যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্দোলনের বিরুদ্ধে যেভাবে মার্কিন গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে
গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে মেতে উঠেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে পুলিশ, পালটা বিক্ষোভকারীদেরও সংঘর্ষ হয়েছে।
ফিলিস্তিনে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা এবং ইসরায়েলের দখলদারত্বের অবসান দাবি জানাচ্ছেন তারা।
ইসরায়েলের মিত্র মার্কিন সরকার বনাম ফিলিস্তিনপন্থিদের এই চলমান সংঘর্ষে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তাদের বিপক্ষে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এক— মার্কিন মূলধারার গণমাধ্যম এবং দুই— ইহুদি বিদ্বেষের অজুহাত।
মার্কিন মূলধারার গণমাধ্যমগুলো ইসরায়েলি মতাদর্শকে ব্যাপকভাবে প্রচার করছে এবং এর মাধ্যমে সরকারের স্থানীয়, রাষ্ট্রীয় এবং জাতীয় নীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।
আর ফিলিস্তিনপন্থিদের আন্দোলনকে অন্যায্য ও অযৌক্তিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ইহুদি বিদ্বেষের অজুহাত। স্বাধীন ফিলিস্তিনের আন্দোলনকে ইহুদি বিদ্বেষী আন্দোলন হিসেবে দেখিয়ে গাজাবাসীর ওপর মার্কিন-সমর্থিত ইসরায়েলি নির্মম অত্যাচার, শোষণ ও হত্যাকাণ্ডকে বিশ্ববাসীর চোখে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা ও মনোযোগ সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ইসরায়েল গাজায় হামলা শুরু করার পর থেকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দৃঢ় সমর্থন তরুণ আমেরিকানদের উদ্দীপ্ত করেছে এবং তাদের সংগঠিত করতে বাধ্য করেছে।
তারা মুসলিম ও আরব আমেরিকান, ইহুদি, কৃষ্ণাঙ্গ, হিস্পানিক এবং নেটিভ সম্প্রদায়, শ্রমিক ইউনিয়ন এবং গীর্জার সাথে সিদ্ধান্তমূলক জোট গঠন করেছে। তরুণ সমাজ এক প্রকার হুমকি দিয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি যুদ্ধে সমর্থন অব্যাহত রাখে তবে তারা নভেম্বরের নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রার্থীদের বর্জন করবে, যা দলটির জন্য ভালো হবে না অবশ্যই।
তিন সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠার আগ পর্যন্ত মার্কিন ক্ষমতাধর এলিটরা তরুণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক সমালোচনা অনেকাংশেই উপেক্ষা করে আসছিল।
শিক্ষার্থীরা গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, ইসরায়েলকে মার্কিন সরকারের আর্থিক ও সামরিক সহায়তা বন্ধ এবং ইসরায়েলি গণহত্যায় সক্ষম সামরিক শিল্প থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনিয়োগ বিচ্ছিন্ন করার দাবি জানিয়েছে।
তবে ক্যাম্পাসের বিক্ষোভ এবং শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা নিয়ে মার্কিন মূলধারার প্রতিবেদনগুলোতে ইসরায়েলি পক্ষ নিয়েই চিত্রিত করা হয়েছে যা ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। একই সঙ্গে তারা ফিলিস্তিনিদের এবং তাদের সমর্থনকারী যে কাউকে অপরাধী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোকে গভীর পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বাইডেন প্রশাসন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে যেসব শব্দ ও বাক্যাংশ ব্যবহার করে আন্দোলনকে অন্যায্য প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, ঠিক একই ভাষা ব্যবহার করছেন সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমগুলোও। ইসরায়েলি আচরণ সম্পর্কে জনগণকে সত্যিটা জানার সুযোগ না দিয়ে বরং তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মূলধারার গণমাধ্যমগুলো ব্যাপকভাবে শিক্ষার্থীদের নিন্দা করছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণাত্মক বক্তব্য এবং ঘৃণামূলক প্রতীক ব্যবহার করা, সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করা, ইসরায়েলের ধ্বংসের পক্ষে ওকালতি করা, ইহুদি-বিরোধী গালি দেওয়া এবং ইহুদি শিক্ষার্থীদের হুমকি ও ভয় দেখানোর এমন নানা অভিযোগ আনছে। তারা দাবি করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ ও অবকাঠামো নষ্ট হচ্ছে এবং বিক্ষোভকারীরা 'নাৎসি জনতা' গঠন করছে।
গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের গণহত্যায় আমেরিকার ভূমিকার অবসান এবং ফিলিস্তিনে সবার জন্য শান্তি ও ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে প্রখ্যাত টিভি উপস্থাপকরা নানাভাবে তীর্যক, নেতিবাচক মন্তব্য শুরু করেছেন।
এমএসএনবিসি-তে একটি জনপ্রিয় টিভি শো, মর্নিং জো, যা বাইডেন পছন্দ করেন বলে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদের জন্য সমালোচিত হয়েছে।
একজন উপস্থাপক জো স্কারবরো শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ইহুদিদের ক্ষতি করতে চাওয়ার অভিযোগ করেছেন এবং তাদের হামাসের সাথে তুলনা করেছেন। আরেক উপস্থাপক মিকা ব্রেজিনস্কি এই বিক্ষোভকে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
