গাজার প্রতি সমর্থন থেকে যেভাবে বদলে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাসগুলো
পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গণহত্যার শিকার ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে প্রতিবাদ এবং সমাবেশ করে আসছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের জন্য এরকম প্রতিবাদ করা কিছুটা কঠিন কাজ। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে সমর্থনকারী শিক্ষার্থীদের ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, গাড়ি চাপা দেওয়া হয়েছে এবং তাদের ওপর ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ ছোড়া হয়েছে। তাদেরকে সাময়িক বরখাস্ত ও গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। নিজেদের পরিশ্রম এবং সীমিত তহবিলের উপর ভিত্তি করেই তাদের ফিলিস্তিনের মানুষের ওপর চলমান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হয়েছে।
কিন্তু যে সকল শিক্ষার্থী ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে আসছে তাদের জন্য কাজটা আরো সহজ। তাদের বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহের পাশাপাশি ক্যাম্পাসে হিল্লেল-এর (বিশ্বের বৃহত্তম ক্যাম্পাসভিত্তিক ইহুদি সংগঠন) সমর্থন আছে। তাদের (ইসরায়েলকে সমর্থনকারী) প্রতি সংবাদ মাধ্যমের সুদৃষ্টি থাকায় তারা প্রায়ই ফিলিস্তিনের সমর্থনে চলমান আন্দোলনকে ইহুদি-বিদ্বেষী আন্দোলন বলে দাবি করে থাকে এবং সংবাদ মাধ্যম তাদের এই দাবিকে সমর্থন দেয়।
বিভিন্ন মার্কিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন ইসরায়েলপন্থি অর্থদাতাদের সন্তুষ্ট রাখতে ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থনকারীরা সীমিত অর্থ এবং নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও তাদের মেধা এবং সৃজনশীলতা ব্যবহার করে বিভিন্নভাবে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। তারা জাতি, শ্রেণি বা ধর্ম নির্বিশেষে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে একত্রিত হয়ে ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। তারা বিস্তৃত ও সুচিন্তিত কৌশল ব্যবহার করে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ থেকে শুরু করে আকস্মিক কর্মসূচিও পালন করে আসছে।
কিছু ছাত্র সংগঠন ইতোমধ্যেই এর ফল পেয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ১৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ থেকে 'বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট, স্যাংকশনস (বিডিএস)' আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানানোর যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। [বিডিএস ফিলিস্তিনি-নেতৃত্বাধীন একটি অহিংস আন্দোলন যেটি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বয়কট, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছে।] এই সিদ্ধান্তের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের ২০ মিলিয়ন ডলার বিডিএসের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর পেছনে ব্যয় করা বন্ধ হয়ে গেছে।
একই দিনে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন লস অ্যাঞ্জেলেস (ইউসিএলএ) ইসরায়েলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর বিনিয়োগ বন্ধ করতে আহ্বান জানায়। ২০ ফেব্রুয়ারি ইউসিএলএ-এর ছাত্র সংসদ থেকে সর্বসম্মতভাবে ভোট দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ফি 'বর্ণবাদ, জাতিগত নিপীড়ন এবং গণহত্যা' চালানোর জন্য ব্যবহার করা হবে না।
২৯ ফেব্রুয়ারি রিভারসাইডের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত কোম্পানিগুলোত থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। তারপরে ৬ মার্চ সান দিয়েগোর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন থেকেও একই কাজ করা হয়।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১২০ দিনের অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। তাদের দাবি ছিল— বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসরায়েলি বর্ণবাদ এবং গণহত্যার প্রতি নিন্দা জানাতে হবে, ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতি সমর্থন জানাতে হবে, পাঠদান ও গবেষণায় ফিলিস্তিন-বিরোধী পক্ষপাতিত্ব চিহ্নিত করতে হবে এবং ইসরায়েলকে সমর্থন জানানো কোম্পানিতে বিনিয়োগ বাতিল করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি বাতিল করতে বললে পাঁচশতাধিক শিক্ষার্থী প্রতিবাদ মিছিল করে। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি সাহস থাকলে তাদের গ্রেপ্তার করার চ্যালেঞ্জ জানায়। প্রশাসনিক কিছু কর্মকর্তা তাদের দাবিদাওয়া বুঝতে পারলেও বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। তাই শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে এবং ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। তারা পুরো ক্যাম্পাসকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য একটি বড় প্রচারণা চালানোর পরিকল্পনা করছে।
