গাজা যুদ্ধ: হামাসের মেনে নেওয়া যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবে কী কী আছে?
গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং ইসরায়েলের সাথে জিম্মি মুক্তির চুক্তিতে রাজি হয়েছে হামাস। যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করছে মিশর ও কাতার। সম্মত হওয়ার কথা মিশর ও কাতারি মধ্যস্থতাকারীদের নিশ্চিত করা হয়েছে গোষ্ঠীটির পক্ষ থেকে।
হামাস জানিয়েছে, তারা এখন ইসরায়েলিদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন।
তবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাস যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে তা 'ইসরায়েলের মৌলিক চাহিদা থেকে অনেক দূরে' তবে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
হামাস কর্মকর্তারা আল জাজিরাকে মিশর-কাতারের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের একটি অনুলিপি দেখিয়েছেন।
এ প্রস্তাবে তিনটি ধাপ রয়েছে এবং গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধের অবসানের পাশাপাশি দুই অঞ্চলে আটক ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দেয়া হবে।
ইসরায়েল এই যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে এখনও রাজি হয়নি। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাস যে প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে তাতে ইসরায়েলের দাবিগুলো পূরণ হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, হামাস যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে তা মিশরের উত্থাপিত পূর্ববর্তী প্রস্তাবের একটি নরম সংস্করণ। ওই প্রস্তাবে এমন শর্তাবলি অন্তর্ভুক্ত ছিল যা ইসরায়েলের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না।
তবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে আলোচনার জন্য মধ্যস্থতাকারীদের একটি দল পাঠানো হবে।
এদিকে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে হামাসের রাজি হওয়ার খবর শুনে উল্লাসে রাস্তায় নেমে এসেছে গাজাবাসী। সাত মাস ধরে চলা এ যুদ্ধে মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন তারা। ৭ অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত ৩৪ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি ইসরায়েলিদের হামলায় গাজা উপত্যকায় নিহত হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র এখনও কোনো বক্তব্য দেয়নি। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে হামাসের প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা করছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কাতার ও মিসরের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হামাসের প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা করছে এবং আমাদের অংশীদারদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা বিশ্বাস করি যে জিম্মি চুক্তিটি ইসরায়েলি জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থে। এটি ফিলিস্তিনি জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থে।'
হামাসের প্রস্তাবে কী কী শর্ত আছে?
চুক্তিটি তিনটি পর্যায়ে কার্যকর ও প্রতিটি ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হবে।
চুক্তির প্রথম ধাপে হামাস এবং ইসরায়েল সাময়িকভাবে লড়াই বন্ধ করবে, ইসরায়েলি বাহিনী পূর্ব দিকে গাজার ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল থেকে সরে ইসরায়েল-গাজা সীমান্তের দিকে অগ্রসর হবে। প্রথম ৪০ দিনের মধ্যে ৩৩ জন জিম্মিকে (জীবিত বা মৃত) মুক্তি দেবে হামাস। এই দফায় নারী, শিশু, প্রবীণ ও অসুস্থ ব্যক্তিরা মুক্তি পাবেন।
প্রত্যেক ইসরায়েলি জীবিত নাগরিকের জন্য ৩০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে তারা। আর হামাসের মুক্তি পাওয়া প্রত্যেক নারী সেনার বিপরীতে ৫০ জন ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেবে ইসরায়েল।
ইসরায়েলি বিমান ও ড্রোন প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা ও বন্দি মুক্তির দিনগুলোতে ১২ ঘণ্টা গাজার আকাশে উড্ডয়ন বন্ধ রাখবে।
ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহারের ফলে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকরা গাজায় তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে, যা হামাস বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে ঘটবে। পৃথকভাবে, চুক্তিতে শর্ত দেওয়া হয়েছে যে গাজায় পুনর্গঠন কাজ অবশ্যই এই পর্যায়ে শুরু করতে হবে, পাশাপাশি সহায়তা প্রবাহ এবং ইউএনআরডাব্লুএ এবং অন্যান্য ত্রাণ সংস্থাগুলোকে বেসামরিক লোকদের সহায়তার জন্য কাজ করার অনুমতি দেওয়া হবে।
চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে সামরিক অভিযান স্থায়ীভাবে বন্ধ হবে এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার করা হবে। পরবর্তী ৪২ দিনের মধ্যে বাকি সব ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দেবে হামাস। বিনিময়ে আরও কয়েকশ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে ইসরায়েল, তবে সে সংখ্যা এখনও নির্দিষ্ট নয়।
তৃতীয় পর্যায়ে ৪২ দিনের মধ্যে উভয় পক্ষের হাতে বন্দী অবস্থায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের দেহাবশেষ হস্তান্তর করা হবে। উপরন্তু, গাজার জন্য তিন থেকে পাঁচ বছর স্থায়ী একটি পুনর্গঠন পরিকল্পনা থাকবে।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া কী?
আন্তর্জাতিক বিরোধিতা সত্ত্বেও দক্ষিণ গাজায় সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করার সময় ইসরায়েল পূর্ব রাফায় ফিলিস্তিনিদের সরে যাওয়ার জন্য সতর্ক করেছিল, তার মানে দাঁড়ায় যে তারা কোনো চুক্তির আশা করছে না।
ইসরায়েলি গণমাধ্যম প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে, হামাস যে চুক্তি মেনে নিয়েছে তা ইসরায়েলের বিবেচনাধীন নয়।
এদিকে, কট্টর ডানপন্থি জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির তাৎক্ষণিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে রাফায় আগ্রাসনের আহ্বান জানিয়েছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ইসরায়েলের এক কর্মকর্তা বলেন, হামাসের ঘোষণা 'ইসরায়েলকে চুক্তি প্রত্যাখ্যানকারী পক্ষের মতো দেখানোর একটি কৌশল' বলে মনে হচ্ছে।
তবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাস যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে তা ইসরায়েলের দাবি পূরণ করে নি, তবে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। তিনি আলোচকদের সাথে দেখা করার জন্য কায়রোতে একটি প্রতিনিধি দল পাঠাবেন।
তিনি আরও বলেন, ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা সর্বসম্মতিক্রমে হামাসের ওপর সামরিক চাপ প্রয়োগের জন্য রাফায় অভিযান অব্যাহত রাখতে সম্মত হয়েছে এবং এর জন্য সোমবার রাতে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলি বিমান হামলা চালানো হয়।
এদিকে, গাজায় আটক বন্দীদের পরিবারের সদস্যরা তেল আবিবে বিক্ষোভ করেছেন এবং সরকারের কাছে একটি চুক্তি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন