এক ভিস্তিওয়ালার আখ্যান, যিনি একদিনের জন্য মুঘল সম্রাট হয়েছিলেন
ভাগ্যের ফেরে একটি মাত্র কাজের মাধ্যমে বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের সম্রাট হওয়ার বিরল সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন এক সাধারণ ভিস্তিওয়ালা।
তার কাজ ছিল প্রতিদিন জঙ্গল থেকে সম্রাটের সৈন্যদের জন্য পানির পাত্র বহন করে আনা।
আজ আমরা জানব সেই নিজাম ভিস্তিওয়ালারি কথা, যার প্রত্যুৎপন্নমতিতা ও সাহসিকতায় একজন সম্রাট মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। আর ভিস্তিওয়ালা হয়েও বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য শাসন করার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পাতায় আজও অমলিন হয়ে আছে তার নাম।
হুমায়ূনের ত্রাণকর্তা
১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে শের খান বিহারসহ মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল জয় করে কনৌজের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন।
অন্যদিকে, মুঘল সম্রাট হুমায়ুন বাংলা জয় করে চলেছেন রাজধানী আগ্রা অভিমুখে। এরইমধ্যে যাত্রাপথে চৌসা নামক স্থানে শের খানের বিশাল বাহিনীর আক্রমণের শিকার হন হুমায়ুন।
হামলা-পাল্টা হামলার মধ্যেই একদিন অকস্মাৎ হুমায়ুনের তাঁবুতে হানা দেয় শের খানের বাহিনী। যুদ্ধের ময়দানে বিশৃঙ্খলা আর শের খানের দূরদর্শিতায় হার মানে মুঘল বাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে হুমায়ুন গঙ্গায় ঝাঁপ দেন। সম্রাট নদীতে প্রায় ডুবু ডুবু অবস্থা, ঠিক এসময় তার ত্রাণকর্তারূপে হাজির হন নিজাম ভিস্তিওয়ালা।
তাৎক্ষণিক বুদ্ধি ও দক্ষতা দিয়ে সেদিন নিজাম তার মশককে (পানি সংরক্ষণের জন্য ছাগলের চামড়ার তৈরি থলে) ছুঁড়ে দেন হুমায়ুনের উদ্দেশ্যে। এই মশকে ভর করে গঙ্গা পাড় হন হুমায়ুন। যাওয়ার সময় ভিস্তিওয়ালাকে হুমায়ুন প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান, যদি বেঁচে থাকেন এবং রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পারেন, তবে একদিনের জন্য হলেও তাকে সিংহাসনে বসাবেন।
রাজ্য পুনরুদ্ধারের পর সম্রাট হুমায়ুন গভীর কৃতজ্ঞতায় নিজাম ভিস্তিকে এক অভাবনীয় সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি পুরস্কারস্বরূপ একদিনের জন্য নিজামকে আগ্রার সিংহাসনে বসার সুযোগ দেন।
এই অভূতপূর্ব ঘটনাটি একজন মানুষের ব্যক্তিগত অর্জনের চেয়েও অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এর ফলে বীরত্ব ও যোগ্যতাসম্পন্ন একজন সাধারণ মানুষ মুঘল সমাজের উচ্চতম মর্যাদায় আসীন হন।
ক্ষণিকের জন্য নিজামের এই সিংহাসনে আরোহণ, প্রচলিত সামাজিক স্তরবিন্যাসের রেখাগুলোকে মুছে দিয়েছিল।
এটি সম্রাট হুমায়ুনের উদার ও সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মূর্ত প্রতীক। তার এই সিদ্ধান্ত যেন সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিল জন্ম বা অবস্থান নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ স্বীকৃতির যোগ্য হতে পারে।
ভিস্তিওয়ালার শাসন
নিজাম ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম শাসক হলেও, তার একটি কাজ ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি তার যে মশক দিয়ে সম্রাটের প্রাণ রক্ষা করে এই অভাবনীয় মর্যাদা লাভ করেন, সেটিকে টুকরো টুকরো করে কেটে গিল্ড করে স্ট্যাম্প লাগান। সেসব স্ট্যাম্পে তার নাম এবং রাজ্য অভিষেকের তারিখ লিপিবদ্ধ করে মুদ্রা জারি করেন।
এভাবেই একজন ভিস্তিওয়ালা তার একদিনের সাম্রাজ্য শাসন স্মরণীয় করে রাখেন।
এক দিনের উত্তরাধিকার
নিজাম ভিস্তির কাহিনী ইতিহাসের কোনো কৌতূকপূর্ণ আখ্যান নয়। এটি বরং প্রতিটি মানুষের মধ্যে থাকা সম্ভাবনা এবং নিয়তির অভাবনীয়তা বাঁকের একটি বাস্তব উদাহরণ।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা নিজামের গল্পটি মানুষের মনে বড় কিছু করার আশা এবং সাম্যের একটি শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে অনুরণিত হয়।
এই কাহিনী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, অবস্থান নির্বিশেষে ইতিহাস তাদেরই মনে রাখে, যারা সাহসী ও মহানুভব।
হুমায়ূনের বদান্যতা
ইতিহাসে বহুবার সম্রাট হুমায়ুনের নাম তার দুর্ভাগ্য ও বিপর্যয়ের বিভিন্ন ঘটনায় স্মরণ করা হয়। তবে তার পরোপকার ও দয়ালু স্বভাবও বহুল আলোচিত।
শের শাহ সুরির হাতে পরাজয়ের পর বছরের পর বছর মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ানো সত্ত্বেও, তিনি হামিদা বানু বেগমকে বিয়ে করেন এবং ১৫৪২ সালে তার পুত্র আকবর জন্ম নেন।
এই সময়ে হুমায়ুন হিন্দু শাসক রানা প্রসাদের কাছ থেকে থাট্টা জয় করতে সহায়তার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। এই ঘটনা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সংস্কৃতি ও ধর্ম নির্বিশেষে তার সাংগঠনিক শক্তি এবং সুনামের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ঐতিহাসিক লেন-পুল তার উদারতা সম্পর্কে বলেন, হুমায়ুনের উদারতা তার পতনের অন্যতম কারণ। তিনি তার অনেক বিরোধীকেও বার বার ক্ষমা করেছেন। এটি সেই সময়ের কঠোর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার দুর্বলতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
হুমায়ুনের চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যটি শাসন ও শাসনব্যবস্থার প্রতি তার সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। তিনি অসংখ্যবার তার বিরোধীদের উপর দয়া করেছেন এবং তাদের কঠোর শাস্তি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি