গাজা যুদ্ধের প্রতিবাদ: যেভাবে চালকের ভূমিকা পালন করেছে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভকারীদের মধ্যে দুই সপ্তাহের স্থবিরতা মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) শেষ হওয়ার সাথে সাথে এ আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে কিনা অথবা বিক্ষোভকারীরা আন্দোলনের তীব্রতা আরো বাড়াবে কিনা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এর আগে বিক্ষোভকারীরা মঙ্গলবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন হ্যামিল্টন হলে প্রবেশ কর সেটি দখল করেছিল। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান চালিয়েছিল নিউ ইয়র্ক পুলিশ। পরবর্তীতে বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
দীর্ঘ সময় পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এত তীব্র মাত্রা ধারণ করেছে। ইতিহাস বলে, প্রায় ৬০ বছর আগে সিভিল রাইটস মুভমেন্ট এর সমর্থনে ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিক্ষোভকারীদের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে অবস্থান কর্মসূচি ও আন্দোলন থেকে সরে আসতে বললেও তারা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে গেলে নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগকে (এনওয়াইপিডি) ক্যাম্পাসে প্রবেশের অনুমতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের দাবি ছিল ফিলিস্তিনে চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ করা এবং ইসরায়েলকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা থেকে সরে আসা। ১৭ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন এখন পশ্চিমের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পূর্বে ম্যাসাচুসেটস পর্যন্ত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়েছে।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান আন্দোলনের ক্রমধারা এখানে তুলে ধরা হলো।
১৭ এপ্রিল
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রথমবারের মতো ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি পালনের জন্য তাঁবু খাটায়। একই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট নেমাত শফিককে কংগ্রেসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়।
রিপাবলিকানরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইহুদী-বিদ্বেষ ছড়াতে পারে এমন আন্দোলনকে বাঁধা দিতে যথার্থ পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য শফিকের সমালোচনা করে।
এর ৪ মাস আগে একই অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করেছিল। তারা বাকস্বাধীনতাকে রক্ষা করার কথা বললেও নেমাত শফিক ইহুদি-বিদ্বেষের প্রতি নিন্দা জানিয়ে বলেছিল, "আমাদের ক্যাম্পাসে এর কোন জায়গা নেই।"
১৮ এপ্রিল
নিউ ইয়র্ক শহরের পুলিশকে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলমান আন্দোলন থামাতে ডাকা হয়। তারা ক্যাম্পাস থেকে ডেমোক্র্যাটিক ইউএস রিপাবলিকের প্রতিনিধি ইলহান ওমরের মেয়ে সহ ১০০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করে।
নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র এরিক অ্যাডামসে বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধেই আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করার ঘটনায় দেশব্যাপী অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরে।
সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ১০ মে আসন্ন সমাবর্তন অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্র নির্মাতা জন এম চু-এর বক্তৃতা বাতিল করার পাশাপাশি একজন মুসলিম শিক্ষার্থীর বক্তৃতা বাতিল করে দেয়।
পরবর্তীতে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) এবং নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলিস্তিনপন্থি শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা শুরু করে।
২২ এপ্রিল
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় স্ব-শরীরে ক্লাস নেওয়া বাতিল ঘোষণা করে। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত বিক্ষোভকারীদের আন্দোলন শুরু হয়।
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারীদের সরে যেতে বলে এবং পরবর্তীতে ক্যাম্পাসে পুলিশ আনায়। পুলিশ বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্যাম্পাসগুলতে চলমান অস্থরতাকে উদ্দেশ্য করে এগুলোকে 'ইহুদি-বিদ্বেষি আন্দোলন' হিসেবে অভিহিত করেন এবং যারা "ফিলিস্তিনে আসলে কি হচ্ছে জানে না" তাদের তিরস্কার করেন।
২৪ এপ্রিল
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভকারীদের অবস্থান কর্মসূচি থেকে সরে আসতে ও ক্যাম্প সরিয়ে ফেলতে মধ্যরাত পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয়। কেউ কেউ চলে গেলেও অন্যরা বিশ্ববিদ্যালয় ইসরায়েলের সাথে অর্থনৈতিক চুক্তি থেকে সরে না আসার আগ পর্যন্ত ও গাজার যুদ্ধকে সমর্থন করে এমন কোনও সংস্থার সাথে ব্যবসা বন্ধ করতে সম্মত না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান থেকে সরে আসতে অস্বীকৃতি জানায়।
পুলিশ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আরো বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করে। অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত স্থানীয় এবং রাজ্য পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তাদের ক্যাম্পাসের মাঠ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় এবং এবং ৩০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুলিশ শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করে।
২৬ এপ্রিল
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানায়, তারা প্রশাসনের সাথে আলোচনার পরে একটি অচলাবস্থার মধ্যে রয়েছে এবং তারা তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান চালিয়ে যেতে চায়।
গত নয় দিনে দেশব্যাপী শত শত বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করার পরে এ ঘোষণা আসে। কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের একটি ই-মেইল পাঠায় যে 'এই সময়ে' ক্যাম্পাসে পুলিশকে ফিরিয়ে আনা হিতে বিপরীত হতে পারে।
ইতোমধ্যেই সারাদেশে যে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে সেগুলোকে ইহুদি-বিরোধী কার্যকলাপ হিসেবে চিহ্নিত করে বন্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয় এবং বিক্ষোভগুলো আসন্ন সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
২৯ এপ্রিল
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের স্থানীয় সময় দুপুর ২টার মধ্যে অবস্থান কর্মসূচি থেকে সরে আসার নির্দেশনা অমান্য করে বিক্ষোভকারীরা ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করা শুরু করে।
সারা দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে গ্রেপ্তার হওয়া আন্দোলনকারীর সংখ্যা ১ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
৩০ এপ্রিল
ফিলিস্তিনিপন্থী বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান চালায় শত শত পুলিশ কর্মকর্তা। সরাসরি প্রচারিত ভিডিওতে দেখা যায়, নিউ ইয়র্ক পুলিশ মই বেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন হ্যামিল্টন হলে প্রবেশ করছে এবং আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিচ্ছে। পরবর্তীতে বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পুলিশ বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীর হাত প্লাস্টিকের জিপ টাই দিয়ে বেঁধে নিয়ে যায়। হ্যামিলটন হল থেকে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
১ মে
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভকারীরা বিরোধী দলগুলোর (ইসরায়েলপন্থি) সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করতে পুলিশ হস্তক্ষেপ করে ও সহিংসতা প্রতিরোধ করতে ফিলিস্তিনিপন্থী এবং ইসরায়েলপন্থি বিক্ষোভকারীদের মধ্যে বাধা সৃষ্টি করে।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়