তরুণদের মাঝে ধূমপানের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে ভেপিং; বাড়ছে ফুসফুস-মস্তিষ্কে ক্ষতির ঝুঁকি
তরুণ প্রজন্মের মাঝে বর্তমানে ধূমপানের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে ভেপিং। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তরাজ্যের তরুণদের মধ্যে ভেপিং ব্যাপক জনপ্রিয়। দেশটির ধূমপান বিরোধী চ্যারিটি 'এশ' এর সার্ভেতে দেখা যায়, শিশুদের মধ্যে এর অভিজ্ঞতা ২০২২ সালে ছিল ৭.৭ শতাংশ। সেখানে ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১.৬ শতাংশ।
বেশিরভাগ শিশুরাই 'কৌতূহলবশত' ভেপিং করে থাকেন। এক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পর্কে তারা বিভিন্ন শপ ও অনলাইন থেকে জানতে পেরেছে। এছাড়াও নানা ফ্লেভারের প্রতি আকর্ষণ ও পিয়ার গ্রুপের চাপের কারণেও অনেকে ভেপিংয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে।
তবে তরুণদের ওপর ভেপিংয়ের বহু নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে এটি ফুসফুস ও মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন করে।
বয়ঃসন্ধিকাল মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে মস্তিষ্ক উন্নতি লাভ করতে থাকে এবং নতুন সব সংযোগ স্থাপিত হয়। এই সময়ে অঙ্গটির আবেগ ও পুরস্কার নিয়ন্ত্রণকারী অংশগুলো পরিকল্পনা ও আত্ম-নিয়ন্ত্রণে সাহায্যকারী অংশগুলির তুলনায় দ্রুত বিকাশ লাভ করে। ফলে তখন কিশোররা ঝুঁকিতে পরে, যার মধ্যে ভেপিং অন্যতম।
ভেপিং-এ থাকা নিকোটিন প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় কিশোরদের ভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কেননা তাদের মস্তিষ্ক তুলনামূলক বেশি সংবেদনশীল।
নিকোটিনের ফলে মস্তিষ্কের রিসেপ্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়; যা শেখার ও আসক্তির কাজে লাগে। এমনকি কম মাত্রার নিকোটিনের প্রভাবেও কিশোর-কিশোরীরা অন্যান্য পদার্থে আসক্ত হতে, ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করতে কিংবা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরিতে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করতে পারে।
নিকোটিন কিশোর-কিশোরীর মস্তিষ্কে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। এর প্রভাবে একজন যুবকের শেখার ও ফোকাস করার ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে তারা যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায় তখনও আবেগপ্রবণভাবে কাজ করার সম্ভাবনা বাড়তে পারে।
এমনকি অল্প পরিমাণে নিকোটিন হাঁপানির মতো সমস্যায় ভুগতে থাকা টিনেজারদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এগুলো তাদের মানসিক চাপের প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তোলে এবং সম্ভবত পরবর্তী জীবনে মানসিক অবস্থায় সমস্যা তৈরি করতে পারে।
অল্পবয়সী যারা ভেপিং করে তাদের পাশাপাশি ধূমপান শুরু করার সম্ভাবনাও বেশি। এক্ষেত্রে তাদের নিকোটিনের ব্যবহার পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া বেশ কঠিন হতে পারে। একইসাথে সিগারেটের মতো নিকোটিনযুক্ত অন্যান্য পণ্যের ব্যবহার তাদের স্বাস্থ্যের জন্য আরও নেতিবাচক হতে পারে।