এবিসি, সিএনএন এবং এনবিসিসহ সব বড় বড় গণমাধ্যমে একই চিত্র দেখা যায়।
গত কয়েক সপ্তাহে মূলধারার টেলিভিশনে যেসব 'বিশেষজ্ঞ' বিশ্লেষককে বিক্ষোভ নিয়ে মন্তব্য করেছেন তাদের বেশিরভাগই সাবেক মার্কিন সরকার বা নিরাপত্তা কর্মকর্তা, ইসরায়েলি দৃষ্টিভঙ্গির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি, অথবা সাবেক ইসরায়েলি কর্মকর্তা।
এমএসএনবিসি-তে কয়েকটি সাক্ষাৎকার ছাড়া সম্প্রচারমাধ্যমগুলো ফিলিস্তিনের পক্ষে কাউকে বা নিরপেক্ষ কোনো বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানায়নি যারা প্রচার মাধ্যম এবং কর্মকর্তাদের কাছে আপত্তিকর বা হুমকিস্বরূপ অভিব্যক্তির প্রকৃত অর্থ ব্যাখ্যা করতে পারে এবং বিক্ষোভ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ইহুদিদের উদ্বেগের সমাধান দিতে পারে।
আশ্চর্যজনকভাবে, বেশিরভাগ গণমাধ্যম ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে মার্কিন কর্মকর্তাদের বিবৃতিও খুব বেশি যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রকাশ করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, যখন হাউসের রিপাবলিকান স্পিকার মাইক জনসন এবং বেশ কয়েকটি মূল কংগ্রেশনাল কমিটির প্রধানরা ৩০ এপ্রিল একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন যেখানে তারা ক্যাম্পাসে ইহুদিবিদ্বেষকে বাড়তে দেওয়ার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হুমকি ও দোষারোপ করেছিলেন।
জনসন বলেন, 'আমরা ক্যাম্পাসে ইহুদিবিদ্বেষকে বাড়তে দেব না এবং ক্যাম্পাসে ইহুদি শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় তাদের ব্যর্থতার জন্য আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জবাবদিহি করব।'
এমন অভিযোগ কোনো যাচাই বাছাই ছাড়াই সত্য হিসেবে প্রচার করেছে গণমাধ্যমগুলো। যার ফলে ইসরায়েলি নীতির সমালোচনা করা এবং ইহুদি বিদ্বেষী আচরণ এই দুই বিষয়কে গুলিয়ে ফেলছেন অনেকে, যা কিনা পুরোপুরি ভিন্ন দুটি ব্যাপার এবং বিশেষজ্ঞদের মতে বিপজ্জনক।
তবে আর পাশাপাশি এমন কিছু প্রতিবেদনও আছে যেখানে এমন ব্যক্তিদের মন্তব্য রয়েছে যারা ছাত্রদের সাথে সময় কাটিয়েছেন, তাদের উদ্দেশ্য এবং কারণ অনুধাবন করেছেন এবং কোনো দেশী বা বিদেশি স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত নন।
স্বাধীন, প্রগতিশীল এই গণমাধ্যমগুলো কোনো দেশি বা বিদেশি লবির কাছে নতজানু নয়, তারা ক্ষমতার অভিজাতদের যুদ্ধ তৈরির উন্মাদনাকে সমর্থন করে না, সবার জন্য সমান ন্যায়বিচারের একটি সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে।
মূলধারার মিডিয়া এখন আমেরিকান রাজনৈতিক নেতাদের মতামতকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছে এবং তারা অতিরঞ্জিত, গুজব এবং ভয় ছড়াচ্ছে। এটা অদ্ভুত কারণ তারা সাধারণত ইসরায়েল যা বলে তা পুনরাবৃত্তি করে এবং ফিলিস্তিনিদের কথা শোনে না। হঠাৎ তারা এত বিচলিত কেন?
এটি প্রশ্ন উত্থাপন করে যে আমেরিকান কর্মকর্তা এবং মিডিয়া নেতারা, যারা সাধারণত ইসরায়েলি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিধ্বনি করে এবং ফিলিস্তিনি কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করে, তারা এখন কেন এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে।
উদাহরণস্বরূপ, বাইডেন কেন আরবি শব্দ 'ইন্তিফাদা' (যার অর্থ অভ্যুত্থান) কে 'বিপজ্জনক ঘৃণামূলক বক্তব্য' হিসেবে চিহ্নিত করবেন? কীসের এত ভয়?
এই সমস্ত চরম কথাবার্তা প্রমাণ কর যে দায়িত্বে থাকা ক্ষমতাশালীরা ফিলিস্তিনিদের অধিকার এবং ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রথমবারের মতো বেশ চিন্তিত।
তারা আমেরিকানদের একটি ক্রমবর্ধমান গোষ্ঠী সম্পর্কে উদ্বিগ্ন যারা ইসরায়েলকে সমর্থনকারী মিথ্যা এবং পক্ষপাতের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পায় না। এবং তাদের উদ্বিগ্ন হওয়াই উচিত, কারণ সিএনএনের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে যে ১৮-৩৫ বছর বয়সী আমেরিকানদের ৮১ শতাংশ গাজায় ইজরায়েলের যুদ্ধকে সমর্থন করে না।
অনেক তরুণ বিক্ষোভকারী গাজার সহিংসতাকে এ সময়ের একটি নৈতিক সমস্যা হিসেবে দেখছে যা তারা উপেক্ষা করতে পারে না। ইসরায়েলের তৈরি অনাহার এবং গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বোমা হামলা নিয়ে তারা বিচলিত।
কিন্তু যখন এই নীতিগত অবস্থানকে যখন মার্কিন মূলধারার গণমাধ্যম বিকৃত করে 'ইহুদিবিদ্বেষী' ও 'সন্ত্রাসপন্থী' প্রমাণ করে, তখন এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, অনেক গণমাধ্যম সত্য বলার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়ে বেশি যত্নশীল।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন
এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় নীতিকে প্রতিফলিত করে না।