যদিও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে খুব বেশি পরিবর্তন আনেনি, শিক্ষার্থীরা যতটুকু করতে পেরেছে তাতে তারা গর্ব বোধ করে। তারা আলোচনার জন্য একটি জায়গা তৈরি করেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিলিস্তিনের সমর্থনে কিছু করার চেষ্টা করছে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ছাত্র সংগঠক ফারাহ পডকাস্টের জন্য দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট (বাইডেন) সহ প্রশাসকরা স্বীকার করেছেন যে শিক্ষার্থীদের এ অবস্থান কর্মসূচি থেকে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানানোর ব্যাপারে আলোচনা করার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রচারণা এবং স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মাধ্যমে অনেক মার্কিন ক্যাম্পাসের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মিছিল ও সমাবেশে থেকে উঠে আসা বিতর্ক ছাড়াও বিডিএস আন্দোলনের প্রতি সমর্থন এবং অবস্থান কর্মসূচি ফিলিস্তিনের চলমান আগ্রাসনের বিষয়টিকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে সক্ষম হয়েছে। প্রায়ই এসব কর্মসূচিতে অতিথি বক্তা হিসেবে ফিলিস্তিনি এক্সটিভিস্ট অথবা ফিলিস্তিনি শিল্পীদের নিয়ে আসা হয়। তাদের বক্তব্য থেকে শিক্ষার্থীরা ফিলিস্তিনের চলমান হামলা, আগ্রাসন ও গণহত্যা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে পারে। এর ফলে মার্কিন শিক্ষার্থীদের বিস্তৃত পরিসরে দৃষ্টিকোণের পরিবর্তন আসার পাশাপাশি তারা অনদেরকেও এ তথ্যগুলো জানাতে পারে।
বিগত মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো ফিলিস্তিনের বিষয়ে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে যেটিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ের যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের সাথে তুলনা করা যায়। ফিলিস্তিনের সমর্থনে শিক্ষার্থীদের চলমান বিক্ষোভ মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের বিবরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে।
বিক্ষোভগুলো ফিলিস্তিনের মুক্তির সংগ্রামকে তৎকালীন ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামের মতো দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত করার মাধ্যমে বিস্তৃত বহুজাতিক জোট তৈরি করতে সাহায্য করছে। এ ধরনের সংযোগের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ছোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও চলমান আন্দোলন থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করছে না।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিয়েতনামের পতাকা নিয়ে প্রতিবাদ না হলেও বর্তমানে শিক্ষার্থীরা ফিলিস্তিনের পতাকা এবং কেফিয়াহ নিয়ে মিছিল করেছে ও ফিলিস্তিনের প্রতি দৃঢ় সংহতি প্রদর্শন করেছে। তারা ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের প্রতি মার্কিন সমর্থনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
বর্ণবাদ এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে অতীত আন্দোলনের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের কারণে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে মার্কিন ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের বক্তব্য পরিবর্তিত হয়েছে। ইহুদি বিরোধীতার অভিযোগ এনে সমালোচকদের নীরব করার প্রচেষ্টা বা বৈচিত্র্যের উদ্যোগের উপর আক্রমণ এই গতিকে থামাতে পারবে না।
যদিও ক্যাম্পাস আন্দোলনগুলো জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে কিনা সেটা এখনো অনিশ্চিত, তারা ইতোমধ্যেই স্থানীয় সম্প্রদায়, বিভিন্ন ইউনিয়ন, গির্জা এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছে। ১০০টিরও বেশি মিউনিসিপিলিটি (পৌরসভা) এবং কংগ্রেসের ৮৫ জন সদস্যের থেকে আসা যুদ্ধবিরতির আহ্বান কিছুটা অগ্রগতি দেখালেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের অধিকারের জন্য ছাত্রদের আন্দোলন ও সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়