ভেপিংয়ের অনেক পরোক্ষ ঝুঁকিও রয়েছে; যা অনেকেরই অজানা। ভেপে থাকা লিকুইডের রাসায়নিক পদার্থে বিভিন্ন টক্সিন, ভারী ধাতু এমনকি তেজস্ক্রিয় পোলোনিয়ামও থাকতে পারে। এই উপাদানগুলি লিকুইডে কতটা ব্যবহার করা হয়েছে এবং কত তাপমাত্রায় সেগুলি উত্তপ্ত হয়ে বাষ্প হচ্ছে সেটাও এখানে বিবেচ্য বিষয়।
কিছু ভেপিংয়ে ধারণার চাইতে বেশি পরিমাণে নিকোটিন থাকতে পারে। এটি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ভেপে তরল উপাদানগুলির নির্দিষ্ট মিশ্রণের কারণে হতে পারে।
ভেপিংয়ের বিভিন্ন ফ্লেভারও বেশ উদ্বেগের কারণ। বাজারে ফল, ক্যান্ডি ফ্লস, মিন্ট ও চকোলেটের মতো প্রায় ৭ হাজারেরও বেশি ফ্লেভার রয়েছে। একইসাথে তরুণদের কাছে আকর্ষণীয় করেই ভেপগুলো ডিজাইন করা হয়ে থাকে৷ ২০২৩ সালের মার্কিন সমীক্ষায় দেখা গেছে, কিশোর-কিশোরীরা ফলের ফ্লেভারের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
কিন্তু এই ফ্লেভারগুলো ফুসফুসের ক্ষতিসাধন করতে পারে; বিশেষ করে 'পপকর্ন ফুসফুস' বা 'ব্রঙ্কিওলাইটিস ওব্লিটারানস' নামক গুরুতর অবস্থার কারণ হতে পারে। এটি এমন এক অবস্থা যা ফুসফুসের ক্ষুদ্রতম শ্বাসনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং কাশি ও শ্বাসকষ্ট তৈরি করতে পারে। এমনকি এই ফ্লেভারগুলো শরীরের কোষেরও ক্ষতিসাধন করতে পারে।
যুক্তরাজ্যের ফ্লেভার ইন্ডাস্ট্রি তদারকির জন্য রয়েছে দ্য ফ্লেভার এন্ড এক্সট্রাক ম্যানুফ্যাকচার এ্যাসোসিয়েশন। সংস্থাটি ভেপের ফ্লেভারগুলো কতটা ভালোভাবে পরীক্ষা করা হয় সেটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এক্ষেত্রে চিন্তিত হওয়ার যুক্তিযুক্ত কারণও রয়েছে। কেননা ডায়াসিটাইলের মতো ফ্লেভার খাবারে মাখনের মতো গন্ধ দিতে নিরাপদভাবে ব্যবহার করা হয়। তবে একইজিনিস আবার ভেপিংয়ের সময় ফ্লেভার হিসেবে ব্যবহার করলে ফুসফুসের গুরুতর সমস্যা হতে পারে।
ভেপের বহু লিকুইডকে নিকোটিন মুক্ত বলে প্রচার করা হয়। তবে এতে নাইট্রোসামাইন নামক রাসায়নিক থাকতে পারে, যা ক্যান্সারের কারণ হিসাবে পরিচিত।
ভবিষ্যতে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসে ডিসপোজেবল ভ্যাপের উপর হয়ত নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হতে পারে। তবে এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য শুধু নিষিদ্ধ করাই যথেষ্ট নয়। যেহেতু বাজারে ইতিমধ্যে ভেপের শত শত ব্র্যান্ড রয়েছে, সেহেতু এই সমস্যা সমাধানে আরও বৃহৎ উদ্যোগ প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক তরুণদের মাঝে ভেপিংয়ের নেতিবাচকতা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। একইসাথে সিগারেটের মতো অনলাইনে ও ভেপের দোকানগুলিতে স্বাস্থ্য সতর্কতা তুলে ধরতে হবে।
তরুণদের লক্ষ্য করে তৈরিকৃত ফ্লেভারের উপরও বিধিনিষেধ আরোপ প্রয়োজন। একইসাথে ভেপ বিক্রির জন্য কঠোরভাবে বয়স যাচাইকরণ এবং উপাদানগুলো নিকোটিন মুক্ত কি-না সেটিরও দেখা প্রয়োজন। পাশাপাশি ভেপের সাথে সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলোতে কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে।
অনেকেই স্বাস্থ্যগত দিকের কথা চিন্তা করে ধূমপান ছেড়ে দিতে বিকল্প হিসেবে ভেপিং বেছে নেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি কোনো সমাধান নয়। বরং এতেও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বহু ঝুঁকি রয়েছে।
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান