশ্বের সকল প্রান্তে একচ্ছত্র মোড়লিপণা কায়েম রাখবে আমেরিকা। এই ক্ষেত্রে, আদর্শ বা মূল্যবোধকে উদ্দ্যেশ্যসাধনের সহযোগী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হবে– আদর্শ ও মূল্যবোধের দোহাই দিয়ে প্রতিপক্ষকে ধোলাই করা হবে। একারণেই চিরায়ত কূটনীতি এই কূটকৌশলের কাছে অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে।
কাসন্টা: বিশ্বসাম্রাজ্য হিসেবে আমেরিকা টিকে থাকবে বলে কি আপনার মনে হয়? যেহেতু সে এই আধিপত্যের জন্য যাদের হুমকি বলে মনে করছে, তাদের সাথে একের পর এক সংঘাতে জড়াচ্ছে? নাকি দেশটি একটি প্রকৃত প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবে– যেটি গঠনমূলকভাবে অন্যান্য বিশ্বশক্তির সাথে নিজ নাগরিক ও সার্বিকভাবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করবে? কারণ কথায় আছে, "তলোয়ারধারী গুণ্ডার মাথা একদিন তলোয়ারের নিচেই কাটা পড়ে।"
ব্রেনার: আমি একজন নৈরাশ্যবাদী। কারণে এপর্যন্ত যে আলোচনা আমরা করেছি– তার বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো পশ্চিমা জনমতের গঠন বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনো সদিচ্ছার লক্ষণ আমি দেখছি না। এখানে উন্মুক্ত প্রশ্ন হলো– বৈশ্বিক প্রভাব ক্রমশ দুর্বল হতে থাকার এই প্রেক্ষাপটে মার্কিনীদের এই ভনিতা কতদিন টিকতে পারবে– তাদের নেতারা কী অভ্যন্তরীণ জনকল্যাণে মনোযোগ দেবেন, নাকি তার আধিপত্য বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে শেষ হবে?
ইউরোপ বা অন্যান্য অঞ্চলের মার্কিন মিত্রদের নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষক হয়ে থাকা হবে তার চেয়েও খারাপ। মার্কিনীদের কল্পরাজ্যের সহ-অধিবাসী না হয়ে– তাদের ইউক্রেন, ফিলিস্তিন এবং যে চীন যে দুনিয়ায় আছে– বাস্তবের সেই দুনিয়ায় বাসিন্দা হতে হবে।
অনুবাদ: নূর মাজিদ
লেখক: পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর অনেক বইয়ের লেখক অধ্যাপক মাইকেল ব্রেনার। তাঁর ৮০টির বেশি নিবন্ধ ও গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তাঁর সাম্প্রতিক সময়ের লেখাগুলোর মধ্যে রয়েছে "ডেমোক্রেসি প্রমোশন অ্যান্ড ইসলাম" ; "ফিয়ার অ্যান্ড ড্রেড ইন দ্য মিডল ইস্ট" ; "টু ওয়ার্ড অ্যা মোর ইনডিপেন্ডেন্ট ইউরোপ" এবং 'নার্সিসিসটিক পাবলিক পার্সোনালিটিজ অ্যান্ড আওয়ার টাইম" – ইত্যাদি।